ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে কট্টরবাদীরা প্রত্যাখ্যাত

ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে ইউরোপীয় জাতিসত্তার আয়না বলা হয়ে থাকে। যে ধারণা ও উদ্দেশ্য থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল, তা এখন ইউরোপের কট্টরবাদী রাজনৈতিক দলগুলো ও বর্হিশক্তির কারণে ক্রমাগত হুমকির মুখে। বিগত বছরগুলোয় ইউরোপের উত্তর থেকে দক্ষিণের দেশগুলোয় রক্ষণশীল কট্টরবাদী দলগুলোর সমর্থন ক্রমেই বেড়েছে।

অভিবাসী, শরণার্থী, বর্ণবাদী ও ইসলামবিরোধী ভাবনার দক্ষিণপন্থীরা আবার ইউরোপ ঐক্যেরও বিরোধী। দেশ চালানোর মতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো ভালো মডেল দিতে না পারলেও স্লোগানসর্বস্ব রাজনীতি দিয়ে জনগণের মন জয়ের চেষ্টা করছেন। তবে ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে কিছু দেশ ছাড়া কট্টরবাদীদের প্রত্যাখ্যান করেছে ইউরোপীয় জনগণ।

২৩ থেকে ২৬ মে ইউরোপের ২৮টি দেশের ৪০ কোটি ২৭ লাখ ভোটার আবারও পাঁচ বছরের জন্য তাঁদের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেছেন। ৭৫১ আসনবিশিষ্ট ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক ১৭৯ আসন পেয়েছে ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ধারার জোট এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫০টি আসন পেয়েছে সামাজিক গণতান্ত্রিকদের জোট, লিবারেল গণতান্ত্রিক জোট ১০৭, পরিবেশবাদী সবুজ দলের জোট ৭০, বামপন্থী দলগুলোর জোট ৪১, ইইউ রক্ষণশীল দলগুলোর জোট ৫৮, কট্টরবাদী ইউরোপীয় জাতিগুলোর জন্য মুক্তি আন্দোলন জোট ৫৬, ছোট ছোট নানা দল ২৮ ও জোট বিহীন দলগুলো পেয়েছে ৭। এবারের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মোট ভোটারের ৫০ শতাংশের বেশি ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে।

ইউরোপর নানা দেশে ঐতিহ্যবাহী পুরোনো দুই ঘরানার দল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ধারার জোট এবং সামাজিক গণতান্ত্রিকদের জোট ইইউ পার্লামেন্টে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রইলেও উভয় জোট পাঁচ বছর আগের তুলনায় কম ভোট পেয়েছে। এই পুরোনো দুই জোটের দলগুলো তাদের পুরোনো ধাঁচের রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না অথবা ভোটাররা তাদের কাছে বিকল্প রাজনীতি আশা করছেন। সেদিক থেকে জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ে সোচ্চার সবুজ জোটের রাজনীতি নতুন প্রজন্মের ভোটারদের আকর্ষণ করেছে। তারা গত পাঁচ বছরের তুলনায় দ্বিগুণ ভোট পেয়েছে। ইউরোপীয় লিবারেলদের জোটও গতবারের তুলনায় ভালো করেছে আর ইউরোপীয় বামদের জোট পাঁচ বছর আগের নির্বাচনের তুলনায় খারাপ করেছে।

ইউরোপীয় দেশগুলোর ভোটারদের প্রবণতার দেখা যাচ্ছে, ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ধারার জোট এবং সামাজিক গণতান্ত্রিক ও বাম জোটের সমর্থকেরা পরিবেশবাদী সবুজ দল বা ইউরোপীয় লিবারেল দলীয় জোটের দিকে ঝুঁকেছে। কট্টরবাদী দলগুলোর ভোট না কমলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী ভোট পেতে সমর্থ হননি। এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ২৮ দেশের অভিন্ন পার্লামেন্ট। তাই কোনো কোনো দেশে দক্ষিণপন্থীরা বেশি ভোট পেলেও হিসাব করতে হবে ২৮ দেশের ভোটের সম্মিলিত প্রাপ্তি। সেই হিসাবে গত পাঁচ বছরের মতো ইইউপন্থীরাই ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে থাকছেন।

