নবাবের ঈদ ও নাগরিকদের ঈদ

মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর সমাগত। কোনো জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ধর্মীয় উৎসবের চারিত্র চিরকাল একই রকম ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে, অনেক অনুষঙ্গ বর্জিত হয়েছে এবং যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। প্রাচীন মোগল নগরী ঢাকায় উনিশ শতক থেকে ঈদ উৎসব বিশেষ ভাবগাম্ভীর্যে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। ঢাকার নবাব আবদুল গণি, তাঁর পুত্র নবাব স্যার আহসান উল্লাহ এবং তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারী নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ঈদ উৎসবে যোগ করেন নতুন মাত্রা ও আনেন বৈচিত্র্য। নবাবদের ঈদ উদ্যাপনের সঙ্গে যুক্ত করেন নাগরিকদের ঈদ উদ্যাপন।

পরাধীন সামন্ত যুগে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় ছিল, কিন্তু ঈদের উৎসবে অংশগ্রহণে তা কোনো বাধা ছিল না। বস্তুত ঈদ উৎসবের প্রস্তুতি চলত রমজানের চাঁদ দেখারও আগে থেকে। প্রখ্যাত ইউনানী চিকিৎসক ও ইতিহাসবিদ হাকিম হাবিবুর রহমান ১৯৪০-এর দশকে ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছু কথিকা প্রচার করেন। তার একটিতে তিনি বলেন: শবে বরাতের পরেই শহরের সর্বত্র পবিত্র রমজানের আগমন হয়েছে বলে মনে করা হতো। শহরে মসজিদের সংখ্যা অনেক। ২০ রমজানের পর থেকে সেগুলোতে চুনকাম করে পরিষ্কার ঝকঝকে করা হতো। বিত্তবানদের বাড়িতে রাজমিস্ত্রি ও ওস্তাগরেরা কাজে লেগে যেতেন। তাতে বোঝা যেত যে সামনে ঈদ-উৎসব আসছে। গরিবেরাও নিজেদের ঘরদোর সাফসুতরো করত মাটি দিয়ে লেপে। নতুন কলস, সুরাহি, তামাক সেবনের হুক্কা প্রভৃতি কেনা হতো। প্রথম রোজার ইফতারির কেনাকাটাও শুরু হয়ে যেত। ‘তখমে রায়হান’ (তোকমা বিশেষ), শরবতে খেতে এক প্রকার উদ্ভিদের বীজ ‘বালুঙ্গু’, গোলাপের কেওড়া কেনার ধুম পড়ে যেত। ২৭ শাবান নতুন হাঁড়িতে মুগ ভেজানো হতো যাতে পয়লা রমজান তা অঙ্কুরিত হয়। ইফতারির বিচিত্র আয়োজন।

সিয়ামের মাসে অনেকে আখের টাটকা রসের শরবত দিয়ে রোজা ভেঙে ইফতার করা পছন্দ করতেন। এখন যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, সেখানে সরকার থেকে জমি লিজ নিয়ে এক হিন্দু ভদ্রলোক আখ চাষ করতেন। রমজান মাসে তাঁর খেতের অর্ধেকের বেশি আখ শেষ হয়ে যেত। হাকিম হাবিবুর রহমানের ভাষায়:

শাওয়ালের চাঁদ দেখার প্রস্তুতি ছিল ব্যাপক। ছেলেদের সাজি মাটি, খৈল এবং বেসন দিয়ে গোসল করানো হতো। আহসান মঞ্জিল, বড় কাটরা, ছোট কাটরা, হোসেনি দালান ও নদীতীরবর্তী উঁচু দালানের ছাদে সূর্যাস্তের আগে থেকেই লোক জড়ো হতো। অতি উৎসাহীরা নৌকা নিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে চাঁদ দেখার জন্য পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে থাকত। কে আগে দেখে সে প্রতিযোগিতা চলত। চাঁদ দেখামাত্র আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ত সবাই। পটকা, বন্দুক ও তোপধ্বনি চলত কিছুক্ষণ।

নবাব সলিমুল্লাহর জীবনকালে ঢাকায় ঈদুল ফিতর ছিল এক বিশাল ঘটনা। জন্মাষ্টমী, দুর্গাপূজা, মহররমের আশুরা উৎসবেও নবাবের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। জন্মাষ্টমীর মিছিলের আগে নবাব বাহাদুর সুসজ্জিত হাতির পিঠে নবাবপুর রেলগেট থেকে চকবাজার পর্যন্ত যেতেন এবং পথের দুপাশে ছিটিয়ে দিতেন ১ টাকার রুপার মুদ্রা। অভাবগ্রস্ত মানুষেরা তা লুটোপুটি করে কুড়িয়ে নিত। জন্মাষ্টমীর দিন ব্যবহারের জন্য নবাব তাঁর ২৫-৩০টি হাতি হিন্দু নেতাদের এক দিনের জন্য ধার দিতেন।

