স্বাস্থ্য ক্যাডারে পদোন্নতির মরীচিকা

সম্প্রতি রংপুর মেডিকেল কলেজে পদোন্নতিবিহীন ১৭ বছর একই পদে থাকা স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘বেতনের টাকাটা না হলে বেঁচে থাকা কঠিন, তাই কষ্ট চেপে চাকরি করি। তা না হলে কবে চাকরি ছেড়ে দিতাম!’ অনেক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জীবনে একটি মাত্র পদোন্নতি নিয়ে, কেউ কেউ পদোন্নতি ছাড়াই স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদানকৃত পদ থেকে অবসরে যান।

রাষ্ট্রায়ত্ত এক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি ব্যাংকে জুনিয়র ক্লার্ক হিসেবে চাকরিতে ঢুকেছেন এবং ২০০৯ সালে সিনিয়র ক্লার্ক হয়েছেন। এরপর তিনি জুনিয়র অফিসার হয়েছেন। আরও পদোন্নতি পেয়ে অফিসার হয়েছেন। এখন তিনি সিনিয়র অফিসার। আশা করছেন দ্রুতই প্রিন্সিপাল অফিসার হবেন। তিনি বাকি জীবনে আরও দুটি পদোন্নতি পেয়ে এজিএম পর্যন্ত হবেন বলেই আশাবাদী। তিনি জানালেন,Ñযদি তিনি এজিএম হতে পারেন, তাহলে সুদমুক্ত প্রায় ৩০ লাখ টাকা ঋণ পাবেন গাড়ি কেনার জন্য এবং প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা এককালীন পাবেন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। স্বল্প সুদে গৃহঋণ তো আছেই। চতুর্থ শ্রেণির পদে যোগদান করলেও তিনি চাকরির নিয়ম অনুযায়ী একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার চেয়ে মর্যাদায় অনেক বড় হবেন। ওই ব্যাংকে গোডাউন চৌকিদার হিসেবে যোগদান করে প্রিন্সিপাল অফিসার হয়েছেন এমনও নজির আছে। তিনিও পদ বিবেচনায় পদোন্নতিহীন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অনেক ওপরে। এসব শুনে মনে হলোÑস্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তার চেয়ে সরকারি চাকরিতে ব্যাংকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে গোডাউন চৌকিদার কিংবা জুনিয়র ক্লার্কের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। প্রশাসনের অনেক বিভাগে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী পদোন্নতি পেয়ে পদোন্নতি বঞ্চিত স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তার চেয়ে বড় পদে উন্নীত হচ্ছেন। মেডিকেল কলেজেও কর্মচারীরা পদোন্নতি পেয়ে কর্মকর্তা হচ্ছেন।

স্বাস্থ্য ক্যাডার ছাড়া এমন কোনো বিসিএস ক্যাডার নেই, যেখানে পদোন্নতির জন্য নিয়োগের শর্তের যোগ্যতার চেয়ে অতিরিক্ত ডিগ্রির প্রয়োজন হয়। সব ক্যাডারের মতো বিভাগীয় পরীক্ষা, ফাউন্ডেশন কোর্স, সিনিয়র স্কেল পাস করলেই স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হয় না। স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তার ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন হয়। আবার ডিগ্রি হলেই যে যথাসময়ে পদোন্নতি হবে, তা–ও নয়।

১৪-১৬ বছর স্কুলিং নিয়ে যেকোনো ক্যাডারের কর্মকর্তা জীবনের সব পদোন্নতি লাভ করেন। স্বাস্থ্য ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা এমফিল, পিএইচডি, এফসিপিএস, এফআরসিএসসহ অনেক বড় বড় ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর ১৮-২৩ বছরের স্কুলিং নিয়ে হয়তো শেষ জীবনে একবার পদোন্নতি পান, অনেকে সারা জীবন পদোন্নতিহীন থাকেন। যাঁরা সব কটি পদোন্নতি পান এমন সৌভাগ্যবানদের সংখ্যা মোট চিকিৎসা কর্মকতার তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।

