আল্লাহর জিকিরে রোজাদারের প্রশান্তি

দেহকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখার জন্য যেমন খাবার বা আহারের প্রয়োজন, তেমনি কলব বা রুহকে জীবিত রাখার জন্যও খাবারের প্রয়োজন হয়; আর রুহ বা কলবের সেই খাবার হলো আল্লাহর জিকির করা। তাই আল্লাহর স্মরণ বা জিকিরের মাধ্যমে তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা প্রত্যেক রোজাদার মানুষের ইমানি দায়িত্ব। ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং তোমরা আমাকেই স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫২)।

একবার একজন সাহাবি আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাকে এমন একটা জিনিস শিক্ষা দিন, যার ওপর আমি রীতিমতো আমল করতে পারি।’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর জিকিরে তোমার জিহ্বা যেন সব সময় তরতাজা থাকে।’ হজরত আবু দারদা (রা.) বলেন, ‘যাদের জিহ্বা আল্লাহর জিকিরে তরতাজা থাকবে, তারা হাসতে হাসতে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি জিনিসের মরিচা পরিষ্কার করার যন্ত্র আছে আর অন্তরের মরিচা পরিষ্কার করার যন্ত্র হলো আল্লাহর জিকির করা’ (বায়হাকি)।

প্রকৃত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায়, শয়নাবস্থায় আল্লাহর জিকির করে এবং মহাকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করে। শয়তান কখনো তাদের নামাজ, রোজা ও কল্যাণকর কাজ থেকে অমনোযোগী রাখতে পারে না। রমজান মাসে জাগতিক কোনো কাজ-কারবার বা ব্যবসা-বাণিজ্য আল্লাহর প্রেমিককে তাঁর স্মরণ থেকে বিরত রাখতে পারে না।

 ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’—এ কালেমা তাইয়েবা ইসলামের মূল ভিত্তি; আর আল্লাহর জিকির বা স্মরণই সব ইবাদতের প্রাণ। রোজাদারের হৃৎপিণ্ডে ‘আল্লাহ’ শব্দটি প্রতিফলিত হয়ে পুরো দেহে-রক্তে সঞ্চালিত হয় এবং দেহকে রাখে সক্রিয়। যার জন্যই আল্লাহর জিকিরে অন্তর পরিতৃপ্ত হয় ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। যে ব্যক্তি বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করে, তার দোয়া অবশ্যই কবুল হয়ে থাকে। জিকির দোয়ায় পড়তে পারেন, ‘আল্লাহু আকবার কাবিরা, ওয়াল হামদুলিল্লাহি কাছিরা, ওয়া সুবহানাল্লাহি বুকরাতাও ওয়া আসিলা’ কিংবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু আহাদান ছামাদান লাম ইয়ালিদ ওয়ালাম ইউলাদ ওয়ালাম ইয়া কুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ’।

নবী করিম (সা.) বলেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ জিকির হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া হলো ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’। যে রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করেন, আল্লাহ তার ওপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং তিনি আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত থেকে বঞ্চিত হন না।

যেভাবে জিকির করলে আল্লাহর নেয়ামত লাভ হয়: সুনানে বায়হাকিতে বর্ণিত হয়েছে প্রিয় নবী (সা.) জিকির ও জিকিরের প্রাপ্তি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। হাদিসে এসেছে, একদিন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এক আরব বেদুইন এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমাকে কোনো একটি ভালো কাজ শিক্ষা দিন।’ নবীজি (সা.) তখন তার হাত ধরে এ শব্দগুলো পড়ার জন্য শিখিয়ে দিলেন—সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার। লোকটির হাত ধরে প্রিয় নবী (সা.) বললেন, ‘এ শব্দগুলো বেশি বেশি পড়বে।’ লোকটি এ কথা শুনে চলে গেল। কিছু দূর যাওয়ার পর লোকটি আবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে ফিরে এল এবং বলল, ‘আপনি যে বাক্যগুলো আমাকে শিখালেন, এ বাক্যগুলোতে আল্লাহর জন্য, আমার কী? এগুলো পড়ে আমি কী পাব?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বললেন, ‘তুমি যখন বলবে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, তখন প্রতিটি শব্দের উত্তরে আল্লাহ তাআলা বলবেন, “তুমি সত্য বলেছ।” জিকিরকারী আল্লাহর কাছে নিজের চাহিদাগুলো তুলে ধরবে, বান্দা বলবে, “আল্লাহুম্মাগফিরলি, হে আল্লাহ! আমাকে মাফ করে দিন।” তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, “তোমাকে মাফ করে দিলাম।” বান্দা বলবে, “আল্লাহুম্মার হামনি, হে আল্লাহ আপনি আমাকে রহম করুন। ” তখন আল্লাহ বলবেন, “ইতিমধ্যে তোমার প্রতি রহম করেছি।” বান্দা বলবে, “আল্লাহুম্মার জুক্বনি, হে আল্লাহ আপনি আমাকে রিজিক দান করুন।”
তখন আল্লাহ বলবেন, “তোমাকে ইতিমধ্যে রিজিক দান করেছি”।’

জিকিরের পরে বান্দা এভাবে আল্লাহ তাআলার কাছে যা চাইবে, আল্লাহ তাআলা তাকে অচিরেই তা দান করবেন বলে প্রিয় নবী (সা.) হাদিসে ঘোষণা দিয়েছেন।

সুতরাং বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করতে হবে। তার জিকির করে করে বান্দা নিজের একান্ত চাহিদাগুলো তাঁরই কাছে তুলে ধরবে। যারা
আল্লাহর জিকির করার পর তার কাছে কোনো কিছু চাইবে, আল্লাহ তাআলা তাকে তার কাঙ্ক্ষিত জিনিস দান করেন।

ফেরদৌস ফয়সাল: প্রথম আলোর হজ প্রতিবেদক
[email protected]