জনতুষ্টিবাদীরা গুরু মানছে পুতিনকে

ভ্লাদিমির পুতিন।
ভ্লাদিমির পুতিন।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনকে সামনে রেখে ইউরোপের দক্ষিণপন্থী নেতারা ১৮ মে মিলান শহরে এক সমাবেশে মিলিত হয়েছিলেন। এসব নেতার মধ্যে ছিলেন ফ্রান্সের মারিন লো পেন, নেদারল্যান্ডসের গ্রিট ভিল্ডার্সসহ সব কট্টর ডানপন্থী দলের নেতারা। এসব দলের প্রায় সব নেতা ইতালির ডানপন্থী নেতা ও দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী মাত্তিও সালভিনির সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ইউরোপিয়ান অ্যালায়েন্স অব পিপল অ্যান্ড নেশনস নামের একটি জোট গঠনে সালভিনি যে পরিকল্পনা করেছিলেন, তাতে তাঁরা সমর্থন দিয়েছিলেন।

মিলানের সমাবেশে সালভিনি জনতুষ্টিবাদীদের চাঙা করা বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে তিনি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের আসন্ন নির্বাচনকে ‘বহু বছর ধরে উৎপীড়কদের হাতে নিষ্পেষিত হওয়া মহাদেশকে মুক্ত করার ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায়, জার্মান চ্যান্সেলর অাঙ্গেলা ম্যার্কেল, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট জ্য ক্লদ জাঙ্কার এবং বিশ্বহিতৈষী জর্জ সোরোস ‘ইউরোপকে অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসনের মহাদেশ বানিয়ে ফেলেছেন’। পরে এক সাক্ষাৎকারে সালভিনি বলেছেন, তাঁর আশা যুক্তরাজ্যের নতুন রাজনৈতিক দল ব্রেক্সিট পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে তাঁর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবেন।

তবে সালভিনি এবং তাঁর নতুন জোট আরও একজনকে তাঁদের সহযোগী হিসেবে চাইছেন। সেই একজন হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁদের বক্তব্যের ধরন দেখে মনে হয় তাঁরা সম্মিলিতভাবে পুতিনবন্দনায় আত্মনিয়োগ করেছেন। তাঁদের বিবৃতির ভাষ্য শুনলে মনে হয় সেগুলো সরাসরি ক্রেমলিন থেকে লিখে দেওয়া। পুতিনের দাসানুদাসেরা ক্রেমলিনের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তথাকথিত ‘ওয়াশিংটনভিত্তিক ব্রাসেলসের এলিটদের’ বিরুদ্ধে অভিযোগ করেই যাচ্ছেন। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবানের অনুদারবাদের মতোই ইউরোপীয় ডানপন্থী ও ক্রেমলিনের পার্টনারশিপ ইউরোপে কট্টরপন্থাকে বিশদভাবে ছড়িয়ে দেবে। অনেক বছর ধরে আমি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে কট্টর দক্ষিণপন্থী এমপিদের রাশিয়াবিরোধী প্রস্তাবে ভোট দিতে দেখেছি। এমনকি তাঁরা গত বছর ইংল্যান্ডের সালিসবারিতে রাসায়নিক অস্ত্রের হামলা চালানোর জন্য রাশিয়ার নিন্দা করেছেন। সালভিনির লিগ পার্টির এমপিরা এবং ফারাজ ও অন্য ‘কপট দেশপ্রেমিকেরা’ ইউরোপীয় ইউনিয়নে ‘পঞ্চম ভিত্তি’ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।

সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে এই কট্টরপন্থীরা যদি বড় আকারে জয় পেতেন তাহলে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে তাঁদের ক্রেমলিনপন্থী দালালি চলতেই থাকত। ইউরোপের সাধারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পথ রুদ্ধ করে গোটা মহাদেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁরা চেষ্টা করে যেতেন। ইউরোপের কট্টর ডানপন্থী এসব নেতাকে তাঁদের ছলচাতুরীর দাম হিসেবে রাশিয়া বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে তাদের পক্ষে রুশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রপাগান্ডা চালানো হয়। ২০১৪ সাল থেকে লো পেনের দল রাশিয়ার একটি ব্যাংকের কাছ থেকে লাখ লাখ ডলার ঋণ পেয়েছে। বলা হচ্ছে, সদ্য সমাপ্ত ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে সালভিনির দলকে ৩৪ কোটি ডলার দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, রাশিয়ার দেওয়া অর্থ ও নানা ধরনের সহায়তা এবং নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ ইউরোপীয় জনতুষ্টিবাদীদের পায়ের তলার মাটিকে অনেক বেশি মজবুত করেছে। ইতালিতে দ্য লিগ ছোট দল হিসেবে জোট সরকারে যোগ দিলেও দলটি দেশের প্রভাবশালী একটি দল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। যুক্তরাজ্যে নাইজেল ফারাজ কট্টর অপর নেতা বরিস জনসন ও অন্য ব্রেক্সিটপন্থী নেতাদের সঙ্গে নিয়ে দেশকে ইইউ থেকে টেনে বের করে আনার বিষয়ে অনেকটাই সফল হয়েছেন। ফ্রান্সেও লো পেন এখন যে জায়গায় এসেছেন, তা হয়তো তাঁর কল্পনারও অতীত ছিল।

পুতিনের শিষ্যরা যে দেশেই সাফল্য পেয়েছেন, সেখানেই পুরু ভোট প্রক্রিয়ায় মেরুকরণ দেখা গেছে। ব্রেক্সিট গণভোটের পর যুক্তরাজ্যের ঐতিহ্যবাহী পার্টি সিস্টেম ভেঙে পড়েছে। সেখানে এখন পুরোদস্তুর সাংস্কৃতিক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এতে যা ক্ষতি হওয়ার তা যুক্তরাজ্যেরই হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যুক্তরাজ্য তার বসার জায়গা হারিয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জারের কথার অনুসরণে এখন বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে একসময় নিজেদের সমস্যা সমাধানে যখন ইউরোপের সহায়তা নিতে হতো, তখন তারা লন্ডনকে জানাত। কিন্তু এখন তারা লন্ডনে ফোন করে না, ফোন করে প্যারিস কিংবা বার্লিনে।

পশ্চিমা সমাজে বিভক্তি টেনে দেওয়া এবং একের বিরুদ্ধে অন্যকে শত্রুভাবাপন্ন করে তোলাই রাশিয়ার নিরাপত্তা কৌশলের প্রধান ভিত্তি। এই কৌশলটি সবাইকে বুঝতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে, এসব কৌশল দিয়ে রাশিয়া ইউরোপকে পাপেট বানাতে চায়। আন্তর্জাতিক টেবিলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পাশে নিজের আসন ধরে রাখতে হলে ইউরোপকে অবশ্যই পুতিনের রাশিয়ার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
গাই ভারহফস্টাড: বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী