একটি আত্মহত্যা ও আফিমের গল্প

তরুণ কর্মবীর হিমু এখন অনেকের বুকে শোকভার হয়ে আছে। ছবি:সংগৃহীত
তরুণ কর্মবীর হিমু এখন অনেকের বুকে শোকভার হয়ে আছে। ছবি:সংগৃহীত

‘...কিন্তু যখন আমরা নিজেদের তৈরি করি, ঠিক সেই মুহূর্তে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। আমরা দেখি, যা আশা করেছিলাম আর অন্যেরা যা আমাদের কাছে আশা করেছিল, আমরা মোটেই তা নই। এই হলো স্বাধীনতা, কিন্তু এটা খুব আনন্দের কিছু নয়।’ —জ্যাঁ পল সার্ত্রে

ঢাকা শহরের এত কাছে এমন নিরিবিলি একটা গ্রাম, যেন টেরই পাওয়া যায় না। তুরাগ নদ পেরিয়ে ওই পারের সেই গ্রামের এলাকায় সারি সারি গোলাপের চাষ, কোথাও ধানখেত। বন্ধু মুমু আর শরীফের কাছ থেকে নেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী নানা আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে ওই বাড়ির সামনে যেতে একটু হাঁটতেও হলো ধানখেত আর গোলাপবাগান ঘেঁষে। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম, টিনের চালায় একতলা দুটো ঘরের পাকাবাড়ি। দুটো ঘর ঘেঁষে আরও দুটো ঘর তোলার জন্য পিলার তোলা। পাশে একটা ছোট্ট উঠানের মতো। ঠিক উল্টো পাশে কয়েক পা দূরে ছোট রাস্তার ধারে লম্বা একটা গাছ। মেহগনিই হবে। যার নিচে চেনা-পরিচিত আর অপরিচিতরাও বসে আছে। ছায়াঘেরা ওই ছোট রাস্তার পাশ ঘিরে আস্তে আস্তে ভিড় জমছে। সেই ভিড়ের মধ্যে আমি আর জুলহাসনাইন বাবুও ছিলাম। সঙ্গে ছিল ছাত্র ফেডারেশনের সৈকত আরিফ আর রউফ। রউফ পোশাক কারখানায় কাজ করে। মে দিবসের কর্মসূচি সেরে আশুলিয়া থেকে গিয়েছিলাম বিরুলিয়া। গোলাপ গ্রাম। হক মোল্লার বাড়িতে। রউফ আসতে আসতে বলছিল, ও হিমুকে চেনে না কিন্তু হিমুর খবরটা পেয়ে ওর মন অস্থির হয়েছে খুব। ওই রাতে ও ঘুমাতে পারেনি। মনের মধ্যে কেমন হাহাকার লেগেছে, রউফ নিজেও জানে না তার কারণ। ভাবতে শুরু করলাম, হিমুর খবরে রউফের কী আসে যায়? ভাবতে ভাবতে ওইখানে কাকে কী বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সবার থমথমে চেহারা। ওই দিন ছিল ১ মে ২০১৯। হিমু যে বাড়িতে থাকত সেখানে মিলাদ হচ্ছিল।

দেখলাম মেহগনিগাছের নিচে অনেকে বসে। সেই মেহগনিগাছের কতগুলো পাতার রং লালচে খয়েরি হয়ে আছে। মাটি থেকে গাছের উচ্চতা অনেক। হিমুর উচ্চতার চেয়েও ঢের বেশি। এই গাছের নিচেই হিমু দাঁড়িয়েছিল, যখন ওর কেরোসিনমাখা শরীরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ওই গাছের নিচেই দাঁড়িয়েছিল হিমু জীবনের শেষনিশ্বাস নেওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। শহরের হট্টগোলের বাইরে ওই এলাকায় সবাই একটু আগেই ঘরের দরজা লাগায়। শুয়েও পড়ে কেউ কেউ। আশপাশের মানুষগুলো প্রথমে কোনো শব্দ শুনতে পায়নি। আগুন ওর সারা শরীর ডিঙিয়ে গাছের পাতা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকছিল, তখনো কেউ টের পায়নি। ওই ঘরে আটকে থাকা পোষা কুকুর জুলি আর এফ ঘেউ ঘেউ করে কাঁদছিল। যখন আশপাশের কেউ টের পেল, ততক্ষণে হিমু নেই। ওই গাছের নিচেই এলিয়ে পড়ে ওর নিথর দেহ।

গাছের পাতায় হিমুর মৃত্যুর ছাপ এভাবেই সপ্তাহজুড়ে ছিল। হয়তো আরও বেশি সময় ধরে ছিল, কে জানে। অনেক লালচে পোড়া পাতা গাছে আর কিছু পাতা নিচে ঝরে ছিল। হিমুর বোন হিয়া হিমুর মৃত্যুর সাত দিন পর আয়োজন করেছিল ওর বন্ধুদের নিয়ে মিলাদ। কথা কিন্তু এমন ছিল না মোটেও। হিমুর ইচ্ছা ছিল পটুয়াখালী থেকে বোন এলে বিরুলিয়ায় বন্ধুদের ডেকে পিকনিক করবে। হিয়াই করবে সব আয়োজন। হিমু নেই। হিয়া পিকনিকের বদলে এই বিরুলিয়াতেই আয়োজন করেছে মিলাদের। বিরুলিয়া থাকা শুরুর আগেই হিমু স্বপ্নে দেখত ধানখেতের আইল দিয়ে ও হাঁটছে, পাশে ওর গা ঘেঁষে রানা প্লাজার মৃত লাশেরাও হাঁটছে। মাঝেমধ্যে স্বপ্নে দেখত রানা প্লাজার দেয়ালগুলো ভেঙে ওর শরীরে চেপে আসছে।

ঢাকার মিরপুর আর সাভারের মাঝখানে বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামে মা-বাবার কেনা জায়গার পাশেই ওই ঘর দুটোর একটায় হিমু আর অন্যটাতে রাজীব আশরাফ ভাড়া থাকত। হিমুর সঙ্গে থাকত ওর পোষা কুকুর-বিড়াল। ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ষষ্ঠ বার্ষিকীতে হিমু সিদ্ধান্তমতো আত্মহত্যা করে রাত ১০টা নাগাদ। তার আগে কয়েক দিন এমনকি কয়েক ঘণ্টা ধরে দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে কেউ আন্দাজ করতে পারেনি ও কিসের জানান দিচ্ছে। আগুন সর্বনাশী, তাই আগুন ভালোবাসি। কারও মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ইত্যাদি।

গার্মেন্ট শ্রমিকদের দাবি আদায় থেকে শুরু করে ছাত্র আন্দোলন কোথায় ছিলেন না হিমু? ছবি:সংগৃহীত
গার্মেন্ট শ্রমিকদের দাবি আদায় থেকে শুরু করে ছাত্র আন্দোলন কোথায় ছিলেন না হিমু? ছবি:সংগৃহীত

নওশাদ হাসান হিমু (২৭), ছাত্র ফেডারেশন করত। সবাই তাকে জানত হিমালয় হিমু নামেই। লেখক হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমু’ চরিত্রের প্রভাব ছিল ওর মধ্যে। মাঝেমধ্যে হলুদ পাঞ্জাবি পরেও ঘুরেছে। ২০১৩-এর ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে উত্তাল। গণজাগরণ মঞ্চের ওই আন্দোলন থেকেই ওর প্রথম ছাত্র ফেডারেশনে অংশ নেওয়া। কিছুদিনের মাথায় ২৪ এপ্রিল এলে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি ও ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীদের সঙ্গে রানা প্লাজার নিহত ও আহত লোকজনের উদ্ধারকাজে যুক্ত হয় হিমু। টানা ১৭ দিন চলে জীবিত এবং পচা-গলা-মৃত মানুষ উদ্ধার। এরপর আর সব কর্মীর মতো হাসপাতালে প্রতিদিন আহতদের দেখা শোনা; ইয়ানুর, পঙ্গু রেহানা, সাদ্দামসহ অন্যান্যদের সঙ্গে রুটিন করে দেখা-সাক্ষাৎ; মৃত রূপালীর লাশ বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া—এসবই করেছিল হিমু। ইয়ানুর ভালোবেসে হিমুকে ডাকত হিমু মামা। ওই সময়ে রানা প্লাজার ঘটনায় সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল আমাদের ঘরের সদস্য থেকে বন্ধু-বান্ধব অনেকেই। ফলে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক ক্ষিপ্রগতিতে আমরা রানা প্লাজার মানুষের পাশে থাকতে পেরেছিলাম। হেঁটে, বাসে ঝুলে টাকা-পয়সা জোগাড়ে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়নি বিপদের প্রথম দিকটায়।

গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির রানা প্লাজাবিষয়ক সংকলন হাজার প্রাণের চিৎকারে উদ্ধারকর্মী হিমুর অভিজ্ঞতার অংশবিশেষ ছাপা হয় অ্যাপোলো হাসপাতাল ও রূপালীর ডায়েরি এই শিরোনামে। ফেসবুকে ডায়েরির মতো করে হিমুর লেখা সব অভিজ্ঞতা থেকেই সংগ্রহ করা ছিল লেখাটি। ওই প্রকাশনার জন্য হিমু সংগ্রহ করে দিয়েছিল আরেক বীর উদ্ধারকর্মী মানিকের অভিজ্ঞতা। মানিক পোশাক কারখানায় কাজ করত তখন। পরে বাসের কন্ডাক্টরি। মানিক ছাত্র ফেডারেশনের উদ্ধারকর্মী দলের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছিল। মানিকই প্রথম হাত-পা কেটে উদ্ধার করেছিল অনেককে। সাহস নিয়ে মানিকের সঙ্গে যুক্ত ছিল হিমু, কাঁকন, আল-জাহিদ, সাদিক, বিজয়, শরীফ, কৌশিক, হৃদয়, সামিয়া, সুমনা, পায়েলসহ আরও অনেকে। ওই প্রকাশনার কাজের সময় কিছুতেই মানিককে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। ট্রমায় ছিল মানিকও, সহজে ধরা দিত না। শেষে হিমুই খুঁজে বের করে মানিককে। সাভারে মানিকের ঘরেই একসঙ্গে রাত কাটায়। মানিককে দিয়ে লিখিয়ে আনে তাঁর দুর্লভ অভিজ্ঞতা। হিমু রানা প্লাজায় কীভাবে যুক্ত ছিল, তা ওই সময় যারা একসঙ্গে কাজ করেছে তাদের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। হাজার প্রাণের চিৎকারে কাঁকন বিশ্বাস নিজের কাজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বারবার হিমুর কথা না বলে পারে না ।

‘... আবারও সেই হিমু, যে ছিল আমার দেখা রানা প্লাজার সবচেয়ে উদ্যমী উদ্ধারকর্মী। ...প্রথমে মাংস পচা গন্ধ উপেক্ষা করেই ভেতরে ঢুকি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো জীবিতর সাড়া না পেয়ে টর্চের আলোর আওতায় ফিরে আসি। আমি কিছু খুঁজে না পাওয়ায় হিমু প্রবেশ করে, আমি তার পেছনে। হাতে অক্সিজেনের ছোট টিউব। হঠাৎ করে অক্সিজেনের সংকটে হিমুর ফিট হওয়ার মতো অবস্থা। কোনো রকমে ওকে টেনে কিছুটা আলোতে এনে অক্সিজেন দিলে হিমুর জ্ঞান আসে। ওই নাছোড়বান্দা ছেলে প্রমাণ করেই ছাড়বে ভেতরে মানুষ আছে ...’ —কাঁকন বিশ্বাস

রানা প্লাজায় উদ্ধারদলের সঙ্গে স্নায়বিক সময়গুলিতে। ছবি:সংগৃহীত
রানা প্লাজায় উদ্ধারদলের সঙ্গে স্নায়বিক সময়গুলিতে। ছবি:সংগৃহীত



নাছোড়বান্দা হিমু এভাবেই হাল ধরে রাখে। আবারও ঢোকে গুহার মতো ফাঁকফোকরের ভেতর মানুষের খোঁজে, আবারও জ্ঞান হারায়। এই ছিল হিমু। ২০১৪ থেকে ২০১৫, এই সময়ে ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা মহানগরের ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সক্রিয় থাকে সে। পাশাপাশি গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতিকে সাহায্য করা এবং গণসংহতি আন্দোলনের নানা কাজেও যুক্ত ছিল। সবশেষ মেয়র ইলেকশনে ঢাকা উত্তরে জোনায়েদ সাকি অংশ নিলে সেখানেও প্রচারের কাজে অংশ নেয় হিমু।

কেউ ভাবেইনি সমাজের আর সবার থেকে আলাদা হয়ে ট্রমায়-হতাশায় মগ্ন হিমু নানা অভ্যস্ততায় নিয়ন্ত্রণহারা পথে আত্মহত্যার দিকে এগোবে। পটুয়াখালীতে নিজের বাড়িতে থাকার সময় ৫ম ও ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি পায় হিমু। কিন্তু বড় হয়ে মা-বাবার ইচ্ছা পূরণে আর ইচ্ছা হয় না। কড়া শাসনে বেড়ে ওঠা সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারে হিয়া একমাত্র কন্যা আর হিমু একমাত্র পুত্র। হিয়া হিমুর চেয়ে ৩ বছরের বড়। মা আফরোজা বেগম কৃষি বিভাগে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন আর বাবা আবুল হোসেন ছিলেন ব্যাংকের কর্মকর্তা। পরিবারের কাছের আত্মীয়স্বজন সবাই মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে।

‘আমাদের ফ্যামিলি, আমাদের একটা ফর্মুলায় বড় করেছে। সিরিয়াস পড়াশোনা, তারপর সরকারি চাকরি খোঁজা, পাওয়া, সমাজে ঠিকঠাকভাবে দাঁড়ানো আর কী। আমাদের জিনে ব্যবসা নেই, তাই চাকরি করে বাঁচতে হবে। এটা ব্রেনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ছোটবেলাতেই। এখানেই হিমুর সঙ্গে ওর ফ্যামিলির বিবাদ। হিমুর বাবার সঙ্গেও তাঁর চিন্তা-ভাবনার মতের মেলা অমিল ছিল।’—আরমান আহসান বাবু

হিমুর স্মরণসভায় পরিচয় হয় ওর খালাতো ভাই আরমান আহসান বাবুর সঙ্গে। আরমান হিমুর চেয়ে সাত বছর বড় হবে। কিন্তু তাঁদের শৈশব কেটেছে একসঙ্গে। একই নদীর পাড়ে, একই পাড়ায়। সন্ধ্যা, পায়রা আর লোহালিয়া—এই তিন নদী ঘেরা পটুয়াখালীর সবুজবাগ পাড়াতেই ওদের শৈশব। নানা আলাপে আরমানের কাছ থেকে জানি হিমুর শৈশব আর বেড়ে ওঠার কথা।

হিমুর বাবা আবুল হোসেন ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে ওকালতি চর্চা করতেন। ইচ্ছা ছিল একমাত্র ছেলে হিমুও হবে উকিল। ২০১১ সালে মা-বাবার সঙ্গে ঢাকায় আসে হিমু। হিমুর মায়ের জন্মস্থান পটুয়াখালী আর বাবার বরিশাল। পটুয়াখালীই ওর গ্রামের বাড়ি হিসেবে বেশি পরিচিত। এইচএসসি পর্যন্ত ছিল ওই জেলাতেই। ঢাকায় আশা ইউনিভার্সিটিতে ল-তে ভর্তি হলেও পড়াশোনা চালানো হয় না হিমুর। ছোটবেলা যে বাবার সঙ্গে মধুর সম্পর্ক ছিল, তাঁর সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব বাড়ে। তখন গণজাগরণ, রানা প্লাজা কিংবা ইলেকশনের সময়ের মতো কাজের অবস্থা নেই। আবার নিয়মিত সেই কাঠখড় পোড়ানো পরিশ্রম। সেটা ২০১৫-এর মাঝামাঝি। হিমুর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়। শুরু হয় আরও দুর্ভোগ। কদিন পর ছাত্র ফেডারেশন এবং গণসংহতি আন্দোলনের বন্ধুদের পরামর্শে সেন্ট্রাল রোডে আরিফুল ইসলামের অ্যাডফার্ম অফিসের একটা ঘরে থাকতে শুরু করে হিমু। প্রায় মাস ছয়েক থাকে ওখানে। ওই অ্যাডফার্মের কাজের সঙ্গে হিমুকে যুক্ত করা, লেখাপড়া চালানোতে আগ্রহী করা, ওর দেখাশোনা করা, হাত খরচের একটু জোগাড়যন্ত্র এসবেরই চেষ্টা করে তারা। ঘরছাড়া হিমুকে এভাবে ছায়া দেওয়াকে আমি তখন ‘প্রশ্রয়’ ভেবে বিরক্তই ছিলাম। নানা কারণে-অকারণে, অজুহাতে-অভ্যস্ততায় হিমুর আরিফদের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয়। ওখানেও আর থাকা হয় না। কাছে রাখার এবং বোঝানোর নানা চেষ্টায় ব্যর্থ হয় বন্ধুরা, কখনো কখনো হয় বিব্রতও।

প্রাণীপ্রেমী হিমু। ছবি:সংগৃহীত
প্রাণীপ্রেমী হিমু। ছবি:সংগৃহীত

স্নেহময়-মায়াময় প্রাণে ভরপুর হিমু, রানা প্লাজার সার্টিফিকেটবিহীন হিরো ক্রমেই অচেনা হয়ে চেনা পরিসর ও ধরাছোঁয়ার বাইরে যেতে থাকে। ঘর ছাড়ার প্রায় দেড় বছর ও বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। চারপাশ থেকে নিরাশা বাসা বাঁধতে থাকে হিমুর ভেতর। পরিবার থেকে টাকাপয়সা নেওয়াও বন্ধ হয়। ঢাকায় নিজের মতো অল্প খরচে ভাড়া বাসায় থাকতে শুরু করে। কখনো থাকে বন্ধুদের সঙ্গে। আড্ডা দেয় ছবির হাটে; শাহবাগে মোল্লার দোকানে; সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে; ধানমন্ডি লেকে; কদাচিৎ পুরোনো কিংবা নতুন বন্ধুদের বাড়িতে। এমনি নানা জায়গা ও জন হয়ে ওঠে তার নতুন আনাগোনা, নতুন পদচারণ, নতুন আস্তানা। প্রেমিকা, বন্ধু, পরিবার, লড়াইয়ের দোসররাসহ অনেকেই পিছে পড়ে যায় সেই রেসে। ছোটবেলা থেকেই বন্ধনমুক্ত হয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার ইচ্ছা হিমুকে পেয়ে বসেছিল। সেই জীবনের খোঁজেই হয়তো ওর ভিন্ন যাত্রা শুরু। এইখানে এসেই জ্যাঁ পল সার্ত্রের ‘স্বাধীনতার জন্য মানুষ দণ্ডিত’ কথাটির ব্যাখ্যা ভাবনায় আসে।

‘আমরা শুরু করি অন্যের হাতে তৈরি হওয়া দিয়ে, অন্যরা আমাদের যা বানিয়েছে, শুরু করি সেখান থেকেই। কিন্তু যখন আমরা নিজেদের তৈরি করি, ঠিক সেই মুহূর্তে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়—আমরা দেখি, যা আশা করেছিলাম আর অন্যেরা যা আমাদের কাছে আশা করেছিল, আমরা মোটেই তা নই। এই হলো স্বাধীনতা, কিন্তু এটা খুব আনন্দের কিছু নয়।’ —জ্যাঁ পল সার্ত্রে

সত্যি তা-ই! স্বাধীনতায় অনেক দুর্ভোগ আর যন্ত্রণা। এই চেষ্টায় দুঃখও পেতে হয় কম না। স্বেচ্ছাচারিতা আর স্বাধীনতা এক না, এও জানা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পুরো প্রক্রিয়াই যতটা মধুর ততটা সাধনার। ততটাই রক্তক্ষয়ী আর সংগ্রামের। স্বাধীনতার সংগ্রাম ব্যক্তির নিজের, একই সঙ্গে নিজের সঙ্গে সমষ্টির সংযোগের। এই অর্জনে নিজের এবং চারপাশের নতুন নতুন জন্ম কোনো সহজ-সরল পথে হওয়ার নয়। কঠিন এবং পারস্পরিক মিলনের অব্যাহত প্রক্রিয়াই স্বাধীনতা। আত্মহত্যার মতো শর্টকাট পথে তাকে পাওয়ার সুযোগ হয় না। ২৪ এপ্রিল ২০১৯ ছিল হিমুর জীবনে দ্বিতীয় এবং সফল আত্মহত্যা প্রচেষ্টা।

জ্যাঁ পল সার্ত্রের ভাবনার মতোই স্বাধীনতার বাসনায় হয়তো পদে পদে দুঃখিত হয়েছে হিমু। পরিবার-পরিজন-বন্ধু-স্বজন-সমাজের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ছাঁচের না হতে পারায় অনেকেই স্বাধীনতাপাগল, দলছুট; আফিমখোরের মতো মগ্ন, বেমানান-বাউণ্ডেলে হিমুকে দূর দূর করেছে। আলাদা করে বিশেষ যত্ন করা; এসবের কারণ জানা-বোঝার বদলে দূরে ঠেলেছে হিমুর গাঢ় একাকিত্ব-বিচ্ছিন্নতা আর নিরাশাকে।

দূরে থেকে হিমু এই শহরে নিজের মতো ব্যস্ত হতে থাকে। চারপাশও কম ব্যস্ত ছিল না। সেসব ব্যস্ততায় থেকেছে হাজারটা ঝুট-ঝামেলা। শহরের ক্লান্তিকর জ্যাম; লম্বা বাসের লাইন; দৌড়ে বাসে ঠাসাঠাসি করে ওঠা। ঘামে চপ চপ হওয়া ক্লান্তি। ভীষণ অনিশ্চয়তা, চাকরির খোঁজে শত শত নিবেদন। নিদারুণ অর্থকষ্ট, লোনের চাপ। আরও আছে ৮টা-৫টা অফিস, উল্টো করে বললে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ব্যস্ততা। অফিসে বসের অহেতুক বসগিরি, ঘরেও কাজের টেনশন, চাকরি আর প্রমোশন হারানোর ভয়। আছে আদর্শের চাপ বয়ে বেড়ানো। শেষে ইলেকশনে প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে সবকিছুর সাক্ষী হওয়া এবং সব অপমান চেপে থাকার মতো জ্বালা। আছে আকাশ-সবুজ দেখতে না পাওয়া কয়েক শ ফিটের বাসায় দমবন্ধ হওয়া। আছে ফেলে আসা নদী, গ্রাম, খেলার মাঠ, সবুজে বিচ্ছেদের হাহাকার। করপোরেট জীবন। শ্রমিকের ভিড়, ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ, বঞ্চনা। আছে বিলাস বাড়ি, দেশে-বিদেশে নিশ্চিত ব্যাংক-ব্যালান্স, সম্পত্তির বিবাদ, তারপরও কী যেন নেই। আর আছে আরও চাই মনের নিশপিশ। দারুণ প্রতিযোগিতা আর স্বার্থপরতাময় এই ব্যস্ততা।

ব্যস্ত সমস্ত স্বার্থপর এ জীবন কখনো প্রেমে মগ্ন। নয়তো প্রেমিকের খবরদারি-নজরদারি-অবাধ্যতা-বাড়াবাড়িতে ত্যক্ত-ক্লান্ত মন। কখনো এতে রয়েছে ঘর-সংসার, টাকার খোঁটা, ঘ্যানঘেনানি। চাপা অতৃপ্ত কড়া অসন্তোষ। স্ত্রীর রাজ্যের অভিযোগ অনুযোগ মনোযোগ সামাল দেওয়া; স্বামীর চোখ রাঙানো, অবহেলা, চাপিয়ে দেওয়া সহ্য করা; সন্তানের টেনশন; কাজের ‘আয়া-বুয়া’র সংকট কোনোকিছুর কমতি নেই এখানে। সবাইকে খুশি রাখার বৃথা চেষ্টার ভারও আছে। বাদ নেই ফেসবুক-ক্রিকেট-ভিডিওগেম, পর্নোগ্রাফি-খিস্তি খেউড়, পাড়ার ভাবিদের সঙ্গে আড্ডা-সিরিয়াল দেখা, নতুন সোফা-গয়না ফ্ল্যাট দেখানো, বাচ্চার সাফল্য নিয়ে শঙ্কা। কারও কারও জীবনে আছে আর্ট-কালচার, পৃষ্ঠপোষকতা, পার্টির আয়োজন, অনেক সাইনবোর্ড, বেচা-কেনার হুলুস্থুল। আছে মেলা মেলা চিন্তা-গবেষণা-লেকচার কিংবা চর্চাবিহীন তত্ত্ব-আলাপের ঝড়। এমনি আরও শত শত হতাশা-আশার দোলাচল ভরা ব্যস্ত জীবন। এসব নিয়ে প্রতিদিন অভিযোগ অনুযোগেরও শেষ নেই। অথচ এসব থেকে বের হতে জীবনের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি খোঁজার বদলে নিজের চৌহদ্দিতে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকাই যেন শ্রেয়। এই ডুবে থাকাও কি নেশা নয়? হিমুর নেশার চেয়ে এও বা কম কী? আসলে আক্ষরিকভাবে না হলেও আমরা সবাই আছি আফিমে।

সেই ডুবে থাকায় হিমুর ক্রমশ দুর্বল হওয়া টের পেয়েও ওকে দেওয়ার মতো দুদণ্ড বাড়তি সময়ও বের করার ফুরসত পায়নি কেউ। হিমুই বা কম কিসে! ওর কাছে যাওয়ার অনেক কবাট খুব শক্ত করে ভেতর থেকেই খিল দিয়েছিল ও। বন্ধু-স্বজন যারাই ওর দায় একটু হলেও নিতে চেয়েছে, সেই সামান্য কজনারও ওর সন্দিহান মনে ঠাঁই জোটেনি। আফসোস যে সমাজে দায় নেওয়ার মতো এমন মানুষের সংখ্যা এখনো অতি নগণ্য। আবার দলে দলে তাঁরা বিচ্ছিন্ন। ওই নগণ্যরাও হয়তো ওর ইচ্ছা-ধরনের সঙ্গে সংগতি না রেখে চাপিয়েছে নিজেদের মতো। ওর মন যে মেশিন নয়, মেশিনেরও যে রসদ লাগে; দম নিতে সময় লাগে সেটাও টের পেতে শেখেনি অনেকে। এই রকম মেশিন জীবন খুব কাছের মানুষের চাওয়া-পাওয়াই টের পাওয়ার সুযোগ হারায়। চোখের সামনে আরাম আয়েশের সুবিধাসন্ধানী জীবনে অতি চেনা নিকট মানুষকেও প্রায়ই বোঝা হয় না। নজরে পড়ে না প্রতিদিন ওঠা-বসায় সেই কাছের মানুষের ক্ষয়-বদল আর অপর হওয়া। কদর করা হয় না যাদের ওপর ভর করে আমাদের সাফল্য-উন্নতি তাদের। যখন টের পাই, তখন হয়তো সময় ফুরিয়েছে সবারই। নিজের চাওয়ার কদর না করে, নিজ এবং অপরকে ভালো না বেসে, সম্মান না করে; অপরের প্রতি দায়বোধ না করে; অপরকে দাসানুদাস বানিয়ে, অপরের ইচ্ছার টুঁটি চেপে ধরে, স্বপ্নকে পায়ে দলে, অপরের শ্রমে জেঁকে বসে নিজের স্বাধীনতা কি অর্জিত হয়? নিজের ভাব বোঝা এবং নিজের সঙ্গে অন্যের জৈবিক সম্পর্কের লেপ্টালেপ্টি ভাব মান্য করে স্বাধীনতার পথ পাড়ি দেওয়া খুব সহজ তো নয়। মনে পড়ে ‘মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক বিষয়মুখ এবং বাস্তব হয়ে উঠতে পারে কেবল অন্য মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের মাধ্যমে।” বিচ্ছিন্নতা এবং ব্যক্তির বিকাশ নিয়ে কার্ল মার্ক্স লিখেছেন তাঁর ইকোনমিক অ্যান্ড ফিলোজফিক্যাল ম্যানুস্ক্রিপ্টে।

যে সমাজ সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে, প্রাণ হরণ করে সবার, সে সমাজের মুখোমুখি হতে নিজেকে অন্যের দ্বারস্থ হতে হবেই। যে অন্য সবাই প্রতিদিন আপনাকে আমাকে গড়ে-ভাঙে, আবার শক্তি দেয়, তার পাশেই আশ্রয়। আমাদের অস্তিত্বও যে অপরকে বাদ দিলে কেবলই শূন্য। দর্শকবিহীন খেলার মাঠের মতো। নিজের আর সবার যৌথতার শক্তির মাঝেই লুকিয়ে আছে গুমোট সমাজ বদলের প্রাণভোমরা। একা সেই কঠিন পথে হাঁটতে তো ভয় হবেই। যখন একজন আরেকজনকে আপন মন মেলে ধরবে, যখন জনে জনে পথে একতালে-একমনে হাঁটবে, কথা বলবে, হাসবে এবং সংগ্রাম করবে, তখন কোনো ভয় থাকবে না। স্বাধীনতার পথ এভাবেই পায়ে পায়ে এগোয়।

রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের খোঁজখবর নিত হিমু। ছবি :সংগৃহীত
রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের খোঁজখবর নিত হিমু। ছবি :সংগৃহীত



কিন্তু হিমু হয়তো স্বাধীনতা অর্জনের বন্ধুর পথের থেকে শর্টকাট পথ বেছে নিয়েছিল। সংগ্রামের চেয়ে সেই শর্টকাট পথে যাওয়াতেই হয়তো ওর বড় বড় স্বপ্নগুলো পাখা মেলতে পারেনি। ওই সরু পথে ওর সব স্বপ্ন যেন আটকে ছিল। অতঃপর সেইসব স্বপ্নদের একসময় খাঁচায় ডানা আছড়ে মরার দশা।

সম্পর্কের টানাপোড়েনও ছিটকে ফেলে হিমুকে ‘স্বাভাবিকতা’ থেকে। ওই সময় প্রাণিকুলের প্রতি টান আরও গাঢ় হয়। যে টান ওর ছিল ছোটবেলা থেকেই। হিমুর পরিবারে প্রায় সবার বাড়িতেই একটা করে পোষা প্রাণী আছে। টানাপোড়েনের সেই সময়ে মনুষ্য প্রাণীর চেয়ে পোষা কুকুর-বিড়াল হয়ে ওঠে ওর নিকটতম সঙ্গী। পরিচয় হয় এনিমেল ওয়েলফেয়ারের সঙ্গে। শেষের দিকে পোষা প্রাণী আর হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটাতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করত ও। মাম্বা-জুলি-এফ ছিল সেই পোষা প্রাণীদের দলে। আর বড় বোনের মতো বন্ধু মুমু আর মুমুর ছেলে প্রভুও ছিল হাতে গোনাদের তালিকায়। মুমুকে নানাভাবে সাহায্য করা, ওর বাসায় ইচ্ছামতো খাওয়া-উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা; প্রভুকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ায় ওর এক প্রশান্তির জায়গা হয়ে ছিল।

টাকাপয়সা হাতে না থাকায় ওই সময়ে নানা বন্ধু-বান্ধবের শরণাপন্ন হতে হয়েছে হিমুকে। টাকা পয়সা পেলে ও কী করবে, কোথায় কোন বাজে খাতে খরচ হবে, তা-ই ভাবত কেউ কেউ। কখনো ধার করত, ফেরত দিত। টাকার প্রয়োজনে নিজেকে ছোট না করে বরং নানা কল্পনার গল্প ফাঁদত অন্যের কাছে। সব বুঝে কেউ টাকা দিত, কেউ দিত না। নানা পথে জীবন চলেছে কোনোমতে। তবু বাড়িতে মা-বাবার কাছ থেকে টাকা নেয়নি হিমু, তবু বাড়ির সঙ্গে তার আর দফারফা হয়নি লম্বা সময়। মায়ের হাতে ভালো-মন্দ খাওয়ার ইচ্ছা, পরিবারের সবার মধ্যে একটু আরামে থাকার মায়ায় হিমু ফিরে যায়নি একবারও। যেখানে বাড়িতে ওর জন্য কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। হয়তো বাড়িতে ফিরে যাওয়াকে পরাজয় ভেবেই ফিরে তাকায়নি। তার চেয়ে এই বেহুঁশ-বেহায়া-বেয়াড়া জীবনই ওর কাছে ঢের সমীহের ছিল। অন্যের কুকুর-বিড়াল লালনপালন করে কিছু টাকাপয়সা আয় করে তা দিয়ে কঠিন দৌড়ের সময় হাসি মুখে পার করে হিমু।

দৌড়ের এই জীবনে দৌড়াতে দৌড়াতে হয়তো শেষে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ও। এ বছরের শুরুতে ঢাকার বাসা ছেড়ে ওর মা ফিরে যান পটুয়াখালী। তখন ওর বাবাও নেই। বিরুলিয়ায় ওঠার আগে আগে পটুয়াখালীতে প্রায় এক মাস মায়ের কাছে থেকে আসে হিমু। বোন হিয়াকে একটু আশ্বস্ত করে জানায়, ‘এবার সত্যি বিরুলিয়া গিয়ে সেটেল হব।’ ইচ্ছা ছিল পোষা প্রাণীদের নিয়ে বাচ্চাদের জন্য বই লিখবে, বিরুলিয়ায় এনিমেল শেল্টার হাউস বানাবে। পরিকল্পনাগুলো নিয়ে এপ্রিলে বিরুলিয়া থাকা শুরু করে হিমু। কিন্তু হায় চারপাশ থেকে জেঁকে বসা হতাশা আর অনতিক্রম্য অভ্যস্ততা ওকে পিছুটানের মতো জাপটে ধরে। আবারও যেন এক অক্টোপাস। একার ইচ্ছার জোরে টান পড়ে তাকে রোখার। পরাস্ত হতে হয় নিজের কাছে। ওই সময়টায় কেউ ওর ভেতরের তোলপাড়-ক্ষয়ের আঁচ পায়নি। কিছুটা পেলেও বিশ্বাস করেনি হিমুকে।

হিমুর মৃত্যুর পর হিমুকে আমরা নতুন করে পাঠ করছি। নতুন করে বুঝতে-জানতে চাইছি। কিন্তু এমনি বহু হিমু আমাদের নাগালের বাইরে। বহু তরুণ হিমুর হাজারো সম্ভাবনা হারায় ‘অবাধ্যতায়’, ‘নেশাগ্রস্ততায়’ কিংবা ‘বেড়াজালে’। বহু হিমু নিজেকে নিঃশেষ করে অনিশ্চয়তায়-হতাশায়, যাদের খবরও আমাদের কাছে নেই। ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যের জন্য কাজ করতে করতে মুমূর্ষু তাঁরা অনেকে। অনেকে আছে যারা হিমুর মতো না বরং ‘স্ট্যাবল’, ধীরস্থির; সমাজে মানানসই বলে পরিচিত-গর্বিত। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে হিমুর মতো তাঁরাও একা। একটু ঠান্ডা মাথায় খেয়াল করলেই দেখব তারা আমাদের আশপাশে ঘুর ঘুর করছে। বাকি শুধু পোশাকের ভেতরের মানুষটাকে দেখা।

২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধস, হাজরো প্রাণ ও স্বপ্ন হত্যার বার্ষিকীকেই হিমু বেছে নিয়েছিল বিদায়ের দিন হিসেবে। নিজের স্বপ্ন হত্যার দিন হিসেবে। জানি না, জেনে-বুঝেই কি না। নিজের মৃত্যুকে এভাবেই সবার মনে মহীয়ান করেছে হিমু। নিরাশা-বিচ্ছিন্নতা-একাকিত্বের ফলাফল এবং এ থেকে বেরুবার পথ নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে ও আমাদের। এ থেকে বের হতে, এই অবস্থা বদলে সবার সঙ্গে বেদনার ঐক্য গড়া ছাড়া; দমবন্ধ শহর সমাজটা বদলে ফেলা ছাড়া; মুক্তি কঠিন সেই জানান দিয়েছে। এরপর ২৫ এপ্রিল। হিমু কয়লা হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে। হিমুর লাশ চলে যায় বরিশাল, ৭ মাস আগে মারা যাওয়া বাবার কবরের পাশে চিরশয্যায়। এভাবেই হিমু অধ্যায়ের শেষ হয় ২৪ এপ্রিল গড়িয়ে ২৫ এপ্রিল ২০১৯।

ওর মৃত্যুতে অনেকের মতো নিজের দায়ের কথা আমিও ভেবেছি। ভেবেছি ২৪ এপ্রিল তারিখ ওকে ডাকতে পারতাম, রানা প্লাজার প্রোগ্রামে ও না এসে পারত না। তাহলে হয়তো এমন হতো না; পরিবারের মানুষেরা ভেবেছে আরেকটু কাছে যেতে পারলে হয়তো ও হার মানত না; সংগঠন ভেবেছে আরেকটু নজর দিলে হয়তো...এক বন্ধু ভেবেছে আরেকটু সচ্ছলতা থাকলে ও-ই হিমুর দায়িত্ব নিতে পারত, তাহলে হয়তো...অন্য আরেক বন্ধু ভেবেছে রানা প্লাজায় উদ্ধার কাজ না করলে হয়তো ট্রমা পেয়ে বসত না, কেউ ভেবেছে ওর প্রেমটা না ভাঙলে কিংবা প্রেমিকাটা ‘অমন’ না হলে ও বদলে যেত; কেউ ভাবল ওর সঙ্গ ভালো হলে হয়তো... নেশা না করলে হয়তো...

কেউ ভেবেছে হিমু হয়তো তাদের কারও কারও মতো তীব্র একাকিত্বে ভুগছিল। নয়তো মৃত্যু সিদ্ধান্ত একা একা নেওয়ার শেষ সময় পর্যন্ত কোনো আপনজনের চেহারা পিছুটান হয়ে তার পাশে দাঁড়াতে পারল না কেন? সত্যিই তা-ই! পিছুটান হয়ে পাশে দাঁড়ায়নি প্রিয়তম মা-বোন বা প্রেমিকার চেহারা। কিংবা মনে পড়েনি রানা প্লাজার শ্রমিকদের মতো একজন শ্রমিককে কিংবা দলের কোনো বন্ধুকে? তাহলে কতটা অসহায় ছিল ঐ মুহূর্তে হিমু। এমনি নানান ‘হয়তো’ এক জায়গায় দাঁড়ায়নি, হয়েছে নানান গুঞ্জন। আর ওর মৃত্যুর দায় এ কাঁধ থেকে ও কাঁধে গেছে। অথচ এই রকম হিমুকে একা বাঁচানো যায় না। সকলের বাঁচাতে হয়।

হিমুর মৃত্যুর খবর জানাজানিতে সবার ভারাক্রান্ত অবস্থা প্রকট হয়। পত্রিকায় বড় অক্ষরে খবর ছাপা হয়, ‘রানা প্লাজার হিরো হিমুর আত্মহত্যা’; ‘রানা প্লাজার বর্ষপূর্তিতে শরীরে আগুন দিয়ে উদ্ধারকর্মীর আত্মহত্যা’; ‘অপূর্ণ স্বপ্ন। হিমুর মৃত্যুকে বোঝা’—এমনি নানা শিরোনাম।

পরিচিত অনেকে যারা পরিবারের সদস্য নই কিন্তু হিমুকে জানি বা জানি না, তারাও এই মৃত্যুতে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। অন্য কোনো কাজে মন দেওয়ার জো হলো না বেশ কটা দিন। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এই কান্না কি কেবলই মমতার; বীর উদ্ধারকারীকে হারানোর; নাকি সবার কাছ থেকে দূরে থাকা হিমুর মাঝে নিজেকে খুঁজে আঁকড়ে ধরা বিলাপ? মনে নানা কিছুর উথাল-পাথাল চলে। এই সমাজ কেন একজনকে হতাশ-নিঃসঙ্গ করে, বিচ্ছিন্নতা ও মাদকাসক্তিতে বুঁদ করে; পরিবার-পরিজন বন্ধুমহল দল থেকে দূরে সরায়; আত্মহত্যাপ্রবণ কিংবা আত্মপ্রেমী ব্যক্তিত্বের সংকটে ভোগায়, ভাবতে থাকি। ভাবি, কেন এই সমাজে একজন অসামাজিক হয়; নিজেকে লুকিয়ে রাখে; অন্যকে এবং নিজেকেও জেনে বা না জেনে ঠকায়; জীবনটা একটা খেলার হার-জিতের সাময়িক উত্তেজনা আর ঘোরে পরিণত করে। ভাবি, এ জীবনের অর্থ কেন খুঁজে পাই না, কেন লড়াই না করে গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে বা পালিয়ে বেড়াই সবাই।

এমনি নানা ভাবনায় হিমু ঝাপসা হয়ে চেনা আপন অনেক অসহায় মুখ ভীষণ একা আর বিচ্ছিন্ন হয়ে একে একে সামনে আসে। এভাবেই হিমু মরেও বেঁচে থাকে আর সবাইকে জ্বালাতে শুরু করে, খোঁচাতে শুরু করে। টের পাই হিমুর জন্য কান্নাগুলোকে কোন এক বা অদ্বিতীয় আবেগীয় ব্যাখ্যায় ফেলা যায় না। প্রতিটা কান্নার আকুতি, ভারাক্রান্ত মনের ভার, প্রতিটা নিথর হওয়ায় রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ। ভিন্ন চাওয়া না পাওয়ার টান। এসবে আছি আমি-আপনি-আমরা সবাই। আসলে হিমুর যন্ত্রণার মধ্যে আমরা হন্যে হয়ে আমাদের জীবনের সযত্নে আর বহু কসরতে গোপন করা যন্ত্রণা-বিচ্ছিন্নতা না পাওয়ার বেদনা; ব্যর্থতা হীনম্মন্যতা আর একাকিত্বের যোগসূত্র খুঁজেছি।

অনেকেই ভাবছেন, এই নিষ্ঠুরতা কেন এতক্ষণ ধরে বয়ান করছি। এ বর্ণনা-বয়ান অসহ্য। করছি এ কারণেই যে আমরা হিমুকে ভুলতে চাই না। আমরা চাই না হতাশায় ডুবে আর কেউ আত্মহত্যা করুক, আত্মহত্যায় সমাধান খুঁজুক। যদিও সমাজে আশাহীনতা বিচ্ছিন্নতা বিচারহীনতা অরাজকতা অসহনীয় হয়ে উঠলে ব্যাপক আকারে আত্মহত্যা কিংবা গণহিস্টিরিয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে নানা সময়ে। আসলে আমরা প্রত্যেকেই এই মেশিন-মুনাফা এবং পণ্যের সমাজে একেকটা পণ্য একেকটা মেশিন হয়ে হাঁপিয়ে। সমাজের স্বার্থেই আমরা একা এবং বিচ্ছিন্ন। পুঁজিবাদী সমাজ বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে শ্রমের সঙ্গে শ্রমিকের, তেমনি মধ্যবিত্তকেও করে বিচ্ছিন্ন। তাই বিযুক্ততার যন্ত্রণা প্রবল হয়, যার ছটফটানি হিমুর মৃত্যুতে যেন আরও বাড়ে। এভাবেই তীব্র এক মনবেদনা থেকে আগ্রহ তৈরি হয় আত্মহত্যার এবং বিচ্ছিন্নতাকে সমাজ রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিত থেকে বোঝার।

হিসেব কষে বুঝতে অসুবিধা হয় না, আমাদের ভাগ করে রাখতে পারাই প্রাণহীন এই সমাজ রাষ্ট্রের সার্থকতা। আমাদের সংকট পদে পদে। পালানোর বদলে সংকট মোকাবিলাই সম্মানের আর বেঁচে থাকার শক্তি। সেই সত্যকে উপলব্ধি করে শামুকের মতো খোলসে না থেকে সবার সঙ্গে ঐকতান সৃষ্টিই শক্তি হয়ে পাশে দাঁড়াবে, যে শক্তি সমাজের তৈরি বিভক্তি এবং বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্ন করে এবং চারপাশকে বদলে দেওয়ার সাহস রাখে। নিজেকে সবার মাঝে সঁপার মাঝেই সেই শক্তি লুকিয়ে। সমাজের বড় অংশের সংকটগুলো একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এক সুতায় কোথায় যেন বাঁধা। আমরা যা চাই, তা পাই না, আর যা পাই তা চাই না। এই নিষ্ঠুর বর্ণনা স্মরণ করে যাতে চারপাশে কাউকে হিমু হতে দেখে একটু নড়েচড়ে বসি, সেই চেষ্টায়ই এ লেখা। নির্মমতার এই নিষ্ঠুর বয়ান ছাড়া আমরা কী আমাদের দর্পণের মুখোমুখি করতে পারি? আমরা কী সমাজের নিষ্ঠুরতাকে নির্দিষ্ট করতে পারি? চারপাশকে নতুন করে বাসযোগ্য করে গড়ার সাহস সঞ্চয় করতে পারি?

হিমুর আত্মহত্যা আর ঋণের দায়ে জর্জরিত গ্রামীণ কৃষকের আত্মহত্যা এক নয়। চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে বিধ্বস্ত কারও আত্মহত্যা-চেষ্টা কিংবা দরিদ্র গ্রামীণ নারীর অর্থকষ্টে সন্তানদের ঈদের কাপড় কিনে দিতে না পেরে শিশুদের হত্যা এবং আত্মহত্যা একই নয়। কিন্তু সব আত্মহত্যাই সমাজের কোনো না কোনো অসংগতিকেই সামনে আনে। হিমু সেসব নিয়ে নতুন করে ভাবতে উসকে দিয়ে ঋণী করে আমাদের। রানা প্লাজার হিরো হিমুর কাছে আমরা ঋণী, ঋণী রানা প্লাজার নিহত-আহত শ্রমিকেরা। পোশাকশ্রমিকেরা। এই বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত, একাকী সমাজের একাকীরা। নিজের জান বাজি রাখা এসব সাহসী মানুষের বেঁচে থাকার পথ খুঁজতে আমাদের এক হওয়া ছাড়া এই নিষ্ঠুর সমাজে বদলের আর কোনো পথ খোলা আছে বলে আপাতত জানা নেই।

কৃতজ্ঞতা: একটি আত্মহত্যা ও আফিমের গল্পে হিমু ও আমরা প্রসঙ্গে নিয়ে লিখতে যে বন্ধু আপনজনেরা নানাভাবে প্রশ্ন করে, নিজেকে মেলে ধরে, হিমুর তথ্য ও গল্পগুলো বলে অংশগ্রহণ করেছেন, সেই বন্ধু আশরাফুল আলম সোহেল, উম্মে রায়হানা, শরীফ অঙ্ক, সৈকত আরিফ, সুলেখা হ্যাপী, মুন্নী, শ্যামলী শীল, ফিরোজ আহমেদ, আরিফুল ইসলাম, আহমেদ জাকি, আল জাহিদ, মাহবুব সুমন ও সবশেষে হিমুর খালাতো ভাই আরমান আহসান বাবুসহ সবাইকে কৃতজ্ঞতা। আরমান ছাড়া হিমু নিয়ে অনেক জানা অপূর্ণ থেকে যেত। কৃতজ্ঞতা সেউতি সাবুর, সামিনা লুৎফা, শেহজাদ এম আরেফীন, ঋতু সাত্তারসহ সবাইকে এই জরুরি বিষয় নিয়ে ভাবতে, পথ খুঁজতে উসকে দেওয়ার জন্য। অনেক ধন্যবাদ বন্ধু শিক্ষক আজফার হোসেনকে এই বিষয়ে বোঝাপড়া করতে কিছু বই পড়ার পরামর্শ দেওয়ার জন্য। ধন্যবাদ বন্ধু জোনায়েদ সাকিকে।

লেখক: তাসলিমা আখতার, সভাপ্রধান গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি ও আলোকচিত্রী।