চোখে স্বপ্ন থাকুক, মাথায় বাস্তবতা

লন্ডনে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ট্রফি উন্মোচন
লন্ডনে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ট্রফি উন্মোচন

‘বিশ্বকাপ’ কথাটাকে আক্ষরিক অর্থে ধরলে শুধু একটি খেলার বিশ্বকাপকেই সেই মর্যাদা দেওয়া যায়। সেটি যে ক্রিকেট নয়, বলাই বাহুল্য। ক্রিকেটের ‘বিশ্ব’ অনেক ছোট। যদিও কাগজে-কলমে আইসিসির সদস্যদেশের সংখ্যা খুব কম নয়। ক্রিকেট নামের বিনি সুতোর মালায় গাঁথা ১০৫টি দেশ। কিন্তু ‘কাগজে-কলমে’ কথাটা আবারও খেয়াল করতে বলি। এই ১০৫টি দেশ আইসিসির বেঁধে দেওয়া শর্ত পূরণ করেই সদস্যপদ পেয়েছে। তবে বেশির ভাগ দেশেই তো ক্রিকেট জ্বলে টিমটিমে প্রদীপের মতো। ক্রিকেটের বিশ্বকাপের হাওয়াতেও সেই শিখায় খুব একটা কাঁপন লাগে না। হাওয়াটা যে পৌঁছেই না সেখানে!

ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মহাযজ্ঞ শুরু হওয়ার দিনে কথাগুলো খুব বেসুরো শোনাবে। ক্রিকেট উন্মাদনার এই দেশে তো আরও বেশি। কিন্তু সত্যি তো এটাই যে, শুধু একটি খেলার বিশ্বকাপেই সত্যিকার অর্থে পুরো বিশ্ব কাঁপে। সেই খেলাটির নাম অনুমান করার জন্য কোনো পুরস্কার নেই। কারণ কে না জানে, ফুটবল, শুধু ফুটবলই ‘বিশ্বকাপ’ কথাটার আক্ষরিক অনুবাদকে সত্যি করে তোলার দাবি করতে পারে। প্রমাণ দিতে যাওয়ার কোনো অর্থই হয় না। বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্ব থেকে আলোকবর্ষ দূরত্বের বাংলাদেশে বসেও কি আমরা টের পাই না সেই কাঁপন! কোথাকার কোন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকায় অদৃশ্য করে দিই না এ দেশের আকাশ।

একটু অন্যভাবে দেখলে আমরা নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতেই পারি। আমাদের বিশ্বকাপ ক্রিকেট তো আছেই, আছে বিশ্বকাপ ফুটবলও। নিজেরা না থেকেও আমরা বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলি, তর্কে-ঝগড়ায় পরীক্ষা নিয়ে নিই দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের। আবেগের সবগুলো রংই দেখা হয়ে যায় বিশ্বকাপ ফুটবলের ওই এক মাসে। ১৯৯৯ সালের আগে বিশ্বকাপ ক্রিকেটও আমাদের জন্য এমনই ছিল। অন্য সব দেশ খেলবে, আর আমরা তাদের সমর্থন করে অকারণে ঝগড়াঝাঁটি করব। ২০ বছর আগে ইংল্যান্ডে সর্বশেষ বিশ্বকাপ ক্রিকেটেই প্রথম বদলে গেল সেই ছবিটা। দর্শকের সারি থেকে এক লাফে বাংলাদেশও যেদিন থেকে অংশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের। নিজেদের দেশই খেলে, অন্য দেশকে নিয়ে তাই মাতামাতির সময় কই! এর আগে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন চোখে আইসিসি ট্রফিতে অংশ নেওয়ার সময়টার একটা সারসংক্ষেপ করে কবি নির্মলেন্দু গুণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক সেটির একটা শিরোনামও দিয়ে দেওয়া যায়—বিশ্বকাপ, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো!

সেই ১৯৯৯ থেকে এই ২০১৯। বাংলাদেশের এটি ষষ্ঠ বিশ্বকাপ। আগের পাঁচটি বিশ্বকাপ বিপরীতমুখী সব আবেগের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এ দেশের মানুষকে। যেগুলো আবার অদ্ভুত একটা ক্রম মেনে চলেছে। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানকে হারিয়ে স্মরণীয় অভিষেক। চার বছর পরের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপটাই আবার রীতিমতো দুঃস্বপ্ন। এরপরও ‘একটা ভালো-একটা খারাপ’—এই রীতিই মেনে চলেছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ। সেই হিসাবে এবার যা হওয়ার কথা, তা বললে তেড়ে মারতে আসবেন অনেকে। আশার বেলুনটা যে এমনই ফুলেফেঁপে উঠেছে। এই প্রথম বাংলাদেশ বিশ্বকাপ-যাত্রা ‘বড় কিছু’র আশায়। সেই বড় কিছুর সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম। তবে ‘কমপক্ষে সেমিফাইনাল’ কথাটা মোটামুটি কমন পাওয়া যাচ্ছে। এর পরের অংশটুকু সবাই মুখে না বললেও মনে সবার ঠিকই আছে। সেমিফাইনালে উঠতে পারলে তো আর শুধুই দুটি ম্যাচের মামলা। ১৪ জুলাই লর্ডসের ব্যালকনিতে বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরা মাশরাফি বিন মুর্তজাকেও তাই দিব্যচক্ষে দেখে ফেলছেন অনেকে। সেই কল্পনায় কতটা বাস্তবতা আর কতটা ভাবাবেগ, এই আলোচনায় পরে আসি। আপাতত সত্যি এটাই, এর আগে আর কোনো বিশ্বকাপ বাংলাদেশের ক্রিকেটপাগল জনতাকে এমন কিছু ভাবার দুঃসাহস উপহার দেয়নি।

