ঈদ, ক্রিকেট ও এতিমেরা

বেতন ভাতার দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ। ডেমরা, ঢাকা। সাম্প্রতিক ছবি
বেতন ভাতার দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ। ডেমরা, ঢাকা। সাম্প্রতিক ছবি

চলে এসেছে ঈদ। এর মধ্যেই আবার শুরু হয়ে গেছে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ আসর। সব মিলিয়ে বেশ উৎসবের আবহ চারদিকে। উৎসবের মধ্যেই জারি আছে কারও কান্না, কারও দীর্ঘশ্বাস। চাইলেও ঈদে প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফোটাতে পারবেন না অনেক শ্রমিক-কৃষক। কেউ কেউ আবার বছরের পর বছর ধরে আশায় আছেন, এই ঈদেই হয়তো ‘নিখোঁজ’ স্বজন ফিরে আসবেন! কিন্তু তাঁদের চোখের জল মুছে দেয় না কেউ। তাঁদের দেখার যে কেউ নেই। এই রাষ্ট্রের ‘এতিম’ নাগরিক তাঁরা।

সম্প্রতি বাজারে গিয়েছিলাম চাল কিনতে। সেখানে এক নারীর সঙ্গে দোকানদারের বাহাস চলছিল। নাজিরশাইল চালের কেজিপ্রতি দাম শুনেই ওই নারী তর্ক করছিলেন। তাঁর দাবি, ধানের আবাদ তিনিও করেন। প্রতি কেজি ধানের দাম তো এত নয়! দোকানদার তো হেসেই উড়িয়ে দিলেন ক্রেতার কথা। তাঁর ভাষায়, ধান আর চালের হিসাব কি এক? না, এক নয়। তবে এই যুক্তিতে ধানচাষি ওই নারীর মনের দুঃখে প্রলেপ পড়ে না। কারণ, যে ধান তিনি ‘পানির দরে’ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, ভাত ফোটাতে সেগুলোই পরে উঁচু দরে কিনতে হচ্ছে তাঁকে।

ইদানীং অবশ্য কৃষকের দুঃখে অনেকেই সমব্যথী হচ্ছেন। কৃষকের খেতের ধান কেটে দেওয়ার হিড়িক পড়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান কিনছেন। তবে কৃষকের সমস্যার পুরো সমাধান হচ্ছে না। তাই কৃষকের এই হাহাকার শুনতে হয় ফি বছরই।

ধানের দাম কম। আবার কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেশি। এই রাগে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বানকিনা গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক সিকদার সম্প্রতি নিজের পাকা ধানে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। ছবি: প্রথম আলো
ধানের দাম কম। আবার কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেশি। এই রাগে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বানকিনা গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক সিকদার সম্প্রতি নিজের পাকা ধানে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। ছবি: প্রথম আলো

একই অবস্থা আমাদের দেশের শ্রমিকদেরও। চলতি বছর নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে শ্রমিকের ঈদ বোনাস দেননি প্রায় অর্ধেক পোশাকশিল্পের মালিক। অথচ মালিকপক্ষের প্রতিশ্রুতি ছিল, ৩০ মের মধ্যে বোনাস দেওয়া হবে। কিন্তু বরাবরের মতোই এবারও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার প্রয়োজন বোধ করেননি তাঁদের অর্ধেক। পোশাকশ্রমিকদের বোনাস না দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে গুগলে সার্চ দিলে প্রায় একই শিরোনামের অসংখ্য খবর পাওয়া যায়। মজার বিষয় হলো, শুধু তারিখগুলো ভিন্ন, আগের বছরগুলোর। অর্থাৎ বছরের পর বছর ধরে ঈদ বোনাস সঠিক সময়ে না দেওয়ার অনিয়মকে ‘নিয়মে’ পরিণত করেছেন এই মালিকেরা। আর রাষ্ট্রও তা মেনে নিয়েছে।

ঈদে তাই স্বজনদের মুখে হাসি ফোটাতে পারবেন না অনেক পোশাকশ্রমিকই। হয়তো ছোট মেয়েটা একটা টুকটুকে লাল রঙের জামা চেয়েছিল, কিন্তু টাকার অভাবে আর তা ব্যাগে ভরতে পারবেন না কোনো শ্রমিক বাবা। সন্তানের জন্য হয়তো পোলাও-মাংস রাঁধতে পারবেন না কোনো শ্রমিক মা। মুখ লুকিয়ে চোখের জল মুছবেন তাঁরা। তাতে কার কীই–বা এসে যায়!

পাটকলশ্রমিকেরা অবশ্য সেদিক থেকে একটু স্বস্তিতে আছেন (বোধ হয় রাষ্ট্রীয় বলে)। রাস্তায় নেমে বিক্ষোভের পর বকেয়া মজুরি ও বোনাস জুটেছে তাঁদের। আচ্ছা, যদি প্রতি মাসের পাওনা বেতনের জন্য আপনার রাস্তায় নামতে হয়, তবে কি মনে শান্তি থাকবে? থাকার কথা নয়। এর বদলে সৃষ্টি হয় অসহনীয় বিতৃষ্ণা।

আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন কারখানাটির শ্রমিকেরা। ৩০ মে, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো
আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন কারখানাটির শ্রমিকেরা। ৩০ মে, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো

ক্রিকেট অবশ্য সম্মোহনী ক্ষমতায় সেই বিতৃষ্ণা কিছুটা ভুলিয়ে দিতে পারে। ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ সদর্পে খেলে বলেই তা সম্ভব হয়েছে। ক্রিকেট নিয়ে অন্তত এ দেশের ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবাই এক স্লোগানে গলা মেলাতে পারে। ২২ গজের জয়ে চূড়ান্ত পরাজিত মানুষটিও ক্ষণিকের জন্য নিজেকে ‘জয়ী’ ভাবার সুযোগ পায়। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার মরিয়ম বেগম সেই সুযোগও পাচ্ছেন না। ধান কাটার মজুরি শোধ করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে নিজের টেলিভিশন সেটটি দিয়ে দিতে হয়েছে তাঁকে। বাজারে নির্ধারিত ‘কম দামে’ ধান বিক্রি করতে চাননি মরিয়ম। কিন্তু ধান কাটা শ্রমিকদের ‘পাওনাদার’ করতে চাননি তিনি। টেলিভিশন দিয়েই চুকিয়েছেন শ্রমের মূল্য। এবার মরিয়মের পরিবারের সদস্যদের তাই প্রতিবেশীর জানালায় উঁকি দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

ঈদ বা ক্রিকেট বিশ্বকাপ—হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির স্বজনদের ব্যথা কোনোটাই উপশম করতে পারে না। এ দেশে দিনের পর দিন ‘নিখোঁজ’ থাকা অনেক নাগরিক আছেন। তাঁরা নাকি কর্পূরের মতো উবে গেছেন! কেউ তাঁদের খুঁজে পায় না। কোনো হারানো বিজ্ঞপ্তিতে হদিস মেলে না তাঁদের। নিখোঁজ ব্যক্তিদের কারও শিশুসন্তান এখন কথা বলতে শিখেছে, কারও মা-বাবা কেঁদে কেঁদে মৃত্যুশয্যায়। কারও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্ত্রী। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা এখনো আশায়। ঈদ এলে ভাবেন, যদি ফিরে আসে প্রিয়জনেরা! কিন্তু আসে না তাঁরা। অপেক্ষাও শেষ হয় না।

নিখোঁজ স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আশায় এখনো পথে চেয়ে তাঁরা। প্রেসক্লাব, ঢাকা, ২৫ মে। ছবি: হাসান রাজা
নিখোঁজ স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আশায় এখনো পথে চেয়ে তাঁরা। প্রেসক্লাব, ঢাকা, ২৫ মে। ছবি: হাসান রাজা

ওপরের এই সব মানুষই এ দেশের ‘এতিম’ শ্রেণির নাগরিক। তাঁদের দেখার কেউ নেই। যেকোনো সময় আপনি-আমিও এই শ্রেণিতে ঢুকে পড়তে পারি। ধরুন, চালকের ভুলে বা ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে নিজেদের কারও হাত-পা গেল। অথবা কোনো অপরাধের শিকার হলেন আপনি। তখনই বুঝতে পারবেন আদতেই রাষ্ট্র আপনার দেখভাল করছে কি না!

আমরা বেশির ভাগ সময়ই তাৎক্ষণিকতায় আস্থা রাখি, দেখনদারিতে বিশ্বাস করি। কৃষক ধানের দাম কম পাচ্ছেন, আমরা তাঁর ধান কেটে দিচ্ছি। তাতে প্রকৃত সমস্যার সমাধান কিন্তু হচ্ছে না। রাষ্ট্র বা সরকারও এই প্রবণতায় আক্রান্ত। রমজান মাস উপলক্ষে এই যে এত অভিযান চলছে, এত ‘ভেজাল’ ধরা পড়ছে—এর তীব্রতা কি বছরের অন্যান্য সময়ও একই থাকে? উত্তর হলো, না। তাহলে বছরের বাকিটা সময় আমাদের দেখভাল করবে কে?

ওপরের প্রশ্নগুলোর সমাধান হওয়াটা বড্ড প্রয়োজন। এ দেশের নাগরিকদের ‘এতিম দশা’ কাটাতেই উত্তরটা জানা দরকার।

অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
[email protected]