জাপানের নামবিভ্রাট

জাপান চায় তাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম শিনজো আবে নয়, আবে শিনজো লেখা হোক। ছবি: রয়টার্স
জাপান চায় তাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম শিনজো আবে নয়, আবে শিনজো লেখা হোক। ছবি: রয়টার্স

নাম সংকটে ভুগছে জাপান। সংকট বেশ গভীর। কোনটা আগে আসবে—নাম না পদবি, তা নিয়ে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় ভুগছেন দেশের ক্ষমতাসীন মহলের অনেকে। কেউ আবার এটাকে দেখছেন জাপানের প্রতি বিদেশিদের অবজ্ঞা-প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত হিসেবে। চীন ও কোরিয়ার বেলায় সেই সব দেশের প্রচলিত নীতি অনুসরণ করা হলে জাপানের বেলায় তা নয় কেন? এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও আগ বাড়িয়ে বিদেশের সংবাদমাধ্যমকে অনুরোধ জানাতে হয়েছে তারা যেন ভুল শুধরে নিয়ে এখন থেকে জাপানের প্রচলিত রীতি অনুসরণ করে নামের আগে পারিবারিক পদবি ব্যবহার করে, যেমনটা করা হয় পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের বেলায়। অর্থাৎ শিনজো আবে নয়, তাঁর বেলায় পুরো নাম লিখতে হবে এবং উচ্চারণ করতে হবে আবে শিনজো।

পশ্চিমের দেশগুলোতে অনেক আগে থেকেই পশ্চিমের নিজস্ব কায়দায় জাপানিদের নাম লেখা এবং উচ্চারিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে আবার চীনা ও কোরীয়দের নামের বেলায় এরা অনুসরণ করছে সেই সব দেশের প্রচলিত রীতি। ফলে কেন এমন বৈষম্য, সেই প্রশ্ন অনেকেই করছেন এবং জাপানের সংবাদমাধ্যমও পিছিয়ে নেই। প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়ায় যেসব তথ্য এখন উদ্‌ঘাটিত হচ্ছে, সেগুলো কিন্তু এই নামবিভ্রাটের উৎস হিসেবে জাপানের দিকেই নির্দেশ করছে। অর্থাৎ, পশ্চিমের নিজের পছন্দ অনুযায়ী এমন ঘটেনি, বরং সেটা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জাপানে ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের সচেতন প্রচেষ্টার ফলাফল।

জাপানের ইতিহাসে ১৮৬৮ সালকে বড় এক মাইলফলক হিসেবে দেখা হয়। সে বছর দক্ষিণ-পশ্চিম জাপানের একদল সমর নায়কের যৌথ নেতৃত্বে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থানে তোকুগাওয়া শোগুন প্রশাসনকে ক্ষমতার হাল ছেড়ে দিয়ে সম্রাটের হাতে সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল এবং এর মধ্যে দিয়ে জাপানে বইতে থাকে যুগান্তকারী অনেক পরিবর্তনের হাওয়া। জাপানের ইতিহাসে এটা মেইজি পুনরুত্থান নামে পরিচিত। মেইজি পুনরুত্থানের শুরুতে বর্বর বা বিদেশিদের দেশ থেকে খেদিয়ে দেওয়ার স্লোগান প্রচলিত থাকলেও ক্ষমতা হস্তগত হয়ে যাওয়ার পর কিন্তু সেই স্লোগান থেকে নতুন নেতৃত্ব কেবল সরেই আসেনি, বরং পশ্চিমকে অনুসরণ করে সেই সব দেশের সমকক্ষ হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বানও একই নেতৃত্ব জানাতে শুরু করেছিলেন।

