গণিতকে ভালোবাসতে হবে

প্রায় ৪২ বছর আগে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের টিচার্স লাউঞ্জে আমাদের গণিতের শিক্ষক গোপাল চন্দ্র বড়ুয়া বলেছিলেন, ‘তোমাকে দিয়ে অঙ্ক হবে না’। তখন আমার পক্ষে যা সম্ভব ছিল, তা-ই করেছিলাম। টেস্ট পেপার ধরে অঙ্ক করতে করতে এবং মুখস্থ করে মাধ্যমিক পরীক্ষায় গণিতে ১০০-তে ১০০ পেয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে গণিতে ১০০-তে ১০০ পাওয়া আমাকে খুব একটা সাহায্য করেনি। ব্যষ্টিক অর্থনীতি ক্লাসে অঙ্ক নিয়ে আমাকে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।

সারা পৃথিবীতে এখন ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে, তার পেছনের মূল যৌক্তিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে দিচ্ছে গণিত। সে গণিত বিষয়ে আমার সম্যক ধারণা অত্যন্ত সাধারণ হওয়ার কারণে আমি এখনো গণিত নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। গেল বছর বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা ইদানীং কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ পাচ্ছে? আমি যখন পেছনের কারণ খুঁজতে গেলাম, তখন আমার কাছে উঠে এল বাংলাদেশের গণিত অলিম্পিয়াড এবং এই গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রথম আলো পত্রিকা ও এই পত্রিকার সম্পাদক মহোদয়ের কথা।

গণিত অলিম্পিয়াড শুরুর পর থেকে আজ একটি মহিরুহ অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। সেই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূতের প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলেছি, বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা যে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে, তার পেছনে বিরাট অবদান রয়েছে এই গণিত অলিম্পিয়াডের। গণিত অলিম্পিয়াড ছাত্রদের মেধা ও মননে, উৎকর্ষ সাধনে সহায়তা করছে এবং ছোট ছোট কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি যৌক্তিক মনন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। ফলে তারা বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য যে রকম প্রস্তুতি প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে।

আমি মনে করি, এই যে সব ক্ষেত্রে গণিতকে ছড়িয়ে দেওয়া, সব ক্ষেত্রে গণিতকে তরুণ-তরুণীদের কাছে তুলে ধরা, গণিতের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করা, তদুপরি একটি যৌক্তিক মন এবং মেধা নিয়ে আমাদের তরুণসমাজকে এগিয়ে আসতে সহায়তা করা, আমাদের অগ্রগতির ক্ষেত্রে, আমাদের বৈশ্বিক অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে, বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া যেভাবে এগোচ্ছে, সেটি একটি বিরাট আকার ধারণ করবে। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরাও আস্তে আস্তে দেখা যাবে ভারতের আইআইটি কিংবা আইআইএমের ছাত্ররা যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়েছে, তেমনভাবে ঢুকে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস স্কুলগুলোতে ১০ শতাংশ শিক্ষক এসেছেন আইআইএম ও আইআইটি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। এমনটি যদি আমরা আমাদের বুয়েটসহ সব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতকে ভালোবাসতে শেখাই এবং গণিত-ঋদ্ধ সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারি, আমার মনে হয় সেই দিন দূরে নয় যে আমরাও দেখতে পাব আমাদের সমাজের তরুণ-তরুণীরা পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠ শেষ করে পৃথিবীর সেরা বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ দিতে পারবে এবং সামগ্রিকভাবে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কিংবা কম্পিউটার জগৎ নয়, এমনকি বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে অবদান রাখতে পারবে।

সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত রয়েছেন, বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে গণিতকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে যাঁরাই কাজ করে যাচ্ছেন, আমি তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। দুঃখজনকভাবে দেখেছি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণিত কিংবা এ ধরনের মৌলিক কোনো বিষয়কে উৎসাহ দেওয়ার মতো সময় এখনো আসেনি। আমরা দেখেছি, আমাদের সব চেষ্টা সত্ত্বেও গণিতের ছাত্রছাত্রীদের কিংবা গণিত পড়ার জন্য পূর্ণ কিংবা আংশিক স্কলারশিপ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গণিত বিষয়টিকে আকর্ষণ করার প্রচেষ্টা মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছে।

আমাদের আজকের ছেলেমেয়েরা অনেকেই গণিতের চর্চা থেকে দূরে থাকে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে গাণিতিক সূত্রগুলো বোঝার অক্ষমতা, যা অনেকটাই নির্ভর করে আমাদের শিক্ষকেরা কীভাবে ছাত্রছাত্রীদের পড়ান তার ওপর। সূত্র মুখস্থ করে গাণিতিক সমস্যার সমাধানের ওপর জোর না দিয়ে ছেলেমেয়েদের প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। ভয়ভীতি না দেখিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উন্মুক্তভাবে চিন্তা করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। গাণিতিক সমস্যা সমাধানের নানাবিধ পদ্ধতি নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের চিন্তার বিকাশ ঘটে।

আজকের ডিজিটালাইজেশনের যুগে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডেটা সায়েন্স নিয়ে কথা বলছি। যার মূল ভিত্তি হচ্ছে গাণিতিক সংখ্যার বিশ্লেষণ এবং গাণিতিক সমীকরণের ব্যবহারিক প্রয়োগ। আজকে বিগ ডেটা প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা লাখ লাখ ডেটা প্রসেস করছি। এই বিশাল ডেটা ভান্ডার বিশ্লেষণ করে আমরা তথ্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারছি, যা সম্ভব হয়েছে পরিসংখ্যানের কারণে। পরিসংখ্যানভিত্তিক তথ্য ও সমীকরণ ব্যবহার করে আমরা বিভিন্ন গাণিতিক মডেল দাঁড় করাতে পারি, যা আমাদের তথ্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক