বিপর্যয় ঠেকানোর উদ্যোগ নিন

দেশে শিক্ষার মান ক্রমহ্রাসমান বলে বিভিন্ন মহল বারবার সতর্ক করছে। কেউ জোর দিয়ে এর বিপরীতেও বলছেন না। তাহলে বক্তব্যটি অসার নয় বলেই ধরে নিতে হবে। ধারণা করতে হয়, আমরা একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আর এ যাত্রাপথ বিপরীতমুখী করতে না পারলে জাতি হিসেবে আমাদের যে অর্জন, তা অর্থহীন হয়ে যাবে। জলাঞ্জলি যেতে পারে অর্জিত সাফল্যগুলো। সম্প্রতি কথাটা জোর দিয়ে সামনে এল লন্ডনের টাইমস হায়ার এডুকেশনাল জরিপের একটি প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটিতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ক্রমানুসারে সাজানো হয়েছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে সে তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। রয়েছে চীনের ৭২টি, ভারতের ৪৯টি ও তাইওয়ানের ৩২টি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম।

তালিকায় ঠাঁই নিয়েছে কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয় ও নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়। জঙ্গিবাদসহ বহু নেতিবাচক ভাবমূর্তির অধিকারী পাকিস্তানের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে সে তালিকায়। জানা যায়, জরিপে শিক্ষাদান, গবেষণালব্ধ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বিনিময় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটি আমাদের দেশের শিক্ষার নিম্নমানের একটি স্মারক বলে চিহ্নিত করা যায়। দেশে ৪৫টি সরকারি ও ৫৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কয়েকটিকে নিয়ে রয়েছে আমাদের বিশেষ গৌরববোধ। কিন্তু সেগুলো যে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে পিছিয়ে যাচ্ছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আলোচ্য প্রতিবেদন।

এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এর মধ্যে বড় অভিযোগ, অন্য প্রতিবেশীদের তুলনায় শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় আমাদের সরকারের বিনিয়োগের কমতি। অভিযোগটি অমূলক নয়। তবে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো, তখনো আনুপাতিক বিনিয়োগ তেমন বেশি ছিল, এমনটা বলা যাবে না। প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আরও বলা হয়, এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন কার্যক্রম অনলাইনে নিয়মিত আপলোড করা হয় না। আর জরিপটি হয়েছে সে তথ্যের ভিত্তিতে। বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রবাহের এ যুগে বিভিন্ন তথ্য ওয়েবসাইটে আপলোড না করার দায় নিজেদের। কাজকর্মের খতিয়ান দিতে হয় ওয়েবসাইটেই।

কেউ মনে করেন, শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় ব্যাপক দলীয়করণ ও পদোন্নতির ভ্রান্ত নিয়মাবলিও এর জন্য দায়ী। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুই-তৃতীয়াংশ অধ্যাপকের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি নেই। তাঁদের অনেকেরই নেই মানসম্পন্ন জার্নালে প্রকাশনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক গুণী ও মেধাসম্পন্ন শিক্ষক রয়েছেন। তাঁদের সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টা তলিয়ে যাচ্ছে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের জোরালো সমর্থক ও তাদের কর্মসূচিতে অতি মনোযোগী শিক্ষকদের জন্য। এর মধ্যেও অনেক ভালো ছাত্র ডিগ্রি নেন। তাঁরা কৃতী হন দেশ ও বিদেশে। তবে প্রশ্নটা গড় শিক্ষার মান নিয়ে।

কোনো কোনো শিক্ষাবিদ এমনটাও বলেন যে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পাঠক্রমের প্রতি কম মনোযোগী। তাঁদের অনেকে নিয়ত বিসিএসের গাইড বই নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ছাত্রদের এ সময়টা ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের গতি নির্ধারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ। উঁচু মানের ভালো ছাত্রদের সবাই আসেন না বিসিএসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা তাঁদের অনেকের প্রথম পছন্দ। এর পাশাপাশি রয়েছে বহুজাতিক ব্যাংক, এমনকি তামাক প্রক্রিয়া ও বাজারজাতকরণ কোম্পানির চাকরি। যাঁরা এগুলো লাভ করেন, তাঁরা পরিবার ও সমাজে আদৃত হন। আর বিসিএস দিয়ে তো শুধু প্রশাসনে আসেন না। সরকারি কলেজশিক্ষক, চিকিৎসক সবাইকে বিসিএস পরীক্ষা দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে ছাত্রজীবনে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি জ্ঞান অন্বেষণের বিবেচনায় পীড়াদায়ক হলেও ভোগবাদী সমাজে দোষের বলা যাবে না।

প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর সবারই নজর দেশের নামীদামি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানের মধ্যেও যে ব্যাপক ফারাক, তা নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ বিষয়ে একটি জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে বাস্তবতাটা সামনে আসত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান নামকরা কলেজশিক্ষকদের চেয়েও পেছনে, এ বক্তব্য প্রায়ই আসে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানে উপযুক্ততা কী পরিমাণ শিক্ষকের আছে, তা পর্যালোচনা না করেই রাতারাতি বাড়ানো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। উপযুক্ত শিক্ষকের পাশাপাশি বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামো, পাঠাগার, গবেষণাগার ইত্যাদি ব্যবস্থা করতে না পারলে সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা অপূর্ণ থাকবে, এটা বলা বাহুল্য।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উৎসবের মেজাজে চলছে। সমাবর্তনে এর প্রকাশই দেখা যায়। অথচ গুটিকয়েক বাদ দিলে অবশিষ্টগুলোকে হিসাবে নেওয়াও অসংগত হবে। অনেকগুলোর নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষকেরা শিক্ষকতা করে টিকিয়ে রাখছেন এগুলো। নিজস্ব ফ্যাকাল্টি জীর্ণ ও বিবর্ণ। এগুলো ডিগ্রি দেওয়ার কারখানা বলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। সন্দেহ নেই, সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু মানসম্পন্ন ছাত্র তৈরি হচ্ছে সব প্রতিকূলতার মধ্যে, তবে গড় মান নেমে যাচ্ছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভায় বছর দুয়েক আগে তখনকার ট্রেজারার বক্তব্য দিয়েছিলেন যে সান্ধ্য কোর্সের নামে তাঁদের এখানে নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে। বক্তব্যের প্রতিবাদ কেউ করেননি। সে সান্ধ্য কোর্সের শিক্ষার্থীরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদধারী হচ্ছেন। তাই গড় মান নেমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে আলোচনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক দেশের সামগ্রিক শিক্ষার মান আলোচনা। এ বিষয় পরীক্ষিত যে দেশের সব স্তরের শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে। আর বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই। তাদের ভর্তি পরীক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উচ্চতর গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজধারীদের (জিপিএ) বিশাল অংশ পাস নম্বর পান না। ওই স্তরগুলোর শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে বড় ধরনের গলদ। তেমনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও সুবিধাদি স্বাধীনতাপূর্ব কালের তুলনায় অনেক গুণ বৃদ্ধি পেলেও সে প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক ক্ষেত্রে মান গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ। সেখানেও কোচিং করতে হয়।

সরকারি নিয়মে দিতে হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) নামক পাবলিক পরীক্ষা। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উত্তীর্ণদের বিরাট অংশ মাধ্যমিকে পড়াশোনা চালানো উপযুক্ততা অর্জন করে আসে না। আর মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষায় যায় একই ধরনের ভঙ্গুর অবস্থা নিয়ে। তবে পরীক্ষা ব্যবস্থার কল্যাণে ভালো জিপিএ থাকে অনেকের। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আলোচিত হয়েছে। দেশে সর্ববৃহৎ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অধিভুক্ত কলেজগুলোয় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষা তারা নেয়, দেয় সনদ। এর অনেকগুলোর মান গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ। তাহলে বাকি রইল কী? আমাদের শিক্ষার নিম্নমান আলোচনা এখন জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন শুধু শ্রমিক নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক মানসম্পন্ন স্নাতকের চাহিদা তৈরি করছে। এর সামান্যই জোগান দিতে পারছি আমরা। বিদেশ থেকে বেশি ব্যয় করে তাদের কর্মী আনতে হয় বলে উদ্যোক্তারা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। অন্যদিকে আমাদের স্নাতকেরা নিম্নমানের চাকরির জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে চান।

শিক্ষার মানের ক্রম নিম্নমুখিতার জন্য আমাদের কম বিনিয়োগ দায়ী বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। তবে অতি সম্প্রতি একটি বাংলা দৈনিক জরিপ চালিয়ে দেখিয়েছে, সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ব্যয় করতে হয় বাংলাদেশের অভিভাবকদের। তাদের জরিপে এসেছে প্রাইভেট, কোচিং ইত্যাদি খরচও। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজগুলোর বেতন–ভাতাও অনেক। তাহলে এ ব্যয় অর্থবহ হচ্ছে না কেন? সরকারের ব্যয় বাড়ানো উচিত, এ বিষয়ে কোনো ভিন্নমত নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাযথ অবকাঠামো, পাঠাগার ও গবেষণাগারের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। এগুলো পরিচালনার জন্যও দিতে হবে যথাযথ মঞ্জুরি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ দরকার। আর এগুলো করবেন মূলত শিক্ষকেরা, সে শিক্ষক নিয়োগে একমাত্র মেধাকে প্রাধান্য দেওয়া নীতির ওপর জোরালো আস্থা দরকার। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষার মেরুদণ্ড শিক্ষক। সে মেরুদণ্ড শক্ত হলে আজকের অবস্থান সময়ান্তরে বিপরীতমুখী হতে বাধ্য।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]