বিগত বছরগুলোয় জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ইতালি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোয় দক্ষিণপন্থী দলগুলো দেশগুলোর জাতীয় নির্বাচনগুলোয় ভালো ফল করেছিল। ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, পোল্যান্ড, বেলজিয়ামে, হাঙ্গেরিতে বেশি ভোট পেলেও অন্যত্র ভোটাররা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বিগত পাঁচ বছরের মতো এবারও ইইউ পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ রইবে ইউরোপপন্থীদের হাতে।

ইইউ জোট থেকে এই বছর ৩১ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের চলে যাওয়ার কথা রইলেও নানা কৌশলগত কারণে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য এখন ইইউ জোটের সদস্য। তাই যুক্তরাজ্যের জনগণও ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তবে সেখানেও কট্টরবাদী নাইজেল ফারাজের নবগঠিত ইইউবিরোধী বর্ণবাদী ব্রেক্সিট পার্টি ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছে। ফ্রান্সে জাতীয়তাবাদী দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট নেত্রী মেরি ল পেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর এন ম্যার্শে আন্দোলনের থেকে বেশি ভোট পেয়েছে। ইতালি, বেলজিয়াম ও পোল্যান্ডেও কট্টর ও জাতীয়তাবাদী দলগুলো বেশি ভোট পেয়েছে।

ইউরোপের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের ক্রমাগত উত্থান হিসেবে দেখা দিলেও ২০১৯ সালে ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া বা সুইডেনের জাতীয় নির্বাচনগুলোয় তাঁরা ক্ষমতা ভাগাভাগি করার মতো আসন পাননি। সর্বশেষ অস্ট্রিয়ার রক্ষণশীল দলের ভিডিও ফাঁস কেলেঙ্কারি ও ক্ষমতাসীন জোট থেকে কট্টরবাদী ফ্রিডম পার্টির সদস্যদের পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার মতো ঘটনা কিছুটা হলেও কট্টরবাদীদের স্লোগানসর্বস্ব রাজনীতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে ইউরোপের কট্টর জাতীয়তাবাদী দলগুলোকে অর্থায়নের জন্য মস্কোকে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি কিছু বৈদেশিক শক্তি ইইউ জোটে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করার কথা এবং এই প্রথম ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইউরোপের কট্টর জাতীয়তাবাদী দলগুলোকে অর্থায়নের জন্য রাশিয়া সাহায্য করছেন বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া নানা রকম ইইউবিরোধী ষড়যন্ত্রের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সচিব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টা স্টিভ ব্যাননকেও তিনি দায়ী করেছেন। তিনি ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট নেত্রী মেরি লে পেন এবং ইতালির জাতীয়তাবাদী দল লেগা নর্ড দলের নেতা মাতিও সালভানির সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়ে অভিযোগ করেছেন।

যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা এই উপমহাদেশীয় ঐক্যবদ্ধতাকে আরও এগিয়ে নিতে চাইছেন, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রতিক কালের ইইউ জোটবিরোধী কট্টর জাতীয়তাবাদী দলগুলো। এবারের নির্বাচনে ধারণা করা হয়েছিল, ইউরোপের সর্বত্র দক্ষিণপন্থী কট্টরবাদীরা আরও শক্তিমত্তা নিয়ে অভিভূত হবে। কিন্তু ইউরোপীয় ভোটাররা কয়েকটি দেশ ছাড়া বেশির ভাগ দেশে দক্ষিণপন্থীদের রুখে দিয়েছে।

ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ইউরোপে যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কৃতি তথা মহাদেশীয় পার্লামেন্টারি প্রথা গড়ে তুলেছে, তা বিশ্বের কাছে সর্বদা দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
[email protected]