উন্নয়নে আঞ্চলিক বৈষম্য

সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) আঞ্চলিক উন্নয়নবৈষম্যের একটি ভয়ানক চিত্র পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) গবেষণাটি বাজেট অধিবেশন সামনে রেখে প্রকাশিত হওয়ায় আমরা আশা করতে পারি যে নীতিনির্ধারকেরা দেখেও না দেখা, জেনেও না জানার ভান করবেন না। সরকারের প্রকাশনায় উল্লিখিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই বৈষম্যগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে বিষয়টিতে শুধু বৈষম্যের প্রশ্ন জড়িত নয়। এর আড়ালে রয়েছে স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাত ও দুর্নীতিগ্রস্ত মানসিকতা। সর্বোপরি এই উন্নয়ননীতি সুশাসনের প্রতি বিরাট হুমকি বয়ে এনেছে।

ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গোপালগঞ্জ মোট এডিপির ৩৭ শতাংশ বরাদ্দ পাবে, এর পক্ষে কোনো সাফাই গাওয়া সম্ভব নয়। এটা কালক্রমে দেশে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করছে কি না, সেটা ভেবে আমরা উদ্বিগ্ন। বিশ্বের বহু দেশের জাতীয় জীবনে আঞ্চলিকতাবাদ একটি গুরুতর সমস্যা। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যেসব কারণে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধে, তার মধ্যে একচোখা উন্নয়ননীতি বড় ভূমিকা রাখে। কোনো কোনো অঞ্চলকে পদ্ধতিগতভাবে পিছিয়ে রাখার নীতি অনুসরণ থেকে আঞ্চলিক পর্যায়ে বঞ্চনার অনুভূতি ও ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়ে।

উন্নত দেশের থেকেও বাংলাদেশে অতি ধনী বৃদ্ধির দ্রুত হার, দেশের শীর্ষ ৫ শতাংশ ধনীর সম্পদ ১২১ গুণ বেড়ে যাওয়া এবং সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশের কাছে থাকা মাত্র ১ শতাংশ সম্পদও হ্রাস পেয়ে চার ভাগের এক ভাগেরও নিচে নেমে আসার সঙ্গে সরকারের এ ধরনের একচোখা এবং খামখেয়ালিপূর্ণ উন্নয়ন-দর্শনের যোগসূত্র নাকচ করা যাবে না।

দেশে কলকারখানা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, তার মধ্যে উন্নয়নবৈষম্য কতটা ভূমিকা রাখছে, সেটা খতিয়ে দেখা গুরুত্বপূর্ণ। বছরে ৮ লাখ করে বেকার বেড়ে যাওয়া যে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতির জন্য বিরাট হুমকি—এই সত্য জেনেও সরকার যদি সে অনুযায়ী পরিকল্পনা নিতে না পারে, তবে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক।

সরকারি নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় কুড়িগ্রামের মতো এলাকাগুলো থেকে ‘মঙ্গা’ দূর করতে পেরে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। কিন্তু কুড়িগ্রাম আজও সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে দারিদ্র্যের এলাকা হিসেবেই চিহ্নিত। আরও রূঢ় বাস্তবতা হলো উন্নয়ন বরাদ্দের ১ শতাংশও পাচ্ছে না রংপুর বিভাগ। এই বঞ্চনা পরিষ্কারভাবে সেখানকার মানুষকে কষ্টে রেখেছে। ঢাকা ও সিলেটের চেয়ে রংপুরের দারিদ্র্যের হার তিন গুণ থাকাটাই তার প্রমাণ।

আবার বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহীতে তুলনামূলক দারিদ্র্যের হার বেশি। সুতরাং দারিদ্র্যের হার হ্রাসের সুফল সবাই সমানভাবে পায়নি। এডিপিতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ পাওয়া মাগুরা, নড়াইল ও লক্ষ্মীপুরের মানুষ নিশ্চয় বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে সুনজরে দেখলেও তারা নিজেদের পিছিয়ে থাকাটাকে সুনজরে দেখতে পারে না। দিনাজপুরে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা ৬৪ শতাংশের মানুষের জীবনে জাতীয় উন্নয়নের অর্থ ভিন্ন হতে বাধ্য।

১৯৯৫-৯৬ সালে দারিদ্র্যের হার যেখানে ৫১ শতাংশ ছিল, ২০১৭ সালে সেটা নেমে ২৮.৩ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে—এটা যদি সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়, তবে এই বৈষম্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়ও সরকারের। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে সংবিধানে স্থানীয় শাসনের রূপরেখা দিয়েছিলেন। বাহাত্তরের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।

আমরা বৈষম্য ঘোচাতে বিআইপির সুপারিশমালা বাস্তবায়নের দাবি জানাই। বিশেষ করে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এ বিষয়ে অবিলম্বে একটি ব্যাখ্যা দরকার। বাজেট প্রণয়ন ও প্রকল্প অনুমোদনে অঞ্চলভিত্তিক সাম্যের ধারণা ও বাজেট বরাদ্দে তার প্রতিফলন এবং প্রতিবছর বিভাগ ও জেলাভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশের দাবি জানাই।