উন্মাদনার বিচারে ২০১১ বিশ্বকাপ তারপরও সবার ওপরেই থাকবে। সহ-আয়োজক হওয়ার সুবাদে সেবারের বিশ্বকাপ-উন্মাদনা আকাশ ছুঁয়েছিল। সেটির তুল্য কিছু আবার দেখতে হলে আবার বাংলাদেশে বিশ্বকাপ হতে হবে। তবে সেবার চাওয়াটা বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণই ছিল। দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা। সে সময়ের ফরম্যাটে দ্বিতীয় রাউন্ড মানে ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল। তিনটি ম্যাচ জিতেও সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি দুটি ম্যাচে ভরাডুবি হওয়ায়। মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই দুটি ম্যাচই বাংলাদেশের নেট রানরেটের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। যেটি হয়ে উঠেছিল গ্রুপ পর্যায় থেকে পরের রাউন্ডে ওঠার নির্ধারকও।

নিজেদের দেশে খেলেও ২০১১ বিশ্বকাপে সোনার হরিণ হয়ে যাওয়া সেই কোয়ার্টার ফাইনাল ধরা দিয়েছে পরের বিশ্বকাপে। এবার এক লাফে সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন দেখার কারণ শুধু এটাই নয়। এই বিশ্বকাপে যে দ্বিতীয় রাউন্ড বা কোয়ার্টার ফাইনাল বলতে কিছু নেই-ই। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিশ্বকাপ ক্রিকেট আবার ফিরে গেছে ২৭ বছর আগে। ১৯৯২ সালের ফরম্যাটে। যেটিতে রাউন্ড রবিন লিগের প্রথম পর্বে সবার সঙ্গে সবার খেলা। এরপর শীর্ষ চার দল আলাদা হয়ে যাবে শেষ চারে—অর্থাৎ সেমিফাইনালে। ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে এটিই হয়তো ঠিক। সেরা দলের হাতে ট্রফি ওঠার মোটামুটি একটা নিশ্চয়তাও। কিন্তু বাংলাদেশের কাজটা তাতে একটু কঠিনই হয়ে গেছে। ক্রিকেটের সর্বশেষ দুটি বৈশ্বিক আসরের কথা একটু স্মরণ করুন বা আরেকটু পিছিয়ে গিয়ে ২০০৭ বিশ্বকাপ। ২০০৭ বিশ্বকাপের সুপার এইট, ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল—বাংলাদেশের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকা তিনটি সাফল্যের ভিত্তিই একটি মাত্র ‘বড়’ জয়।

হ্যাঁ ভাই, জয়েরও বড়-ছোট থাকে। সরলীকৃত সংজ্ঞায় ‘বড় জয়’ বলতে যদি আমরা র‍্যাঙ্কিংয়ে ওপরে থাকা দলের বিপক্ষে জয়কে ধরি, এখানে বাংলাদেশের ওপরে আছে ছয়টি দল। যে দলগুলোর বিপক্ষে একটি জয় তো নয়ই, দুটি জয়ও সেমিফাইনালের দরজা খোলার ‘খুল যা সিম সিম’ মন্ত্র হবে কি না সন্দেহ! খেলা তো আর র‍্যাঙ্কিং মেনে হয় না। বিশ্বকাপের ১০ দলের মধ্যে র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের নিচে যে তিনটি দেশ—ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান—তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়টাও তাই পূর্বনির্ধারিত বলে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। স্বপ্ন দেখার সময় বাস্তবতাটাও তাই মাথায় রাখা জরুরি।

সেটির ধার কেউ ধারছে বলে মনে হচ্ছে না। না ধারলেই বা কী আসে যায়! কবীর সুমনের গান ধার করে বলি, ‘কার তাতে কী, আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি!’ আর বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপে স্বপ্ন দেখবে না তো কবে দেখবে! সন্দেহাতীতভাবে মাশরাফির এই দলটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে একটা ক্ষেত্রে তো ছাপিয়ে গেছে বাকি সব দলকেও। চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে—এমন চারজন খেলোয়াড় আর কোনো দলেই নেই। র‍্যাঙ্কিংয়ে ওপরের ছয় দলের মধ্যে সব কটির বিপক্ষেই জয় আছে। চারটির বিপক্ষে তো বিশ্বকাপেই। বাইরে শুধু অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড। অথচ আফগানিস্তানকে বাদ দিলে এই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই সম্ভবত সবচেয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাঠে নামবে বাংলাদেশ। কিউই দেশে সফরগুলো যতই দুঃস্বপ্নের কোলাজ হয়ে থাকুক, র‍্যাঙ্কিংয়ে ওপরে থাকা আর কোনো দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের এত সুখস্মৃতি নেই। যেগুলোর মধ্যে স্মরণীয়তমটি এই ইংল্যান্ডের মাঠেই, দুই বছর আগের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে। কাকতালীয়ই বলতে হবে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র জয়টিও কিনা এই ইংল্যান্ডেই!

এসব বলে কী লাভ! খেলায় প্রতিটি দিনই যেখানে নতুন, অতীত সেখানে বড় কোনো অর্থ বহন করে না। তবে অনুপ্রেরণা খুঁজতে মানুষ ঠিকই ফিরে তাকায় অতীতে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাস জানতে যদি অতীতে ফিরে তাকাই, সেটির অর্থ অবশ্যই ভিন্ন হবে। ক্রিকেটের বিশ্বযজ্ঞ কোথা থেকে কোথায় এসেছে—জানা হয়ে যাবে সেই রোমাঞ্চকর ইতিহাস। যার অনেক কিছুই এখন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। এর মধ্যে একটা হলো, ১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার সময়ও কেউ নিশ্চিত ছিলেন না, এটা নিয়মিত আয়োজনে রূপ নেবে কি না। অনেক দিনই দেড় মাসের ‘ম্যারাথনে’ পরিণত হওয়া বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম আসরটি যে ‘স্প্রিন্টের’ গতিতে মাত্র ১৫ দিনে শেষ হয়ে গিয়েছিল—এটাও তো এখন অবিশ্বাস্য লাগে। উদ্বোধনী দিনে চার মাঠে চারটি ম্যাচও কি তাই-ই নয়! ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত পরের দুটি বিশ্বকাপেও উদ্বোধনী দিনে চারটি ম্যাচ। টেলিভিশনে সম্প্রচার তখনো খেলার এমন অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠেনি, সেটির সূত্র ধরে খেলাও হয়ে ওঠেনি এমন বাণিজ্য। যে কারণে প্রথম বিশ্বকাপ থেকে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৯৮ পাউন্ড অর্থযোগই ছিল অনেক বড় ব্যাপার। এর সবই এসেছিল গেটমানি থেকে। আর এখন গেটমানি বিশ্বকাপের আয়-ব্যয়ের হিসাবের তলায় পড়ে থাকে। এই বিশ্বকাপে প্রাইজমানিই তো প্রায় ৭৯ লাখ পাউন্ড। এটি যে টেলিভিশন স্বত্ব আর স্পনসরশিপ খাতে আইসিসির আয়ের ক্ষুদ্রাংশ মাত্র, সেটি না বললেও চলে।

জানা না থাকলে আরেকটি তথ্যও আপনাকে চমকে দিতে পারে। ছেলেদের প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের দুই বছর আগেই কিন্তু মেয়েদের বিশ্বকাপ হয়ে গেছে। উপমহাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম আয়োজন ১৯৮৭ সালে—এই তথ্যটার মধ্যেও যেমন একটু গোলমাল আছে। উপমহাদেশ তো প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট দেখে ফেলেছে সেই ১৯৭৮ সালেই। যখন ভারতে আয়োজিত হয়েছিল মেয়েদের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের দ্বিতীয় আসর। সেটি নীরবেই শুরু হয়ে নীরবেই শেষ হয়ে গেছে।

ক্রিকেটের বিশ্ব যতই ছোট হোক, ছেলেদের বিশ্বকাপের সেটি হওয়ার উপায় নেই। এখন তো আরও নয়। পাক্কা দেড় মাসের সেই ক্রিকেট উৎসব শুরুর দিনে জিম্বাবুয়ে আর আয়ারল্যান্ডের কথা ভেবে আমার দুটি দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। ১৯৮৩ সালে সহযোগী সদস্যদেশ হিসেবে প্রথম খেলার পর আর কখনো বিশ্বকাপে দর্শক হয়ে থাকেনি জিম্বাবুয়ে। আয়ারল্যান্ড গত তিনটি বিশ্বকাপেই খেলেছে এবং তিনটিতেই বড় অঘটন ঘটিয়েছে। অথচ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর প্রথম বিশ্বকাপেই আইরিশরা দর্শক!

ক্রিকেট বিশ্বকাপের ‘বিশ্ব’ শব্দটা নিয়ে প্রশ্ন তো আর এমনিতেই উঠছে না।

উৎপল শুভ্র ক্রীড়া সাংবাদিক