ফির একবার মোদি সরকার

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি

সমাজে কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। অগ্রসর চিন্তার এসব মানুষের কথা সমসাময়িক কালে তেমন প্রভাব ফেলে না। মধ্যম বা নিম্নপর্যায়ের লোকেরাই সাধারণত ছড়ি ঘোরান, চারপাশে লোক জোটাতে পারেন।

এ রকম একজন মানুষ ছিলেন উর্দু ভাষার রোমান্টিক কবি মাওলানা হসরত মোহানি। শুরুতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। ১৯২১ সালে আহমেদাবাদে বসেছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের আলাদা আলাদা সম্মেলন। তখন অনেকেই যুগপৎ দুটি প্ল্যাটফর্মই ব্যবহার করতেন। হসরত মোহানি কংগ্রেসের সম্মেলনে ভারতের জন্য ‘পূর্ণ স্বরাজের’ দাবি তুললেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল, ভারতকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তিনি এটাকে বললেন ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্ডিয়া’। কংগ্রেসের আরেক বড় নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এর বিরোধিতা করে প্রস্তাব করলেন ‘হোমরুল’, কেবলই স্বরাজ।

হসরত মোহানি এরপর গেলেন মুসলিম লীগের সম্মেলনে, একই শহরে। সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব দিলেন পূর্ণ স্বাধীনতার। সেখানেও তিনি সমর্থন পেলেন না। মুসলিম লীগ নেতারা তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চাননি। তাঁদের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ সরকারের মধ্যস্থতায় ‘হিন্দু’ কংগ্রেসের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ‘মুসলমানদের’ জন্য কিছু সুবিধা আদায় করা। হজরত মোহানি বিরক্ত হয়ে সম্মেলন ছেড়ে চলে গেলেন। কংগ্রেসের ওপরও তাঁর আস্থা রইল না। তিনি ঝুঁকলেন কমিউনিজমের দিকে।

১৯২৫ সালে কানপুরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলনে তিনি ছিলেন অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি। নতুন একটি স্লোগান উদ্ভাবন করলেন তিনি—ইনকিলাব জিন্দাবাদ (বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক)। এটি পরে কমিউনিস্ট পার্টির স্লোগান হয়েছিল। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের কনফেডারেশনের প্রস্তাব করেছিলেন।

ভারতবাসী হসরত  মোহানির পথে হাঁটেনি। তারা জোট বেঁধেছিল গান্ধী-জিন্নাহ নেহরু-প্যাটেল-লিয়াকতদের নেতৃত্বে। ফলে সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র হলো না, বিপ্লবও হলো না। জনপ্রিয় নেতারা ভারতবাসীকে শেখালেন, হিন্দু আর মুসলমান একসঙ্গে বসবাস করতে পারে না। সুতরাং দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভব হলো। একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিভাজনকে আরও উসকে দিল। এর ধারাবাহিকতায় ভারত ভেঙে পাকিস্তান হলো। পরে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হলো। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষ সমাজে থেকে গেল। মাঝেমধ্যেই ওটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

ভারতের পশ্চিমে পাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায় ঝাড়ে-বংশে প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে। পূর্বে আছে বাংলাদেশ। এখানে জারি আছে এক নীরব অভিবাসনপ্রক্রিয়া। হিন্দুর সংখ্যা এখন সিঙ্গেল ডিজিটে চলে এসেছে। দেশভাগের আগে ১৯৪১ সালের আদমশুমারিতে ওরা ছিল শতকরা ২৭ ভাগ। ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মুসলমানের বাস। কিন্তু তারাও থাকে আতঙ্কে। একদা ‘সেক্যুলার’ ভারত এখন আগের রূপে নেই। ওপরে-ওপরে সেক্যুলারিজমের যেটুকু পলেস্তারা ছিল, বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়ে তা খসে পড়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উত্থান তখন থেকেই। সেই যে বাজপেয়ি-আদভানিরা রথে চড়ে অযোধ্যার দিকে রওনা হলেন, তখন থেকেই ভারতের সেক্যুলারিজমের অগস্ত্যযাত্রা।

ভারত তিন টুকরো হয়েও জনমনে স্বস্তি ও শান্তি দিতে পারেনি। পাকিস্তান তো ইসলামিক রিপাবলিক। বাংলাদেশ কাগজে-কলমে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র হলেও এই রাষ্ট্রের আবার একটি ধর্ম আছে। এখানে নেতা-নেত্রীরা নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে। ভারতে বিজেপি চালু করেছে নতুন ডিসকোর্স—হিন্দুত্ববাদ। এই তিন দেশেই রাজনীতিতে এখন ‘মেজরিটারিয়ান শভিনিজম’ (সংখ্যাগরিষ্ঠের কর্তৃত্ববাদ) চলছে।

অতীত পরিবর্তন করা যায় না। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিলে ভবিষ্যতে ভুল করার প্রবণতা কমে যায়। আমরা সেই শিক্ষা নিইনি। এখনো আমাদের চিন্তায়, চেতনায়, অভ্যাসে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ১৯০৫,১৯৪৭ ও ১৯৭১ এমনভাবে মিশে আছে, যার ঘেরাটোপ থেকে আমরা বের হতে পারছি না। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সম্ভবত নেপাল এখনো ব্যতিক্রম। এর সর্বশেষ আঞ্জাম-আয়োজন দেখলাম ভারতের সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে। আদভানিরা যে রথযাত্রা নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে শুরু করেছিলেন, তা এখন সমগ্র ভারতকেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। মহাভারতে অভিমন্যুবধের গল্প আছে। আজকের অভিমন্যু হলো সেক্যুলার গণতন্ত্র। এত দিন আমরা গণতন্ত্রের সবক নেওয়ার জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এখন দরকার নিজেদের দিকে তাকানোর।

অনেক আগে লিয়ঁ ট্রটস্কি একক কোনো দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঝুঁকির কথা বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আশপাশের দেশে সমাজতন্ত্র না থাকলে একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে তা সফল হবে না। এই সতর্কবাণী বুঝতে সোভিয়েত নেতাদের ৭০ বছর লেগেছিল। সেক্যুলারিজমের ধারণাটিও তা-ই। ইউরোপের রেনেসাঁ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে উনিশ শতকে বাংলা মুলুকে এসেছিল চুইয়ে চুইয়ে—ট্রিকল ডাউন প্রসেসের মধ্য দিয়ে। সেটা আজ অনেকটাই হিমঘরে চলে গেছে। কলকাতায় বিদ্যাসাগরের ভাস্কর্য ভাঙার মধ্য দিয়ে আবারও মনে হলো, দেশটা বিদ্যাসাগর-মধুসূদন-রামমোহন-রবীন্দ্রনাথদের নয়। এ দেশ বাগাড়ম্বরকারীদের।

বিজেপির স্লোগান ছিল, ‘ফির একবার মোদি সরকার’। এটিই সত্য হলো। নির্বাচনে পরাজিত পক্ষ ভোট কারচুপির নালিশ তোলেনি। গণতান্ত্রিক রীতি মেনে তারা নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছে। কিন্তু বিজেপি আমজনতার ধর্মীয় অনুভূতিকে সুড়সুড়ি দিয়ে যেভাবে ভোটযুদ্ধে কামিয়াব হলো, আখেরে তার ফল ভালো হবে না। রূপকথার বইয়ে পড়েছি, ভূতের পা পেছন দিকে। অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে ভারত সামনে এগোচ্ছে। কিন্তু রাজনীতি হচ্ছে পশ্চাৎ-মুখী।

আমরা ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, একটি রাষ্ট্রের গণ্ডির মধ্যে বসবাস করি। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের একটি পরিচিতি আছে। আমরা, বাংলাদেশিরা ভারতের রাজনীতি নিয়ে যতই আগ্রহ কিংবা আশঙ্কা, উল্লাস কিংবা উষ্মা দেখাই না কেন, ওটার নিয়ন্ত্রণ ভারতীয়দের হাতে। আমাদের ভাববার বিষয় হলো, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আচরণ কেমন হবে। দুই দেশের সরকারই দাবি করে, বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। আমরা এটা বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু আশঙ্কাও আছে।

নির্বাচনের আগে বিজেপি জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে আগ্রাসী প্রচারণা চালিয়েছে। আমাদের পূর্বে ও উত্তরে বিজেপি ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। পশ্চিমবঙ্গে ভালোভাবেই থাবা বসিয়েছে তারা। বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া ‘মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের’ তাড়াবে, এই ওয়াদা তাদের। এই তালিকায় আছে প্রায় ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি মানুষ। তারা যদি সত্যি সত্যিই এই বোঝা বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, তাহলে বাংলাদেশ চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে।

অতীতে আমরা দেখেছি, নির্বাচনী ওয়াদা রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনের পর অনেক ক্ষেত্রেই ভুলে যান। ভোট পাওয়ার জন্য তাঁদের কত কসরতই না করতে হয়। নরেন্দ্র মোদির নতুন সরকার এখন কী করে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

আমাদের মূল সমস্যাটি কিন্তু অন্য জায়গায়। ভৌগোলিক দিক থেকে এ অঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানিনিষ্কাশনের নালা হলো বাংলাদেশ। আবার প্রয়োজনের সময় পানি আসে ভারত থেকেই। কারণ, নদীগুলো অভিন্ন। তাই এ দেশের মানুষ পরিবেশগত ভারসাম্য নিজে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাকে নির্ভর করতে হয় ভারতের ওপর। এই একটি ব্যাপারে দর-কষাকষি করার সক্ষমতা থাকা দরকার আমাদের। এই ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। নরেন্দ্র মোদিকে দোষ দেওয়ার আগে আমাদের নিজেদের চেহারাটা আয়নায় দেখা দরকার। আমরা কি অন্তত এ বিষয়টিতে একজোট হতে পারব? বিভক্ত জাতিকে সহজেই পদানত করা যায়।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]