সেই পথ ধরে যুগান্তকারী যেসব পরিবর্তন জাপানে তখন শুরু হয়, তা কেবল শিল্পায়ন এবং সমরশক্তি সংহত করার পথেই জাপানকে নিয়ে যায়নি, একই সঙ্গে সমাজের নানা ক্ষেত্রে নিয়ে এসেছে তোলপাড় তোলা নানা রকম রদবদল, যার কোনো কোনোটি জাপানের বেলায় উপকারী হয়ে দেখা দিলেও অন্য কিছু রদবদলের বেলায় আবার যুক্তিসংগত কারণ সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। নতুন প্রশাসন যেমন শুরুতে যেসব আদেশ জারি করেছিল তার মধ্যে ছিল সামুরাই যোদ্ধাদের তরবারি বহনে নিষেধাজ্ঞা এবং এদের চুল ছেঁটে নিয়ে ভদ্র হওয়ার নির্দেশ। পুনরুত্থান–পরবর্তী প্রশাসন অবশ্যই মনে করে থাকবে যে, অতীতের সেই সব প্রচলিত রীতির সবটাই হচ্ছে সেই সভ্য সমাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যে রকম সভ্য ও উন্নত নিজেদের দেশকে তারা করে নিতে চাইছেন। ফলে পোশাক–পরিচ্ছেদের বেলায় নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ কেবল সামুরাই যোদ্ধাদের জন্যই সীমিত ছিল না, সাধারণ নাগরিকদেরও পশ্চিমের অনুকরণে পোশাক পরার প্রতি আকৃষ্ট করা হয়। পাশাপাশি পশ্চিমের দেশগুলোতে প্রচলিত খাদ্যাভ্যাসও সেই সময় থেকে জাপানে চালু হতে শুরু করে। মেইজি পুনরুত্থান দেশে নানা রকম নতুন যা কিছু নিয়ে এসেছিল, তার মধ্যে একটি হচ্ছে পাউরুটি। পাউরুটি খাওয়া পশ্চিমের মানুষ শারীরিক বলে বলীয়ান হয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে সক্ষম বলে নেতৃত্বের কাছে মনে হয়েছিল এবং ভাতের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে পাউরুটি খেয়ে দেশের কল্যাণে পরিশ্রম করে যাওয়ার পরামর্শ নেতৃত্ব তখন জনগণকে দিয়েছিলেন।

আমরা জানি, সেই পথ ধরে জাপান খুব অল্প সময়ের মধ্যে যে অগ্রসর এক শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়, তাই কেবল নয়। একই সঙ্গে পশ্চিমের অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়মাবলি জাপানে প্রবর্তিত হওয়ায় এ দেশের মানুষ তা থেকে অবশ্যই উপকৃত হয়েছিলেন। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার সূচনাও জাপানে সেই মেইজি পুনরুত্থান–পরবর্তী সময়ে এবং এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে জাপান সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল ১৮৯০ সালে। পাশাপাশি সীমিত আকারে হলেও জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সংসদও জাপানে গঠিত হয় অনেকটা সেই সময়ে, যদিও সম্রাটের একচ্ছত্র ক্ষমতার পাশাপাশি সেই সংসদের ক্ষমতা ছিল উজ্জ্বল আলোর নিচে জ্বলতে থাকা মাটির প্রদীপের মতো।

মেইজি পুনরুত্থান–পরবর্তী এ রকম সব যুগান্তকারী পরিবর্তনের মধ্যে জাপান সামনে এগিয়ে যেতে থাকার মুখে দেশের নেতৃত্বের একাংশের মধ্যে এশিয়া সম্পর্কে তাচ্ছিল্যের মনোভাব তৈরি হতে শুরু করে এবং এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের সবকিছুকেই এরা পিছিয়ে থাকার প্রতীক হিসেবে দেখতে শুরু করেন। নামের ব্যাপারটিও এদের এ রকম আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। জাপানের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা যেহেতু ছিল পশ্চিমের সমকক্ষ হয়ে ওঠা, ফলে সবকিছুতেই পশ্চিমের রীতি অনুসরণ করাকে সেই সময়ের নেতৃত্ব দেখেছিল অগ্রযাত্রার প্রতীক হিসেবে এবং সেই হিসাব–নিকাশ থেকে পশ্চিমের কায়দায় বিদেশিদের সামনে জাপানিদের নামের পরিচয় তুলে ধরতে পশ্চিমে প্রচলিত ধারাকে এরা গ্রহণ করেন। চীন কিংবা কোরীয় উপদ্বীপে কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি এবং এর ফল চীনা ও কোরীয়দের নামের বেলায় প্রচলিত রীতি বিদেশের জন্যও অপরিবর্তিত থেকে গিয়েছিল।

ফলে জাপানিদের নামের এই তথাকথিত ভ্রান্ত উচ্চারণের জন্য বিদেশিদের উন্নাসিকতাকে নয়, বরং ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে জাপানিদের সর্বক্ষেত্রে পশ্চিমকে অনুসরণের প্রয়াসকে দায়ী করা যেতে পারে। সেই ভুল এখন জাপানের নেতৃত্ব সংশোধন করে নিতে এগিয়ে এসেছেন। তবে দেশের সবাই যে এই প্রশ্নে একমত তা অবশ্য নয়। জনসংখ্যার বড় এক অংশ এই বিতর্কের পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ দেখছেন না এবং নামবিভ্রাট নিয়ে অযথা উদ্বেগও এদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।

লেখক প্রথম আলোর টোকিও প্রতিনিধি