পদোন্নতি বঞ্চিত চিকিৎসকেরা অনেকেই মনস্তাপে ভোগেন। দিনের পর দিন একই পদে চাকরি করার যন্ত্রণা তিনিই বোঝেন, যিনি করেন। এদের মধ্যে একদল চিকিৎসক দিন–রাত শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য ছুটতে থাকেন। ভুলে থাকেন কর্মক্ষেত্রের সব অপমান। অন্য আরেক দল চিকিৎসক বীতশ্রদ্ধ এবং বিষণ্ণ মনে কেবল সেবা দেন।

আমাদের কয়েক ধরনের চিকিৎসক সরকারি খাতে সেবা দেন। ক্লিনিক্যাল, প্যারা-ক্লিনিক্যাল, নন-ক্লিনিক্যাল ও প্রশাসনিক। যাঁরা ক্লিনিক্যিাল ধারায় যেতে চান, তাঁদের পদোন্নতি হয় ধীরে। যাঁরা প্যারা-ক্লিনিক্যাল, তাঁদের পদোন্নতি আরও ধীরে হয়। যাঁরা নন-ক্লিনিক্যাল বিষয়ে শিক্ষকতা করেন, তাঁদের পদোন্নতি তুলনামূলক আরও কম। এঁদের সবার পদোন্নতির জন্য অতিরিক্ত ডিগ্রি থাকলেও যথাসময়ে পদোন্নতি হয় না। আর যাঁরা প্রশাসনিক পদে পদোন্নতি চান, তাঁদের পদোন্নতিতে কোনো ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না। তাঁরাই কিছুটা পদোন্নতি পান। যাঁরা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন, তাঁদের ডিগ্রিটাই যেন একটা মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বেসিক বিষয়ের চিকিৎসকদের জন্য নন–প্র্যাকটিসিং অ্যালাউন্স চালুর বিয়টি মন্ত্রণালয়ে ঝুলে আছে দিনের পর দিন। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন কাঠামোতে চাকরির পদোন্নতি ব্যতিরেকে একই পদে ১০ বছর পূর্তিতে পরবর্তী গ্রেডে এবং ১৬ বছর পূর্তিতে আরও একবার তারও পরবর্তী গ্রেডে বেতন পাওয়ার কথা থাকলেও চিকিৎসকদের তা মেলেনি।

স্বাস্থ্য ক্যাডারে যে সামান্য পদোন্নতি হচ্ছে সেখানেও অনিয়মে ভরা। বিভাগীয় পরীক্ষা, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় পাস না করেই তাঁরা স্থায়ী হচ্ছেন এবং পদোন্নতি পাচ্ছেন। দীর্ঘদিন পর নন-ক্লিনিক্যাল বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে একটি পদোন্নতি হয়েছে। সেখানে অনেক অ্যাডহক/প্রকল্পে নিয়োগকৃতরা পদোন্নতি পেয়েছেন। জানা গেছে, এসব জটিলতার কারণে কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের পদোন্নতি আটকে আছে।

বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বিভিন্ন ক্যাডারে এখন পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে আর পদোন্নতি হয় না। একই বিসিএসে উত্তীর্ণ একই ক্যাডারের সবাই একসঙ্গে পদোন্নতি পান। এটি ভালো নিয়ম। দুঃখজনক যে এই নিয়মটিও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য চালু করা হয়নি।

সরকার চাইলে সব ক্যাডারের পদোন্নতিতে সমতা ফেরানো সম্ভব। যখন যততম বিসিএসের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হবে, শর্ত পূরণ করা থাকলে সরকার ওই বিসিএসের কর্মকর্তাদের একই দিনে পদোন্নতি দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সামান্য পরিবর্তন আনতে হবে। সব ধরনের চিকিৎসকদের জন্য একটি সাধারণ পদক্রম থাকবে। পরবর্তী সময়ে যাঁরা যে বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করবেন, তাঁরা সেসব বিভাগে ন্যস্ত হবেন। পদক্রমগুলো হতে পারে মেডিকেল অফিসার, সিনিয়র সহকারী মেডিকেল অফিসার, যুগ্ম মেডিকেল অফিসার, সিনিয়র মেডিকেল অফিসার। পদগুলোর আরও উপযুক্ত নাম হতে পারে। এই পদোন্নতির জন্য কোনো অতিরিক্ত ডিগ্রির প্রয়োজন হবে না। তাহলে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তাই যেমন পদোন্নতি বঞ্চিত হবেন না, একই সঙ্গে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। আন্তক্যাডার বৈষম্য এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দূর করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক।