ধান আছে ঈদ নেই

টাঙ্গাইলের কালিহাতীর এক কৃষক পাকা ধান ঘরে তুলতে না পারার ক্ষোভ এবং হতাশায় ফসলের মাঠে আগুন দিয়েছিলেন। আগে কখনো এমন না ঘটা সে কাণ্ডের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সম্পাদকীয়, চ্যানেল টিভি, বিদেশি গণমাধ্যমে ঠাঁই করে নেয় সেই ক্ষোভ আর কষ্টের খবর। কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা সেই কৃষকের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। কলেজের শিক্ষার্থীদের সেই প্রচেষ্টায় লোক দেখানো বা বাহবা পাওয়ার কোনো মতলব ছিল না। কিন্তু সব যখন নষ্টদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তখন একটা ভালো উদ্যোগও লোক দেখানো থেকে লোক হাসানো ভাঁড়ামোতে পরিণত হতে সময় লাগে না। বিবিসি জানাচ্ছে, পাকা ধান না পেয়ে ক্যামেরা আর কথিত গণমাধ্যমকে বসিয়ে না রেখে কেউ কেউ ছবি তোলার জন্য আধা পাকা ধান কাটার ভান করে পোজ দিচ্ছেন।

নাটোর সদরের ইউএনও শক্ত হাতে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রকৃত চাষির কাছ থেকে ধান ক্রয়ের প্রতিজ্ঞা দেখালে সে খবরও দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। একজন নারীর কাছে তাঁর পুরুষ সহকর্মীরা হার মানতে রাজি না হওয়ায় তাঁরাও ক্যামেরা নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন। কেউ দলবল নিয়ে ধান কাটতে যান, কেউ যান ধান কিনতে হাটবাজারে এমনকি কৃষকের বাড়িতে। এসব তামাশার মিছিলে সাংসদ, পুলিশ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী সদ্য ছাত্রনেতা, আমলা, ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য কে নেই। লোক দেখানো এসব কাজ করতে গিয়ে কৃষকের যে জায়গাটা খালি ছিল, সেখানেও যে একটা শক্ত বাঁশ চালান করে দিচ্ছে, তা আর কেউ না বুঝুক, কৃষক ঠিকই টের পাচ্ছেন।

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একটু কষ্ট করে গোড়ায় হাত দিতে গিয়ে এলাকার কথিত পেশিবাজদের হাতে নাকাল হয়েছেন। আরও বড় কিছু যাতে না ঘটে, তার জন্য তাঁকে পুলিশের কাছে যেতে হয়েছে। সরকারি ধান সংগ্রহে বাধা দেওয়া ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র চিঠি লিখেছেন, ‘...স্যার আমি গ্রাম ইসবপুর, উপজেলা ধামুইরহাট, জেলা নওগাঁ থেকে অ...কুমার বলছি। আমি...আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে অধ্যয়নরত। আমার বাবা দি...কুমার তিনি একজন প্রান্তিক কৃষক। আমার এলাকার কৃষকেরা ধানের দাম পাচ্ছেন না আবার সরকার যে প্রতি ইউনিয়ন থেকে ৪০ জন প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা আ...নেতারা নিজেদের নাম দিয়ে দিয়েছেন, এতে আমার এলাকার প্রান্তিক কৃষক ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। তাঁদের সঙ্গে ছলনা করা হচ্ছে, তাঁদেরকে এইভাবে প্রতারণা করা সরকারের উচিত হয়নি। আমার এলাকার মানুষ আর ধান লাগাবে না। ৩৩ শতাংশ ধান কাটতে ৪ হাজার টাকা লাগে। এখন অর্ধেক ধান নিচ্ছেন শ্রমিকেরা আর অর্ধেক কৃষকের। আর ধানের দাম ৫০০ টাকা মণ। কীভাবে তাঁদের টাকা উঠবে? আর ধানের ফলন এক বিঘাতে ১৫-১৬ মণ। বাম্পার ফলন “বাম্পার দাম”। এই আমাদের স্বাধীনতা...’ তৃতীয় বর্ষ সম্মানের ছাত্র অ...কুমারের আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরা হবে কি? হলেও কোন মূল্যে?

এত দৌড়ঝাঁপ, রং-তামাশা কিছুতেই কৃষকের মুক্তি মিলছে না। তিনি তাঁর সহায়-সম্বল বিক্রি করে নগদ খরচ একদম বন্ধ করে ডুবতে থাকা মানুষের মতো কোনোমতে নাকটা জাগিয়ে রেখে বাঁচার চেষ্টা করছেন। অমর্ত্য সেন এই পরিস্থিতিকে বলেছেন ‘লিভিং অন ডিস্ট্রেস সেলিং’।

নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দার গাংধরকান্দা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সামনে পাঁচকাঠা হাটে একটি শিশু একটি রাজহাঁস নিয়ে মন খারাপ করে বসে ছিল। মাঝেমধ্যে সে রাজহাঁসের গলায়, মাথায় হাত বুলাচ্ছিল আর নিচু স্বরে বলছিল, ‘বানু কাঁদিস না।’ বানু আসলে কাঁদে না, কাঁদে শিশুটি।

ধান তার সঠিক বাজারদর না পেলে সে দাম শোধের দায় পড়ে শিশুদের ওপরও। সে দায় মেটাতে ধানের দাম না পাওয়া সন্ধ্যাওয়ালা গ্রামে আলফত আলীর ছেলে মাসুম এসেছে তার প্রাণের ধন খেলার সাথি বানুকে হাটে বিক্রি করতে। এই হাঁস বেচে তাদের তিন ভাইবোনের ঈদের জামা হবে। স্কুলের জামা ছাড়া মাসুমের আর কোনো জামা নেই। তার ছোট ভাই মামুনের তা-ও নেই, মাসুমের ছোট হয়ে যাওয়া ছেঁড়া জামা দিয়ে গা ঢাকে মামুন। বোন আমেনার স্কুলে যাওয়ার একটা জামা থাকলেও বাড়িতে সে মায়ের একটা পুরোনো শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে থাকে। তিনজনই ধান আর ঈদের দিকে তাকিয়ে ছিল। ধানের দাম নেই, বাবা আলফত আলী নাচার। এখন বানুই ভরসা। আমেনা আর মাসুমের কলিজার
টুকরা বেচতে পারলে তাদের ঈদ হবে, নইলে না। মা-বাবার সঙ্গে দেনদরবারে সেটাই সাব্যস্ত হয়েছে। তাই কংস নদ পার হয়ে এই হাটে হাঁস নিয়ে এসেছে মাসুম। আসার আগে আমেনা অনেক যত্ন করে একটু ভাত আর ফ্যান খাইয়ে দিয়েছে বানুকে।

গত ১৪ মে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত একটি লেখায় কুড়িগ্রামের এক ছাত্রের কথা বলেছিলাম, যাঁর বাবা মাসিক খরচের সব টাকা জোগাড় করতে না পেরে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে পুত্রের কাছে মাফ চেয়েছিলেন। সেই পুত্র মেসের সিট আর ধরে না রেখে বাড়ি ফিরে গেছেন। তিনি কি আর কলেজে ফিরতে পারবেন?

নারী চাষি মরিয়ম বেগমের কথা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জেরে সবাই জেনে গেছে। বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার তালোড়া ইউনিয়নের দেবখণ্ড গ্রামের মরিয়ম বেগম ধান কাটার পর ঘরের রঙিন টেলিভিশন দিয়ে শ্রমিকদের মজুরি মিটিয়েছেন। কারণ, হাটে ধানের দাম কম থাকায় তিনি ধান বিক্রি করতে পারেননি। তাঁর হাতে শ্রমিকদের দেওয়ার মতো টাকা ছিল না।

ধানের দামের দায় শোধার এক মর্মান্তিক বলি হতে যাচ্ছে সদ্য এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা। সরকারি হিসাব বলছে, এখন পর্যন্ত এসএসসিতে উত্তীর্ণদের মধ্যে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির আবেদন করেনি। যঁারা ঝরে পড়ার কারণ নিয়ে কাজ করেন, তঁাদের অনেকের মতে, ওপরের দিকে শিক্ষার ব্যয় ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হচ্ছে। ধানের দাম না পেলে সেই খরচ মেটাবেন কীভাবে কৃষক পিতা?

(লেখায় ব্যবহৃত নামগুলো প্রকৃত নাম নয়)

গওহার নঈম ওয়ারা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকর্মী ও গবেষক