বিনোদন বিকাশে নতুন মাত্রা 'ঈদ ট্যুরিজম'

পাহাড়ের গায়ে মেঘ-বৃষ্টির খেলা উপভোগ করছেন দর্শনার্থীরা। সিলেটের বিছনাকান্দি। (ফাইল ছবি)
পাহাড়ের গায়ে মেঘ-বৃষ্টির খেলা উপভোগ করছেন দর্শনার্থীরা। সিলেটের বিছনাকান্দি। (ফাইল ছবি)

পবিত্র রমজান মাস এলেই মুসলমান সম্প্রদায়ের সিয়াম সাধনার পাশাপাশি ঈদ ঘিরে শুরু হয় নানা রকম পরিকল্পনা। ঈদের আনন্দে একাকার হয়ে যায় এ দেশের মানুষ। নানা রকম কৃষ্টি-কালচার এ দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে এসেছে এক সম্প্রীতির বিন্দুতে।

ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের ভ্রমণপ্রবণতা এবং নানা রকম বিনোদন কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবই ফেস্টিভ্যাল ট্যুরিজমের অন্তর্গত, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির ধারক বিধায় বেড়েছে মানুষের কর্মব্যস্ততা, আয়, সেই সঙ্গে বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। মানুষ আজকাল বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে দূরদূরান্ত থেকে একত্র হয়। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঈদ সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় অবকাশ যাপনের মাধ্যম। ঈদের ছুটিতে শহর শূন্য হয়ে যায়, গ্রাম হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে ঈদ কাটানোর উদ্দেশ্যে শহুরের কৃত্রিম ব্যস্ততা ঘেরা পরিবেশ ছেড়ে নাড়ির টানে বাড়ি ছুটে আসে। বিশেষ করে ঈদের সময় মানুষের ভ্রমণের জন্য একটা আলাদা বাজেট তৈরি হয়ে যায়। অনেকেই ঈদের ছুটিতে দেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান।

অর্থনৈতিক বিবেচনায়, ঈদে বড় রকমের আর্থিক লেনদেনের বৃদ্ধি পায়, যা আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ। ঈদকে কেন্দ্র করে পোশাক–পরিচ্ছদ, ঘরোয়া তৈজসপত্র, খাদ্যসামগ্রী ও উপহারসামগ্রী কেনাবেচা বাড়ে, যা অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করে। ফেস্টিভ্যাল ট্যুরিজম বিশেষ করে ঈদের বাজারে যে বিশাল চাহিদা তৈরি করে, তা সাপ্লাই-চেইনকে গতিশীল করে। উৎপাদন ও সরবরাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারীদের আয় বৃদ্ধি পায়। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক যুবকেরা চুক্তিভিত্তিক ও অস্থায়ীভাবে কাপড়ের দোকানের বিক্রেতা হিসেবে কাজ করে, এতে আয়ের একটা সুষম বণ্টনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আয়প্রবাহ সমাজের শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বেকারদের দিকে ধাবিত হয়, যা তাদের ঈদের আমেজকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। অর্জিত আয় আবার ব্যয়িত হয় পুনঃক্রয় ও ভ্রমণবিলাসে। এভাবে অর্থনৈতিক উপাদানের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়, ফলে দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য অধিক প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নানাবিধ প্রয়োজনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে থাকে, তবে বাঙালি জাতি ইতিমধ্যে ভ্রমণের প্রেমে পড়েছে বলে নান্দনিক বাংলাদেশ এখন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের ভ্রমণ গন্তব্য। আনন্দঘন পরিবেশে সময় কাটানোর জন্য দেশে এখন অনেক পর্যটন স্পট রয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের ভ্রমণে উৎসাহিত করে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম ছিল ট্র্যাক্ট অঞ্চল: বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি, বৃহত্তর সিলেট (চা–বাগান, রাতারগুল, বিছনাকান্দি ও জাফলং) ও অন্যান্য দর্শনীয় স্থানে মানুষের উপচে পড়া ভিড়।

বিভিন্ন দেশে ঈদের ছুটি পাঁচ–ছয় দিন হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে পর্যটন বৃদ্ধি পায়। যেমন ২০১৭ সালে তুরস্ক প্রায় এক বিলিয়ন লিরা আয় করেছিল ঈদ ছুটির সময়ে। ঈদের সময় মালয়েশিয়া, মিসর, আরব আমিরাত নানান রঙের প্যাকেজ নিয়ে আসে মুসলমান পর্যটকদের কাছে, যা আজ সবার কাছে অত্যন্ত সমাদৃত। তা ছাড়া ২০১৮ সালে প্রায় ৬০ লাখ পর্যটক মালয়েশিয়া ভ্রমণ করে। আর ২০১৯ সালে তাদের প্রত্যাশা ৮০ লাখ। ঈদের ছুটি বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের জন্য উত্তম মৌসুম, যার ধারাবাহিকতায় দেশীয় ট্যুর কোম্পানিগুলো দেশ-বিদেশ ভ্রমণের নানান রকম প্যাকেজ অফার করে থাকে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশি পর্যটকেরা ঈদে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড পাড়ি জমায় বলে ভারতীয় দূতাবাসকে নিয়মিত ভিসা থেকে ১.৫ থেকে ২ লাখ বেশি ভিসা ইস্যু করতে হয় এ মৌসুমে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটক ছিল প্রায় ৫ লাখ। আর ২০১৭ সালে তা ৬৫-৭০ লাখ এবং ২০১৮ সালে ৮০ লাখে পৌঁছায়। ধারণা করা যাচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখে পৌঁছাবে। বর্তমানে ১৫ লাখ জনগোষ্ঠী সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ২৩ লাখ লোক এই শিল্পে কর্মরত। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটন একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হয়ে উঠেছে এবং ধারণা করা যাচ্ছে, দেশীয় পর্যটন ২০২৪ সালের মধ্যে জিডিপিতে ৪.৭ শতাংশ অবদান রাখবে (সূত্র: WTTC)।

বিশ্বায়নের যুগে কর্মব্যস্ত জীবনে বিনোদনের বিকল্প নেই, তাই ঈদ আরও আনন্দময় করতে বাংলাদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণের সুযোগ বেড়েছে। ট্যুর অপারেটররা দেশ ও বিদেশ ভ্রমণের আকর্ষণীয় প্যাকেজ অফার করে তার মধ্যে মধ্যবিত্ত সমাজের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশের কক্সবাজার, কুয়াকাটা, বান্দরবান, রাঙামাটি, সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কুমিল্লা ছাড়াও ভারত (কলকাতা, শিমলা, মানালি), নেপাল, ভুটান। উচ্চবিত্ত শ্রেণি মানুষের পছন্দ থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, মিসর, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশ। ঈদের ছুটিতে যেহেতু পর্যটকসংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তাই বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ‘পর্যটন-ব্যবস্থাপনা’ গুরুত্ব পায়। বিনোদনপিপাসু মানুষ বাজেট প্যাকেজের সুযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে থাকে। যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে এক দিনের ভ্রমণে যেতে আগ্রহী, তাদের কাছে ঢাকার নিকটবর্তী পর্যটনকেন্দ্র পদ্মা রিসোর্ট, গাজীপুরের ঢাকা রিসোর্ট, এলেঙ্গা রিসোর্ট, ড্রিমল্যান্ড রিসোর্ট, ভাওয়াল রিসোর্ট ও নড়াইলের অরুণিমা রিসোর্ট ও গলফ ক্লাবের পর্যটক চাহিদা বেশি। অভ্যন্তরীণ পর্যটন সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন সমৃদ্ধ হবে।

পর্যটকেরা যেন নিরাপদে তাদের অবকাশ যাপন করতে পারে, সে জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ট্যুরিস্ট স্পটে র‍্যাব ও পুলিশের অতিরিক্ত নজরদারি থাকে, যা ঈদ পর্যটনের জন্য আশাব্যঞ্জক।

ভ্রমণ মানুষের চিত্ত প্রসারিত করে নানাবিধ নেতিবাচক ভাবনা থেকে দূরে রাখে। দেশীয় পর্যটন বৃদ্ধির ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি সুদৃঢ় হচ্ছে এবং বিকশিত হচ্ছে সাংস্কৃতিক ভাবনা। পর্যটনকে ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য জাতীয় পর্যটন কর্তৃপক্ষকে (BTB, BPC) আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশের পর্যটন খাত খুবই সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও পর্যটকদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার গুণগত মান নিশ্চিত করে পর্যটন খাতকে কাজে লাগিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: পর্যটন বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী অধ্যাপক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।