আইনটি মারা গেছে

মানুষ মারা গেলে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনেরা খবর পান। বিশিষ্ট কেউ মারা গেলে পত্রপত্রিকা আর রেডিও-টেলিভিশনে সংবাদ হয়। বিখ্যাত কেউ মারা গেলে মৃত্যুর পর শোকসভা হয়, পরবর্তী সময়ে মৃত্যুবার্ষিকীও পালন করা হয়।

দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার সময় মাঝেমধ্যে পশু-পাখির মৃত্যুর সংবাদ চোখে পড়েছিল, যেমন জনপ্রিয় কোনো সিনেমার কুকুরটা অথবা ঘোড়দৌড়ের বিখ্যাত ঘোড়া মারা যাওয়ার খবর পত্রপত্রিকায় এসেছিল। আমাদের দেশে কোনো মড়কে যখন অনেক গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি মারা যায়, সেটাও খবরে স্থান পায়।

তবে পাঠক নিশ্চয়ই আইন মারা যাওয়ার খবর শোনেননি। সাধারণত আইন মারা যায় না। একটি আইন পূর্বের আইনকে বাতিল করতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে পূর্বের আইন বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু স্রেফ আইন মারা যাওয়ার ঘটনা বিরল, আমাদের দেশে অতিশয় বিরল। কিন্তু ইদানীং আমাদের একটি আইন মারা গেছে, সে সংবাদ দিতেই এই লেখা।

যে আইনটি মারা গেছে, তার নাম ছিল ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২’। মারা গেছে বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে। মৃত্যুর সময় গত ৯ এপ্রিল। আইনটির জন্ম হয়েছিল বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। তখনকার সংসদ আইনটি পাস করে ১০ এপ্রিল ২০০২ সালে। সে সময় বলা ছিল, আইনটি কার্যকর থাকবে দুই বছরের জন্য। পরবর্তী সময়ে মেয়াদপূর্তির আগেভাগে সংশোধনী আইন করে মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল আরেকটি সংশোধনী আইনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২-এর মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ১৭ বছর। অর্থাৎ, ১০ এপ্রিল ২০০২ থেকে এ আইনের মেয়াদ ছিল ৯ এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত। অতএব আইনটি বর্তমানে মৃত, দিন পঞ্চাশেক ধরে এর কোনো কার্যকারিতা নেই।

২.

বহুকাল ধরেই দেখছি, যে সরকার খারাপ আইন করে, সে আইনের শিকার বেশি হয় আইনপ্রণেতা ওই সরকার বা রাজনৈতিক দল। আগেই বলেছি, এ আইন প্রথমে প্রণীত হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। তখনো আইনটি প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের শায়েস্তা করতে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়েছিল। অধমের ধারণা, এ বাজে আইনের মাজেজা সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করেছিলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা, গত বছরের শেষের দিকে শত শত ‘গায়েবি’ মামলার শিকার হয়ে। আইনটিতে অনেকগুলো অপরাধের কথা বলা হয়েছিল, যেমন: সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা বা বিঘ্ন সৃষ্টি করা, যানবাহনের ক্ষতিসাধন করা, সম্পত্তি বিনষ্ট বা ভাঙচুর করা, ছিনতাই, হাটবাজারে বা রাস্তাঘাটে শক্তির মহড়া প্রদর্শন করা, ‘টেন্ডারবাজি’ করা ইত্যাদি। এ অপরাধগুলো আইনে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে পুলিশ ইচ্ছা করলেই যেকোনো ব্যক্তিকে এসব অপরাধে অভিযুক্ত করতে পারে। যেমন: যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো। ১০ জন ব্যক্তি যদি রাস্তা দিয়ে ছোটখাটো মিছিল করে যায়, তাহলে সেই মিছিলকারীদের বিরুদ্ধে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটানোর অপরাধে মামলা হতে পারে। সম্ভবত এ আইনের সুযোগ নিয়ে বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বহু মামলা হয়েছে।

তবে তাঁদের জন্য স্বস্তির বিষয় হলো আইনটি মারা গেছে। ২৮ মে ২০১৯ তারিখের প্রথম আলোর চতুর্থ পৃষ্ঠায় একটা শিরোনাম ছিল, ‘বিতর্কিত দ্রুত বিচার আইনের মেয়াদ বাড়ছে ৫ বছর’। রিপোর্টে বলা ছিল, গত ২৭ মে মন্ত্রিসভা আইনটির মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বলাবাহুল্য, মন্ত্রিসভার এ সিদ্ধান্তের ফলে সংসদের আগামী অধিবেশনে আইনটি সংশোধনের জন্য একটি বিল উপস্থাপিত হবে। সংসদে সেটা পাস করার তারিখ থেকে মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বৃদ্ধি পাবে। প্রথম আলোর রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে ২০০২ সালে যখন আইনটি পাস হয়, তখন আইনটিকে ‘আওয়ামী লীগ দমন আইন’ নামে আখ্যায়িত করেছিল তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ।

৩.

আগেই বলেছি, আইন মারা যাওয়ার ঘটনা অতি বিরল। আইন মারা গেলে তার পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের পর বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে যা বুঝেছি, তার মর্মার্থ হলো আইনটি মারা যাওয়ার ফলে এ আইনের অধীনে চলমান মামলাগুলো খারিজ হয়ে গেছে। এ আইনের অপরাধগুলো বিচার করার জন্য আইনটির আওতায় দ্রুত বিচার আদালত সৃষ্টি করা হয়েছিল। আইন মারা গেছে মানে ওই আদালতগুলোও মারা গেছেন। মনে রাখা ভালো, ফেনীর সোনাগাজীতে নিহত নুসরাত জাহানের হত্যাকাণ্ডের বিচার যে দ্রুত বিচার আদালতে যাবে, সেটি অন্য একটি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দ্রুত বিচার আদালত। সে আদালত সৃষ্টিকারী আইনটি বহাল তবিয়তেই আছে এবং বিচারকার্য চলছে, চলবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধের বিচারের জন্য যে দ্রুত বিচার আদালত তৈরি করা হয়েছিল, তার সমাপ্তি ঘটেছে আইনের মৃত্যুর কারণে।

এ আইনের অধীনে করা মামলাগুলো চালানোর জন্য আগামী সংসদ অধিবেশনে আইনটির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সরকার একটি গোঁজামিলের সংশোধনী আইন পাস করাতে পারে। তাতে মৃত আইনটি পুনরুজ্জীবিত হবে না, বাদ সাধবে সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ।

শাহদীন মালিক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক