ধান উৎপাদনে কৃষকের সহায়তা বাড়াতে হবে: আখতার আহমেদ

ড. আখতার আহমেদ
ড. আখতার আহমেদ
>

দেশে এবার ধানের বাম্পার ফলন হলেও ধান-চালের দাম কম হওয়ায় কৃষক সংকটে পড়েছেন। এই সংকট থেকে উত্তরণ এবং ভবিষ্যতে কৃষি ও কৃষকের সুরক্ষায় করণীয় সম্পর্কে বলেছেন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) আবাসিক পরিচালক ড. আখতার আহমেদ

প্রথম আলো: ধানের দাম হঠাৎ কমে গেল কেন? কৃষকের ন্যায্য দাম পেতে হলে কী করণীয়?

আখতার আহমেদ: অর্থনীতির সাধারণ সূত্র মেনেই বাংলাদেশে ধানের দাম কমে গেছে। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়েছে। ২০১৭ সালে হাওরে বন্যার কারণে যে ঘাটতি হয়েছিল, চাল আমদানি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। ধানের দাম কমার এটিও একটি কারণ। ধানের উৎপাদন বেশি হওয়া তো ভালো। উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া সমাধান নয়। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ধান-চাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটাকে শুধু কৃষিপণ্য হিসেবে দেখলে চলবে না। এর বহুমাত্রিক গুরুত্ব আছে। এর সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। তবে সমস্যাটা জটিল। ধানের দাম কমে গেলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর চালের দাম বেড়ে গেলে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ বিপদে পড়েন। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনা প্রয়োজন।

প্রথম আলো: পৃথিবীর অন্যান্য দেশ কীভাবে এই ভারসাম্য আনে?

আখতার আহমেদ: পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে আমাদের বাস্তবতা মিলবে না। তবে ভারতের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সেখানে সরকার কৃষককে আমাদের চেয়েও বেশি ভর্তুকি দেয়। সার, বীজ থেকে শুরু করে বিদ্যুৎসহ সবকিছুতে কৃষককে ভর্তুকি দেওয়া হয়। আমরা মূলত সার ও সেচপাম্পের বিদ্যুতে ভর্তুকি দিই। ভারতের কৃষকেরা বেশি ভর্তুকি পাওয়ায় তাঁদের উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহমূল্য আমাদের চেয়ে কম। তারপরও বাংলাদেশে গত ৩০ বছরে প্রকৃত হিসাবে চালের দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রতিবছরের মূল্যস্ফীতি ধরলে চালের দাম ধারাবাহিকভাবে কমেছে।আর ধানের দাম কম হওয়ার কারণে কৃষকই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

প্রথম আলো: তাহলে এত লোকসান হওয়ার পরেও তাঁরা কেন ধান চাষ করছেন?

আখতার আহমেদ: কৃষকের জন্য এখন পর্যন্ত ধান চাষই সবচেয়ে সুবিধাজনক। কেননা, চালের দাম কমলেও একরপ্রতি ধানের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে। স্বাধীনতার পর দেশে ১ কোটি টন ধান হতো। আর এখন উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে তিন কোটি টনের মতো। অন্যদিকে এই সময়ে ধানের জমি কমেছে। বাংলাদেশে এর চেয়ে বড় কোনো সাফল্য আর নেই। এই সাফল্য এসেছে কৃষকের পরিশ্রম ও কৃষিবিজ্ঞানীদের নিত্যনতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে। আমাদের ধান উৎপাদনের কাঠামোটাও বদলে গেছে। ২০-২৫ বছর আগেও আমাদের প্রধান শস্য ছিল আমন। এখন বোরো হচ্ছে ৫৫ শতাংশ। বোরো উৎপাদন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে অনেকটা মুক্ত। আমনের সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হয়। কৃষকের ধান উৎপাদনে থাকার আরেকটি কারণ বিকল্প ফসলে ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত বেশি। ধানের দাম কমে গেলেও সেটি আলুর মতো নয়।

প্রথম আলো: এবার ধানের উৎপাদন যে বেশি হবে তা কি সরকার জানত না? তাহলে সংকট উত্তরণে কেন পদক্ষেপ নিল না?

আখতার আহমেদ: এ বছর বেশি উৎপাদন হবে, সেটা সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই জানতেন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও আমন ও বোরো ধানের বাম্পার ফলনের পূর্বাভাস দিয়েছিল। আগে থেকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিলে ভালো হতো। এখন এ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমরা প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগাতে পারি। তারা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে। সেখানে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী নেই। ওরা পারলে আমরা কেন পারব না? খাদ্য অধিদপ্তর বলছে কৃষকের ধান ভেজা, তা কেনা যায় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার ওই ভেজা ধান কেনে এবং শুকানোর ব্যবস্থা করে। আমাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পার্থক্য হচ্ছে, তারা কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনে। আমরা কিনি মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল। আমাদের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি দল পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে সরেজমিনে বিষয়টি দেখতে পারে। আমাদের চালকল মালিকেরা তো কৃষকের কাছ থেকে ভেজা ধানই কিনছেন। তাঁরা সেগুলো শুকিয়ে মিলে ভাঙান।

প্রথম আলো: আমাদের সরকারের ধান-চাল কেনার উদ্দেশ্য কী? এতে কি কৃষক লাভবান হচ্ছেন?

আখতার আহমেদ: সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে গুদামে মজুত বাড়ানো। আপত্কালীন সমস্যা মেটানোই এর উদ্দেশ্য। আর পশ্চিমবঙ্গে ধান-চাল সংগ্রহ করা হয় কৃষককে সহায়তা করার জন্য। অর্থাৎ কৃষক সহায়ক কর্মসূচি। আমাদের সরকার ধান-চালের মজুত বাড়াতে চাইলে অনেক পথ আছে। দরপত্রের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনতে পারে। সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থাপনা বদলাতে হবে। এখানে একটি কাজ করার পেছনে অনেকগুলো উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করা হয়। ফলে কোনোটাই ঠিকমতো হয় না। একটি কাজের মধ্য দিয়ে একটি উদ্দেশ্য সাধন করা উচিত। যেমন ধান-চাল সংগ্রহ করা উচিত, কৃষককে সহায়তা দেওয়ার জন্য।

প্রথম আলো: ভারতে তো ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অনেক কৃষক আত্মহত্যা করেছেন?

আখতার আহমেদ: সেখানে যেসব কৃষকের আত্মহত্যার কথা শুনি তা মূলত ঋণগ্রস্ত হওয়ার কারণে। আর তা পেঁয়াজ ও তুলাচাষিদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। কিন্তু ধানচাষিদের ক্ষেত্রে দাম না পাওয়ার ঘটনা কম।

প্রথম আলো: আমাদের ধান-চালের বিপণন ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। কৃষকের মুনাফার বড় অংশ ফড়িয়ারা নিয়ে যান বলে অভিযোগ আছে।

আখতার আহমেদ: এখানে ধান-চালের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের যেভাবে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়, তা ঠিক না। কৃষকের ধান-চাল বিপণনে তাঁদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কারণ, একযোগে ধান কাটা শুরু হওয়ার পর সরকার তো সব ধান কিনতে পারবে না। চালকল মালিকেরাও অনেক সময় কিনতে চান না। এ সময় ফড়িয়ারা ওই ধান কিনে নেন। তাঁরা ধান না কিনলে কৃষকের অবস্থা আরও খারাপ হতো। এখন বড় চালকল মালিকেরাই বেশি মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকা পালন করছেন। তাঁরা বাজার থেকে অনেক সস্তায় ধান কিনে তা বেশি দামে সরকারি গুদামে দিচ্ছেন। এতে তাঁরা বেশি মুনাফা পাচ্ছেন। সরকার বেশি ধান কিনলে চালকল মালিকদের মুনাফা কমবে এবং কৃষক লাভবান হবেন। তবে চালকল মালিকদের মধ্যেও পার্থক্য আছে। একসময় আমাদের দেশে অনেক চাতাল ছিল। তারা এখন বড় মিলগুলোর কাছে টিকতে পারছে না। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চালের বাজার বড় মিল মালিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।

প্রথম আলো: ২০১৭ সালে দেশে চালের ঘাটতি ছিল ১০ লাখ টন। আর আমদানি হলো ৪০ লাখ টন। এই বাড়তি চাল আসায় ধানের দাম কমেছে।

আখতার আহমেদ: দেশে কী পরিমাণে চাল আমদানি হচ্ছে, তার হিসাব থাকা উচিত। এত চাল আমদানি দরকার ছিল কি না। খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন কমিটি নামে একটি শক্তিশালী কমিটি আছে। তাদের দায়িত্ব বিষয়টি তদারকি করা। বেশি আমদানি দেখে মনে হচ্ছে ওই তদারকি ঠিকমতো হয়নি। এটা হওয়া উচিত।

প্রথম আলো: এখন সরকারের করণীয় কী?

আখতার আহমেদ: সরকার ধান-চাল কিনে বাজারকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারবে না। তবে কৃষকের কাছে সঠিক দামটা যাবে। ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডার মতো দেশ এমনকি জাপানও কৃষককে প্রচুর সহায়তা দেয়। বাংলাদেশেও কৃষকের উৎপাদন ব্যয় যাতে কম হয়, সে জন্য কৃষকের সহায়তা বাড়াতে হবে। তঁার কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে হবে।

প্রথম আলো: সরকারের চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত কি সঠিক?

আখতার আহমেদ: আমি মনে করি, বাংলাদেশ এখনো চাল রপ্তানির মতো জায়গায় পৌঁছায়নি। বিশ্বের চালের বাজার পাঁচটি দেশ নিয়ন্ত্রণ করে। ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও মিয়ানমার। এ অবস্থায় আমাদের পক্ষে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করা কঠিন। কারণ, আমাদের ধানের উৎপাদন স্থিতিশীল নয়। কোনো বছর ঘাটতি হয়, কোনো বছর বাড়তি উৎপাদন হয়। বিশ্ববাজারে একবার ঢুকবেন, একবার বের হয়ে যাবেন, এটা হয় না। ক্রেতারা এসব দেশ থেকে আমদানি করতে চাইবে না। তবে বেশি উৎপাদন হওয়ায় সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি করে কিছু চাল রপ্তানি হতে পারে। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। এই রকম পরিস্থিতিতে কোনো দেশ রপ্তানিতে যেতে পারে না। এ ছাড়া চালের মানও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কী চাল উৎপাদন করি তার বিশ্ববাজারে চাহিদা আছে কি না, তা–ও দেখতে হবে।

প্রথম আলো: তাহলে কৃষকের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে?

আখতার আহমেদ: ৩০ বছরে ধানের দাম অর্ধেক হয়েছে আর উৎপাদন তিন গুণ হয়েছে; এটা কিন্তু কৃষককে সহায়তা দেওয়ার কারণেই হয়েছে। সরকার শ্যালো টিউবওয়েলসহ বিভিন্ন কৃষির সহায়ক যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। কৃষি গবেষণায় আমাদের অনেক বিনিয়োগ করা হয়েছে। আমাদের ধান গবেষণায় আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) অনেক সহায়তা দিয়েছে। আমাদের এক একরে আড়াই টন উৎপাদন হচ্ছে, এটা ৫ টন করা সম্ভব। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে এবং ধানের দাম কমে গেলেও কৃষকের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। আমাদের ৭০ শতাংশ কৃষক এক থেকে দুটি ফসল উৎপাদন করেন। তাঁরা যাতে আরও বেশি ফসল উৎপাদনে যেতে পারেন, সেদিকেও নজর দিতে হবে।

প্রথম আলো: আমাদের কৃষকেরা তাহলে অন্য ফসলে কেন যাচ্ছেন না?

আখতার আহমেদ: ধান ছাড়া অন্য ফসলে কৃষকের ঝুঁকি বেশি। যেমন সবজি বা ফল। এগুলো একটু বেশি উৎপাদন হলে দাম অনেক পড়ে যায়। আপনারা দেখবেন, প্রায়ই কৃষক মাঠে টমেটো, আলু, ফুলকপি ফেলে দেন। কারণ, দাম কম। ফলের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটা দেখেছি। অন্যদিকে ধানের দাম খুব বেশি ওঠানামা করে না।

প্রথম আলো: কৃষকের নিরাপত্তায় এই মুহূর্তে সরকারের কী করা উচিত?

আখতার আহমেদ: কৃষককে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সহযোগিতা দেওয়া উচিত। তাঁদের যাতে দ্রুত ধান বিক্রি করতে না হয় সেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সংকটের সময় তাঁদের সহায়তা দেওয়া সবচেয়ে জরুরি।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আখতার আহমেদ: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।