নবাব সলিমুল্লাহ ঈদের নামাজ আদায় করতেন আহসান মঞ্জিলে তাঁদের নিজস্ব মসজিদে। সেখানে শহরের গণ্যমান্য অনেকেই তাঁর সঙ্গে শরিক হতেন। সাধারণ নাগরিকদের অনেকেই সাহস করে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি ও কদমবুচি করতেন। কেউ কেউ বকশিশ পেতেন। শবে কদরের দিন থেকেই নবাব শহরের গরিবদের মধ্যে বিভিন্ন মহল্লায় বস্ত্র বিতরণ করতেন। ঈদের সারা দিন ইসলামপুর, মিটফোর্ড, চকবাজার প্রভৃতি এলাকায় হাজার দশেক মানুষের তেহারি ও জর্দা-ফিরনি খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকত। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকে সৎভাই খাজা আতিকুল্লাহর সঙ্গে সলিমুল্লাহর তীব্র বিরোধ থাকায় তিনিও প্রতিযোগিতা দিয়ে নাগরিকদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতেন। আতিকুল্লাহও কয়েক হাজার লোককে খাওয়াতেন।

আহসান মঞ্জিল ও দিলকুশা বাগানবাড়িতে (বর্তমানে বঙ্গভবন) পদস্থ ব্রিটিশ কর্মকর্তা, গণ্যমান্য হিন্দু ও আর্মেনীয় খ্রিষ্টানদের জন্য নবাব রাজকীয় পার্টির ব্যবস্থা করতেন। কংগ্রেসের হিন্দু নেতারা ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, কিন্তু ঈদের দিন নবাববাড়িতে সব এক।

কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ যা এবং এখন ঈদ উৎসবে যা নেই তা হলো নাগরিকদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা। নবাব আহসান উল্লাহ, নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন তাঁদের সময়ের সবচেয়ে আধুনিক ও সংস্কারমুক্ত মানুষ। যদিও সলিমুল্লাহ ধর্ম পালনে ছিলেন সবচেয়ে নিষ্ঠাবান, ঈদ উপলক্ষে কলকাতা থেকে ক্ল্যাসিক থিয়েটারকে ভাড়া করে আনা হতো। বিনা খরচে সাধারণ মানুষ ঈদের দিন নাটক দেখতে পারত। তা ছাড়া ঢাকায় ছিল ক্রাউন থিয়েটার ও ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার। তাদের দিয়েও শহরের বিভিন্ন এলাকায় নাটক প্রদর্শন করাতেন সলিমুল্লাহ। কলকাতা থেকে বায়োস্কোপ ভাড়া করে এনে মানুষকে ছায়াছবি দেখাতেন। নিজে গান-বাজনা-নৃত্য দেখতেন না, কিন্তু সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী ও বাইজিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন।

ঈদের দিন নবাব খেলাধুলার আয়োজন করতেন। আজ ক্রিকেটে, ফুটবলে আমরা অনেক এগিয়েছি। তার সূচনা গত শতাব্দীর শুরুতে। ফুটবল, হকি, টেনিস প্রভৃতি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো ঈদুল ফিতরে। সেই সব খেলা হতো পল্টনের মাঠে, মধুর ক্যানটিনের সামনে এখন যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এবং যে জায়গায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহ। সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীরা সেই ঐতিহ্য বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নতুন রাষ্ট্রে আগের অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। পঞ্চাশের দশকে আমরা ঈদের নামাজ পড়তাম লালবাগ শাহি মসজিদে। চার শ বছর আগের পুরোনো স্থাপত্য। দীর্ঘদিনের সংস্কারের অভাবে এখন ধ্বংসের দিকে। আমাদের বাসা ছিল শাহি মসজিদের কাছেই। আবহাওয়া খারাপ থাকলে যেতে হতো সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ঈদের নামাজ পড়তে। গভর্নর নামাজ পড়তেন পল্টনের মাঠে। বর্তমান জাতীয় ঈদগাহ তখন ছিল না। বায়তুল মোকাররম মসজিদও ছিল না। জাতীয় ঈদগাহের জায়গাটি ছিল বিশাল দিঘি। বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা ও নবাবের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা পল্টনে ঈদের নামাজ পড়তেন। কেউ কেউ গভর্নরের বুকে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করে নির্মল আনন্দ উপভোগ করতেন।

ষাটের দশক পর্যন্তও দেখেছি ঈদের আনন্দ উৎসব পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। চকবাজারে তিন দিনের একটি মেলা হতো, যা একটি ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়। সব ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করতেন। সে মেলায় শিশু-কিশোরদের ছিল অপার আনন্দ।

আজ ঈদের আনন্দ একটি নতুন বিত্তবান শ্রেণির মানুষের মধ্যে আটকে গেছে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ করার সুযোগ সীমিত। কেনাকাটার বৈচিত্র্য শুধু বিত্তবানদের মধ্যে। গত সপ্তাহে আমি তেজগাঁওয়ের এক বস্তির বাজারে পুরোনো জামা-কাপড় কিনতে দেখেছি মানুষকে।

গ্রামের কৃষকের ঈদের আনন্দ কতটা, তা তাঁরাই বলতে পারবেন। শস্যের দাম পান না তাঁরা। তাঁদের উপার্জনের একটিই উপায়, শস্য বিক্রি। ঈদের দিন আমরা যে বাসমতী বা কালিজিরা-কালিগুঁড়া চালের পোলাও বিরিয়ানি খাই, সেই চাল যিনি উৎপাদন করেন, তঁার ছেলেমেয়ে ঈদের দিন মোটা ইরি চালের খিচুড়ি খেতে পায় কি না, সে কথা ভাববার কেউ নেই।
তবু আমরা প্রার্থনা করব ঈদের দিনটি হোক সবার জন্য আনন্দের। ঈদ মোবারক।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক