বাংলাদেশে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি: অগ্রগতি এবং সম্ভাবনা

১১ মে ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লুউএইচও) সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি: অগ্রগতি এবং সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশ  করা  হলো।

যাঁরা অংশ নিলেন

হোসেন জিল্লুর রহমান: এক্সিকিউটিভ চেয়ারপারসন, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)
তন্দ্রা শিকদার: মহাপরিচালক, নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর
বারদান জাং রানা: প্রতিনিধি, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, (ডব্লিউএইচও)
অসা টর্কেলসন: প্রতিনিধি, ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড (ইউএনএফপিএ)
নাসিমা সুলতানা: অতিরিক্ত মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
সুরাইয়া বেগম: রেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ নার্সেস অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল
মোশতাক চৌধুরী: ভাইস চেয়ারপারসন, ব্র্যাক
লিয়াকত আলি: সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস
মমতাজ বেগম: সভাপতি, বাংলাদেশ মিডওয়াইফারি সোসাইটি
ইসমত আরা পারভীন: সভাপতি, বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন
সেলিনা আমীন: প্রধান, মিডওয়াইফারি এডুকেশন প্রোগ্রাম, ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ।
সালেহা বেগম চৌধুরী: সাধারণ সম্পাদক, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনায় সুপারিশ

■ প্রয়োজনীয় সংখ্যক নার্স ও মিডওয়াইফ নিয়োগ দিতে হবে এবং তাঁদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা িনশ্চিত করতে হবে

■ মিডওয়াইফারি খাতে বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি করা জরুরি

■ নার্স ও মিডওয়াইফারি শিক্ষকদের গুণগত মান িনশ্চিত করা প্রয়োজন

■ নার্স ও িমডওয়াইফদের প্রশিক্ষণের জন্য মানসম্মত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে

■ কমিউনিটি নার্সিংয়ের বিষয়ে জোর দেওয়া প্রয়োজন

■ নার্স ও িমডওয়াইফদের জন্য একটি যুগোপযোগী নিয়োগবিধি প্রণয়ন করা দরকার

■ পদোন্নতির বিষয়ে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ প্রয়োজন

■ সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও এনজিওগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে

■ স্বাভাবিক জন্মদানপ্রক্রিয়া নিশ্চত করতে মিডওয়াইফ সেবা জরুরি

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। গত তিন বছরে প্রথম আলো এ বিষয়টি নিয়ে কয়েকবার আলোচনা করেছে। এতে অগ্রগতিও হয়েছে। আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। তবে সমস্যাও আছে। আমাদের দেশে নার্স ও মিডওয়াইফ প্রয়োজন প্রায় সোয়া দুই লাখ। অথচ সে তুলনায় বর্তমানে মিডওয়াইফদের সংখ্যা অপ্রতুল। বেসরকারি খাত যদি এগিয়ে আসে, তবে অগ্রগতি সম্ভব হবে।

আমাদের দেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলো ভালো বেতন দেওয়ার ঝামেলা এড়াতে প্রশিক্ষিত নার্স বা মিডওয়াইফদের সুযোগ দেয় না। বিষয়টি কাটিয়ে উঠতে পারলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান করা যাবে বলে মনে করি। আজ আমরা নার্সিং ও মিডওয়াইফারি বিষয়টির অগ্রগতি ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।

এখন এ বিষয়ে আলোচনা করবেন হোসেন জিল্লুর রাহমান।

হোসেন জিল্লুর রহমান
হোসেন জিল্লুর রহমান

হোসেন জিল্লুর রহমান
নার্সিং মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে নার্স বা মিডওয়াইফের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এই দিক দিয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।

কয়েক দিন আগে একজন নার্সকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তাই এই পেশা এখন কেবল সংখ্যাগত আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে না। আমার মনে হয়, নার্স ও মিডওয়াইফদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সমানভাবে গুরুত্বের দাবিদার।

গুণগত মানসম্পন্ন নার্স ও মিডওয়াইফদের আমরা দেশের বাইরেও কর্মসংস্থানের জন্য পাঠাতে পারব। অনেক দেশেই দক্ষ জনবলের চাহিদা রয়েছে। দক্ষ নার্স ও মিডওয়াইফ যদি আমরা তৈরি করতে পারি, তাহলে বিদেশে বাংলাদেশি নারীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করতে পারব।

একসময় নার্সিং ও মিডওয়াইফারি একটি অবহেলিত পেশা ছিল। মানুষ হয়তো ভাবত, যাঁদের অন্য কোনো উপায় নেই, তাঁরাই এখানে পড়বেন। বর্তমানে এটা একটা সম্মানজনক পেশা। নার্সিং পেশা মূলত নারীপ্রাধান পেশা। নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও এ পেশায় আসা উচিত।

অসা টর্কেলসন
অসা টর্কেলসন

অসা টর্কেলসন
ইউএনএফপিএর বড় একটি লক্ষ্য হলো, জন্মদানের সময় প্রতিরোধযোগ্য অবস্থায় যেন কোনো নারী মারা না যান। আমাদের আরও একটি লক্ষ্য হলো, অপরিকল্পিত পরিবার পরিকল্পনা রোধ করা। এ ছাড়া নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করা। এই ক্ষেত্রে মিডওয়াইফের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ, এখানে মিডওয়াইফের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

মিডওয়াইফের ব্যাপারে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করেছি। এ ক্ষেত্রে সাফল্য দেখে আমরা গর্বিত। বাংলাদেশে অনেক মিডওয়াইফ আছেন। অনেকে সনদের জন্য অপেক্ষা করছেন। দেশে মিডওয়াইফের ঘাটতি আছে। আমরা মিডওয়াইফদের প্রশিক্ষিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

প্রতিবছর প্রতিরোধযোগ্য ক্ষেত্রে ৫ হাজার ২০০ জন নারী জন্মদানের সময় মারা যান। একই কারণে প্রতি সপ্তাহে ১০০ জন গর্ভবতী নারীর মৃত্যু ঘটে। এটি একটি ভয়ানক বিষয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটি আমরা বন্ধ করতে পারি।

অবশ্য কিছু জায়গা আছে, যেখানে নারীরা চিকিৎসা নিতে পারেন না। এসব এলাকায় আমাদের পৌঁছানো কঠিন। আমরা বান্দরবানের থানচি গিয়েছিলাম। সেখানে দেখতে চেয়েছিলাম, নারীরা গর্ভকালীন ঠিকঠাক চিকিৎসা নিতে আসছেন কি না। এটা করতে গিয়ে নারীদের চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা নতুন সমস্যা বের করেছি। যেমন ভাষাগত বিপত্তি, নিরাপত্তার বিষয় ইত্যাদি।

কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে মিডওয়াইফারি খাতে আরও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা দরকার।

বারদান জাং রানা
বারদান জাং রানা

বারদান জাং রানা
আমরা সবাই বাংলাদেশের নার্সিং সমস্যা সম্বন্ধে জানি। নীতিনির্ধারকেরা একজন চিকিৎসকের জন্য তিনজন নার্স দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যেই নার্স ও মিডওয়াইফদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

২০৩০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

নার্সদের আনুষঙ্গিক কিছু কাজ করতে হয়, যা তাঁর আওতায় পড়ে না। এটা তাঁদের সেবাদানের সময় কমিয়ে দিচ্ছে।

এসডিজি অর্জনের জন্য বাংলাদেশের আরও উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন নার্স ও মিডওয়াইফের দরকার। তাঁদের দিয়েই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। এ দুটি পেশা আমাদের জন্য শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হতে পারে।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্যে আছে যে নার্স ও মিডওয়াইফের অংশগ্রহণের ফলে কমিউনিটি হেলথ অনেক উন্নতি করছে। এ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগগুলো উল্লেখ করা যায়।

অন্য একটি বিষয় হলো, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি পেশার শিক্ষকদের গুণগত মান নিশ্চিত করা। নার্স ও মিডওয়াইফদের দক্ষাতা অর্জনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া। ভালো সেবা পেতে হলে তাদের মানসম্পন্ন শিক্ষক দ্বারা শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।

নার্স ও মিডওয়াইফের পেশাগত মর্যাদার ব্যাপারে কথা বলা দরকার। নিঃসন্দেহে এই পেশা সম্মান ও মর্যাদার।

মানুষকে বোঝাতে হবে এই দুই পেশার মানুষ কত উঁচু পর্যায়ের। মা-বাবারা তাঁদের ছেলেমেয়েদের চিকিৎসক বানাতে চান।

অনেক মা–বাবা তাদের সন্তানদের কেন নার্স বানাতে চান না? এটা তো খুব ভালো একটি বিকল্প পেশা হতে পারে।

 

নাসিমা সুলতানা
নাসিমা সুলতানা

নাসিমা সুলতানা
সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি নার্সিং কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট ও মিডওয়াইফ ইনস্টিটিউট আছে ৩১৭টি। এগুলোর মধ্যে সরকারি মাত্র ৯৯টি। বেসরকারি ২১৮টি। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর ১২ থেকে ১৩ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স বের হচ্ছে। আর আমাদের ঘাটতি আছে প্রায় দুই লাখের বেশি। এভাবে চলতে থাকলে নার্সের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে অনেক বছর লেগে যাবে। তাই দ্রুত এই ঘাটতি পূরণ করতে আমাদের আরও কলেজ-ইনস্টিটিউট তৈরি করতে হবে। ২০১৬ সাল অনুযায়ী সরকারি পর্যায়ে আমাদের পদ বরাদ্দ আছে ৩২ হাজার ২৩৯টি, কর্মরত আছেন ২৭ হাজার ৪৩২ জন।

একজন চিকিৎসকের জন্য তিনজন নার্সের প্রয়োজন। অথচ আমাদের দেশে তিনজন চিকিৎসকের জন্য একজন নার্স রয়েছেন। এই অনুপাত কমাতে হলে অবশ্যই বরাদ্দকৃত পদ বাড়াতে হবে।

চিকিৎসাব্যবস্থা একটি সমন্বিত ব্যবস্থা। চিকিৎসক ও নার্সের সমন্বিত চেষ্টায় ভালো স্বাস্থ্য নিশ্চিত হয়। ভালো স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য চিকিৎসক-নার্স অনুপাত ঠিক করতে হবে। এসডিজি অর্জন করতে হলে অবশ্যই মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে হবে।

২০৩০ সালের মধ্যে এর সংখ্যা ১ লাখে ৭০ জনে আনতে হবে। যা এখন আছে, ১ লাখে ১৭২ জন। সেই ক্ষেত্রে মিডওয়াইফরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফরা ঠিকঠাক কাজ করতে পারলে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু ঠেকানো যায়। নবজাতকের মৃত্যু কমানো যায় ১৬ শতাংশ।

নার্স ও মিডওয়াইফদের উন্নয়নে সরকার আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে। ইতিমধ্যেই নার্স ও মিডওয়াইফরা চাকরির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শ্রেণির গ্রেডে উত্তীর্ণ হয়েছেন। যেসব গ্র্যাজুয়েট কিংবা এমএসসি করা নার্স আছেন, তাঁদের প্রথম শ্রেণিভুক্ত করা যায় কি না, ভাববার সময় এসেছে।

সুরাইয়া বেগম
সুরাইয়া বেগম

সুরাইয়া বেগম
নার্স ও মিডওয়াইফের সংখ্যাগত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে আমাদের বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের দেশে অনেকে এই পেশায় মাস্টার্স ও পিএইচডি করেছেন। অনেকে দেশের বাইরে থেকেও করেছেন। তাঁদের যথোপযুক্ত জায়গায় মূল্যায়ন করা গেলে আমাদের সমস্যাটা আরও কমে আসবে।

এবার আমাদের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় ৫২ হাজার পরীক্ষার্থী ছিলেন। এতে ৪৭ হাজার উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং আমাদের আসনসংখ্যা হলো ১৫ হাজার। আমাদের অনেক ছেলেমেয়ে এই পেশায় আগ্রহী হচ্ছেন।

২০৩০ সালের মধ্যে আমরা এসডিজি অর্জন করতে যাচ্ছি। নার্সিং ও মিডওয়াইফারিতে বিনিয়োগ বাড়ালে এসডিজি অর্জন সহজ হবে।

আমাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিকের পর চার বছর মেয়াদি কোর্স সম্পন্ন করলেই প্রথম শ্রেণির চাকরিতে আবেদন করার যোগ্যতা লাভ করে। সে হিসাবে আমাদের প্রশিক্ষিত নার্স কিংবা মিডওয়াইফরাও এই সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরা এটা পাচ্ছেন না।

ইউনিয়ন পর্যায়ে নার্সদের জন্য পদ সৃষ্টির পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই আমাদের আছে। বিদেশে একজন নার্স একটি কমিউনিটি হাসপাতাল চালান।

এ ক্ষেত্রে তাঁরা খুব ভালো করছেন। আমাদের দেশেও নার্সদের এই সুযোগ দেওয়া হলে তাঁরাও ভালো করবেন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিডওয়াইফদের ভূমিকা খুব ভালো। তাঁরা সেখানে চমৎকার কাজ করছেন। তাঁদের কাজ করার সুন্দর পরিবেশ দিতে পারলে তাঁরা ভালো করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

লিয়াকত আলি
লিয়াকত আলি

 লিয়াকত আলি
আমরা কিন্তু সব সমস্যার সমাধান করতে পারি না। এখন আমাদের দেশে বিএসসি ও ডিপ্লোমা নার্সিং প্রচলিত আছে। ২০০৮ সালে মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিকে ডিপ্লোমা নার্সিংয়ের ভর্তিতে পরিবর্তন আসে।

গ্র্যাজুয়েট নার্সিংয়ের ক্ষেত্রেও তা–ই। আমাদের ভর্তির িনয়মগুলো কেমন হওয়া উচিত, সেদিকে নজর রাখতে হবে। আমরা নার্সিংয়ে মাস্টার্স কোর্স শুরু করেছি। তবে বছরে মাত্র ৬০ জন বের হচ্ছেন। এই সংখ্যা যথেষ্ট নয়।

নার্সিং ডিপ্লোমার মান নির্ধারণের ব্যাপারেও লক্ষ রাখা দরকার। নার্সিং পেশার শিক্ষার মান কে নির্ধারণ করছে? এটা বড় একটি প্রশ্ন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কি এই শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করবে, নাকি শিক্ষা মন্ত্রণালয় করবে? ডিপ্লোমা কোনো একটি বোর্ডের অধীনে দিতে হয়। তাই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

অনেক নার্স এখন নার্সিং কার্যকলাপের বাইরের কার্যক্রমেও যুক্ত আছেন। অনেকে আছেন, যাঁরা এখনো সেই অর্থে অভিজ্ঞ নন। আধুনিক নন। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর সেবা করার চেয়ে তাঁদের আনুষঙ্গিক কাগজপত্রের কাজ বেশি করতে হয়।

আমাদের অবশ্যই নার্সদের জন্য যথেষ্ট সহকারী নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যদি এটা করতে ব্যর্থ হই, তবে তাঁরা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকবেন। এতে রোগী গুণগত সেবা পাবে না।

কমিউনিটি নার্সিংয়ের বিষয়টিও আমাদের গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। সত্যিকার অর্থে আমাদের কমিউনিটি নার্সিং নেই বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

বিএনএমসি (বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল) এবং বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল)—এই দুই সংগঠনের উচিত নার্সদের ঠিকমতো রেজিস্ট্রেশন, নিরাপত্তা, পরীক্ষা নেওয়া, সনদ প্রদানসহ প্রভৃতি ব্যাপারে গুরুত্বের সঙ্গে তদারক করা।

উপযুক্তভাবে রেজিস্ট্রেশন করা এবং ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া। তাহলে হয়তো আমরা এ সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারব।

প্রশাসনিকভাবেও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সব মিলিয়ে আমাদের এগুলো নিয়ে আলোচনা করা দরকার। কথা বলা দরকার। যেন আমরা এই সমস্যাগুলো থেকে বের হতে পারি।

মমতাজ বেগম
মমতাজ বেগম

মমতাজ বেগম
বাংলাদেশে নার্সিং পেশা অপেক্ষাকৃত পুরোনো। মিডওয়াইফারি পেশা সে তুলনায় একদম নতুন। ২০১০ সালে মিডওয়াইফারি কোর্স প্রোগ্রামটি চালু হয়।

এটি ছিল সার্টিফিকেট প্রদান কোর্স। ২০১২ সাল থেকে ডিপ্লোমা কোর্স শুরু হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশ মিডওয়াইফারি সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সরকারিভাবে দেশে মিডওয়াইফদের ৩৮টি নার্সিং ইউনিটে ৯৭৫টি সিট আছে। বেসরকারি ১৭টি নার্সিং ইউনিটের মধ্যে ৭টি ব্র্যাকের। বাকি ১০টি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের।

বেসরকারি সিট আছে ৫৯০টি। অর্থাৎ প্রতিবছর এখানে ১৫৬৫ জন নতুন যুক্ত হতে পারেন। ইতিমধ্যে মিডওয়াইদের তিন হাজার নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।

তাঁদের মধ্য থেকে প্রতি চারজনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়োগ করা হয়েছে। মোট ৩৫০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ২৯টি ইউনিয়ন সাবসেন্টারে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এই চারজন দিয়ে আসলে সাত দিন-চব্বিশ ঘণ্টা সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। আমাদের মিডওয়াইফদের পদের সংখ্যা মাত্র তিন হাজার। এটা আরও অনেক বাড়াতে হবে

ইসমত আরা পারভীন
ইসমত আরা পারভীন

 ইসমত আরা পারভীন
নার্সিং পেশার অগ্রযাত্রা মূলত শুরু হয়েছে ২০১১ সাল থেকে। বর্তমান সরকার নার্সদের মর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করেছে। এর ধারাবাহিকতায় আমরা নার্সদের পক্ষ থেকে ২০১১ সালে নার্স সমাবেশের আয়োজন করেছি। সে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নার্সিং পেশাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে যা কিছু দরকার, আমরা তা পেয়েছি।

নার্সিং পেশা শুরু হওয়ার সময় এটি পরিদপ্তর হিসেবে শুরু হয়। বর্তমানে এটিকে অধিদপ্তর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এরই মধ্যে আমাদের অধিদপ্তরে ২০তলা ভবনের ১২তলা নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।

অনেক উন্নতি ও অগ্রগতির পাশাপাশি আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন আমাদের নিয়োগবিধি এখনো পরিদপ্তরের আওতাধীনে হয়। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, দ্বিতীয় শ্রেণির নার্সদের প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা হবে। ২০১৯ সালে ২৬৩ জন নার্সকে প্রথম শ্রেণিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটা আমাদের জন্য একটা মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।

নার্সিং পেশা এখন পিছিয়ে নেই। এটি বর্তমানে একটি স্বাধীন পেশা। আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ দক্ষ জনবল রয়েছে। তাই নার্সদের জন্য এখনই একটি যুগোপযোগী নিয়োগবিধি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। আমরা চাই আমাদের এই নার্সিং খাতের সর্বোচ্চ পদগুলোতে যেন নার্সরাই আসীন হন।

আমরা নিরাপদ কর্মক্ষেত্র চাই। আমাদের নার্সিং প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোয় শিক্ষকসংকট রয়েছে। তাই খুব দ্রুতই নার্সিংয়ের শিক্ষকদের কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। কার্যকর সেবা প্রদানের জন্য গবেষণা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আমরা ভালো গবেষণা করার সুযোগ পাচ্ছি না। এ বিষয়ে আমরা সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

সালেহা বেগম চৌধুরী
সালেহা বেগম চৌধুরী

সালেহা বেগম চৌধুরী 
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি সেবা স্বাস্থ্যসেবার অপরিহার্য অংশ। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রয়েছে। আমাদের দেশেও বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এটি শুরু হয়েছে। দক্ষ মিডওয়াইফারি সেবা নিশ্চিত করলে স্বাভাবিক জন্মদানপ্রক্রিয়া অনেক সহজ হবে। এর ফলে অপ্রয়োজনীয় সিজার আর করতে হবে না।

দেশে নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক কম। দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফের জন্য মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আমাদের একটি সমৃদ্ধ কারিকুলাম রয়েছে। এটি অনুসারে যদি নার্সদের পাঠদান করাতে পারি, তাহলে অনেক দক্ষ নার্স প্রতিবছর তৈরি হবে।

বর্তমানে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এই পেশায় আসছেন। এটি একটি সম্মানজনক পেশা। এখন এটি সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন। নার্সদের কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে মাতৃমৃত্যুর হার ও শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমানো যাবে। পাশাপাশি উন্নত কিশোরী স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যাবে।

অনেক প্রাইভেট ক্লিনিকে স্বল্পশিক্ষিত নার্সদের দিয়ে সেবা দেওয়া হয়। এ জন্য সারা দেশের মানুষ অনেক দুর্ভোগের শিকার হয়। এ কারণে মাঝেমধ্যে এমন জটিলতা সৃষ্টি হয়, যা সারানোর উপায় থাকে না। কিন্তু কাজটি শুরুতেই দক্ষ নার্স দ্বারা করালে সৃষ্ট জটিলতা এড়ানো যেত।

আমরা (ওজিএসবি) একটা দলে কাজ করি। আমাদের দল মিডওয়াইফ, দুজন চিকিৎসক এবং একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে তৈরি হয়। এ পর্যন্ত আমরা বেসরকারিভাবে কক্সবাজারে ৭০ জন মিডওয়াইফকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি।

এর পাশাপাশি আমরা আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আমরা চাই নার্সরা শুধু লেবার রুমে না, তাঁরা ইনডোর ও আউটডোরে—সর্বত্র কাজ করবেন। সরকার যদি বেসরকারি খাত এবং এনজিও সঙ্গে একত্রে কাজ করতে পারে, তাহলে যেকোনো সমস্যা সমাধান করা যাবে।

সেলিনা আমীন
সেলিনা আমীন

সেলিনা আমীন
আমরা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে মিডওয়াইফারি পড়াই। ২০১২ সাল থেকে বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। এ পর্যন্ত আমাদের ৬টি ব্যাচ ভর্তি হয়েছে। ১ হাজার ৫৯ জন শিক্ষার্থী এখনো ভর্তি রয়েছেন। ৫৭৯ জন শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৯৯ জন সনদ পেয়েছেন। গ্র্যাজুয়েট করা শিক্ষার্থী ও সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি পার্থক্য রয়েছে। এর কারণ পুরো একটা ব্যাচের লাইসেন্সিং পরীক্ষা এখনো হয়নি। এ পরীক্ষার জন্য আমাদের শিক্ষার্থীসহ সাত হাজার নার্স অপেক্ষা করছেন।

আমাদের অনেক বেশি মিডওয়াইফ ও নার্স দরকার। কিন্তু তাঁদের কর্মক্ষেত্রে তাঁরা যেন তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন, সে জন্য লাইসেন্স পরীক্ষায় আটকে রাখা ঠিক হচ্ছে না। দ্রুতই এই পরীক্ষার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কেন পরীক্ষাটা হচ্ছে না, কেন এটা হাইকোর্টে গেল, তা খুঁজে বের করা দরকার। এ ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এগিয়ে আসা উচিত। কারণ, লাইসেন্স না থাকলে তাঁরা কাজে যোগ দিতে পারছেন না।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের সময় আমরা শিক্ষার গুণগত মানের দিকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকি। তাদের ১০০টি নবজাতকের জন্ম–পূর্ব ও জন্ম–পরবর্তী যত্ন নেওয়ার কথা এবং ৪০টি ডেলিভারি করার কথা।

শিক্ষাকে আমি বিশেষ জোর দিচ্ছি। কারণ, নিজের উপস্থিতি ও ডেলিভারি কাজে জড়িত থেকে ৪০টি ডেলিভারি না করলে মাঠপর্যায় গিয়ে তাঁরা কাজ করতে পারবেন না। এ জায়গাটায় আমাদের আসলেই গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

শিক্ষার্থীদের আমরা সাতটি মডিউল পড়াই। তাঁরা কমিউনিটিতে গিয়ে ব্যবহারিকভাবে শেখেন। তাঁরা সেখানে মায়েদের সঙ্গে কথা বলেন। মায়েদের কী অসুবিধা, তা শোনেন। মিডওয়াইফারি সেবা কেন জরুরি, তা মাদের বোঝানো হয়। আমার মনে হয় বিষয়টি নিয়ে আরও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা দরকার। কমিউনিটির কাছে না গেলে মিডওয়াইফ নিজেই বুঝবেন না তাদের গুরুত্ব কতটুকু।

পাশাপাশি কমিউনিটিও জানবে না মিডওয়াইফ তাদের সাহায্য করতে পারেন। সরকার বর্তমানে ইউনিয়ন উপকেন্দ্রে মিডওয়াইফদের নিয়োগ দিচ্ছে। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। উপকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি মিডওয়াইফের সুরক্ষার বিষয়টিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

মোশতাক চৌধুরী
মোশতাক চৌধুরী

মোশতাক চৌধুরী
২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক এবং রকফেলার ফাউন্ডেশন একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল। তাদের গবেষণার বিষয় ছিল ‘হিউম্যান রিসোর্সেস ফর হেলথ’। তারা এই গবেষণাটির জন্য দুই বছর মাঠপর্যায়ে কাজ করেছে। এই গবেষণার মাধ্যমে তারা একটি তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল বের করে আনে।

এর ফলে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ১৬টি দেশ মিলে ‘এশিয়া প্যাসিফিক অ্যাকশন অ্যালায়েন্স অন হিউম্যান রিসোর্সেস ফর হেলথ’ গঠন করেছে। প্রতি দুই বছর অন্তর একটি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

২০০৭ সালে ‘হেলথ ওয়াচ’ বাংলাদেশে ‘হিউম্যান রিসোর্সেস ফর হেলথ’ নিয়ে অনেক বিস্তৃত গবেষণা করেছে। মানবসম্পদে বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি লাভ করেছে। কিন্তু তারপরও বর্তমানে বাংলাদেশে মানবসম্পদ–সংকট রয়েছে। তার মানে এই না যে এখান থেকে উত্তরণের কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। আমরা যথেষ্ট পরিমাণে কাজ করছি। সঠিক পদ্ধতি খুঁজে বের করেছি। আমরা শিগগিরই মানবসম্পদসমৃদ্ধ একটি দেশে পরিণত হব। আমরা বেশ কয়েকটি সূচকে অনেক অগ্রগতি লাভ করেছি। তার মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার এবং শিশুমৃত্যুর হার অন্যতম। মাতৃমৃত্যু হার একেবারে কমিয়ে আনতে আমাদের দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ প্রয়োজন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মিডওয়াইফ একটি সম্মানজনক পেশা। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ এ শব্দটি অপেক্ষাকৃত অনেক নতুন। আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ মিডওয়াইফারি শিক্ষক নেই। এটি অনেক বড় একটি সমস্যা।

আমরা আগামী বছর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডওয়াইফারি বিষয়ক একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছি। সম্মেলনটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে মিডওয়াইফের ভূমিকা তুলে ধরা।

তন্দ্রা শিকদার
তন্দ্রা শিকদার

তন্দ্রা শিকদার
আমাদের দেশে নার্সিং পেশা শুরু হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। কয়েক যুগ পার হয়ে বর্তমানে ৩২ হাজার নার্স খাতায় যোগ হয়েছে। প্রতিবছর সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে থেকে প্রায় তিন হাজার নার্স নতুন করে যোগ হচ্ছেন। নার্সিংয়ের দিক থেকে আমরা অনেক দূর এগিয়ে রয়েছি।

আমাদের অধিদপ্তর সব সময় নার্সদের দক্ষ করে গড়ে তোলার ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। আমাদের ৬০ জন শিক্ষার্থী সুইডেনের ডালার্না বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবভিত্তিক মাস্টার্স প্রোগ্রামে ডিগ্রি লাভ করেছেন। এখনো ৬০ জন সেখানে অধ্যয়নরত আছেন। তারা আমাদের ৪ জন শিক্ষার্থীকে পিএইচডি করারও সুযোগ দিয়েছে। আশার কথা হলো, আমাদের নার্সরা অনেক সচেতন। তাঁরা নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য নিজ উদ্যোগেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ৩০০ জন মাস্টার্স করেছেন।

আমাদের ইনস্টিটিউটগুলোয় যেসব অভিজ্ঞ নার্স ও মিডওয়াইফ রয়েছেন, তাঁদের সেখানেই রাখার ব্যবস্থা করছি। যেন আমরা ভবিষ্যতে ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারি। সবার সহায়তা নিয়ে আমরা বিশ্বমানের একটি কারিকুলাম তৈরি করেছি। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছি। অস্ট্রেলিয়া, লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের কাছে নার্স প্রেরণের জন্য অনুরোধ আসে।

আমাদের অনেক অভিজ্ঞ নার্স রয়েছেন। যাঁরা সবাই বিদেশে যাওয়ার উপযুক্ত। আমরা তাঁদের এখনই বাইরে পাঠাচ্ছি না।

এসডিজির লক্ষ্য পূরণের জন্য নার্সের পাশাপাশি অভিজ্ঞ মিডওয়াইফেরও প্রয়োজন রয়েছে। নার্সের তুলনায় আমাদের দেশে মিডওয়াইফের সংখ্যা অনেক কম। আমাদের দেশে মিডওয়াইফারি সেবা এখন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

আমরা বিশ্বাস করি, ধীরে ধীরে এটি নার্সিংয়ের মতো পূর্ণাঙ্গতা পাবে। সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় মিডওয়াইফারি প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজেরা সেখানে পরিদর্শনে গিয়েছি। তাদের কারিকুলামে তারা মিডওয়াইফারি শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখছে। কিন্তু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে অভিযোগ এসেছে, তারা গুণগত মান রক্ষা করছে না। আমরা গুণগত মান রাখার চেষ্টা করছি।

আব্দুল কাইয়ুম
আমাদের দেশে এখনো অধিকাংশ মানুষ মিডওয়াইফের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। তারা ভাবে, চিকিৎসক ছাড়া চলবে না। অথচ ডেলিভারির ক্ষেত্রে মিডওয়াইফই প্রধান ভূমিকা রাখতে পারেন। কারণ, তাঁরাই ভালো বুঝবেন কখন কী করতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি যদি আরেকটু সহজলভ্য করা যায়, তাহলে সবাই এর সেবা গ্রহণ করবে। আর বর্তমানে আমাদের অবকাঠামো যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। তাই যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রসূতি মাকে উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়, তাহলে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হয়।

আজকের আলোচনা থেকে আমরা বিষয়টি বুঝতে পেরেছি যে দক্ষ মিডওয়াইফ গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জন্মদানের ক্ষেত্রে মানসম্মত লেবার রুম থাকা জরুরি। বাসায় জন্মদানের ক্ষেত্রেও যদি দক্ষ মিডওয়াইফ যেতে পারেন, তাহলে অসুবিধা হয় না। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সাবইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।