মোদির দ্বিতীয় ইনিংস, 'দিগ্ভ্রান্ত' রাহুল

এবারের নির্বাচনে বিজয়ী মোদি। ফাইল ছবি
এবারের নির্বাচনে বিজয়ী মোদি। ফাইল ছবি

ইতিহাস হয়তো এভাবেই ফিরে ফিরে আসে। ১৫ বছর আগে যাদের কাছে আঘাতটা ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো, ১৫ বছর পর তারা এভাবে অট্টহাসিতে ফেটে উঠতে পারত না। দেড় দশক আগের বিজয়ীরা এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছে, আচম্বিতে পরাজয়ের বেদনা কেমন হয়।

দেড় দশকের ব্যবধানের কুশীলবেরা অপরিবর্তিত। পার্থক্য একটাই। সেবার পরাজয়ের ক্ষতে প্রলেপ দিতে হয়েছিল যাঁকে, পনেরো বছরের ব্যবধানে তাঁর উত্তরসূরির নেওয়া মধুর প্রতিশোধ তিনি দেখে যেতে পারলেন না। অটল বিহারি বাজপেয়ির প্রয়াণ ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তির একমাত্র ব্যতিক্রম।

১৫ বছর আগে ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটের ফল ছিল অপ্রত্যাশিত। বাজপেয়ির নেতৃত্বাধীন সরকার ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এ ঝলমলে গরিমায় ভাসা সত্ত্বেও আরও একবার ক্ষমতাসীন হতে পারবে না, এই ভাবনা দুঃস্বপ্নেও কারও মনে উদয় হয়নি। সেই ধাক্কা বিজেপিকে বহুদিন আহত করে রেখেছিল। কী আশ্চর্য, ঠিক তেমনই এক ধাক্কায় এখন কুপোকাত সেই দিনের বিজয়ী দল কংগ্রেস! ৪৪ সংখ্যাটি যে পাঁচ বছরে বেড়ে মাত্র ৫২-য় আটকে যাবে, এই দুঃস্বপ্ন থেকে আজও কংগ্রেস বের হতে পারল না। কবে পারবে, আদৌ পারবে কি না, কিংবা পারলেও কতটা, সেই ভাবনা নিরন্তর ঘোরাফেরা করছে স্থবির হয়ে যাওয়া ২৪, আকবর রোডে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো স্থাপিত হয়েছে আকবর রোডেই সেনাপ্রধানের বাড়ির সামনে ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমানের প্রতিকৃতি। এবারের ভোটে ‘রাফাল’-ই ছিল কংগ্রেস সভাপতির তূণের সেরা বাণ। সেই ‘রাফাল’ এখন দিবারাত্র তাঁকে ও তাঁর দলকে পরিহাস করছে। রাজনীতির ঈশ্বর সম্ভবত এমনই হয়ে থাকেন। রাজা ও ফকিরের অবস্থান এভাবেই বদলে বদলে দেন।

আচমকা ফকির হয়ে যাওয়া কংগ্রেস দুসপ্তাহ কেটে গেলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারল না। নরেন্দ্র মোদির সরকার যেখানে কাজ শুরু করে দিয়েছে, সেখানে কংগ্রেস সভাপতি পদে রাহুল গান্ধী থাকছেন কি না, আজও তা খোলসা করে কেউ জানাল না। দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে রাহুল ইস্তফাদানের কথা জানান। সেদিনই বাকি সদস্যরা তা খারিজ করে দিলেও রাহুল তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। দলীয় সভাপতি হিসেবে এখনো, এই দুসপ্তাহ পরেও তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। এই সময়ের মধ্যে কংগ্রেস সংসদীয় দলের বৈঠক হয়েছে। সেখানে সংসদীয় দলনেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন সোনিয়া গান্ধী। কিন্তু দলের সভাপতি রাহুলই থাকছেন এবং লোকসভায় তিনিই হবেন দলের নেতা, এত দিনেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হলো না। এতখানি জবুথবু হয়ে যেতে কংগ্রেসকে আজ পর্যন্ত কেউ কখনো দেখেনি।

এই সময়ের মধ্যে আরও একটা সিদ্ধান্ত কংগ্রেস নিয়েছে। দল জানিয়েছে, আগামী এক মাস দলের কেউ কোনো টেলিভিশন চ্যানেলের বিতর্কে অংশ নেবে না। ভোটের ফল পর্যালোচনায় আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো বসেনি। যা কিছু আলোচনা সবই ঘরোয়া। রাহুল দু-একবার প্রকাশ্যে এসেছেন মাত্র। কিন্তু তাঁর শরীরী ভাসা মাজা ভেঙে নুয়ে পড়া মহিরুহের মতো। সেই অবয়বে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। নেই কোনো বরাভয়ের চিহ্ন। যা আছে তা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা ও বেদনার পোচ।

রাহুল গান্ধী
রাহুল গান্ধী

এই হতাশজনক পরাজয় টলমল করে তুলেছে রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসের সংসার। কর্ণাটকে জোট সংসারের নৌকোর দুলুনি প্রথম থেকেই ছিল। ভোটের ফল বেরোনোর পর সেই দুলুনি আচমকাই বেড়ে গেছে। বিক্ষুব্ধদের কোমর থেকে বেরিয়ে আসছে একেকটি অস্ত্র। একেকজন নেতা একেক ধরনের বিবৃতি দিতে শুরু করেছেন, যা রাজ্যের বিরোধী বিজেপিকে ক্ষমতা দখলের আশায় বুক বাঁধতে সাহায্য করছে। মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামীর সঙ্গে রাহুলের কথা হয়েছে। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের প্রস্তাবও বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু তবুও বিক্ষুব্ধ স্বর স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ নেই। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা রামলিঙ্গম রেড্ডি সরাসরি রাহুলকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, বয়স্ক নেতাদের সরিয়ে রেখে দল চালালে এমনই হয়। বিবাদ প্রকাশ্যে টেনে এনেছেন রাহুলই। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট এবং মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথের নাম করে তিনি বলেছিলেন, নিজেদের ছেলেদের জেতানোর জন্য তাঁরা যতটা ব্যাকুল ছিলেন, তার কিঞ্চিৎ মাত্র আগ্রহ দলের জন্য দেখাননি। অশোক গেহলটের ছেলে বৈভব যোধপুরে হেরেছেন, কমলনাথের ছেলে নকুল জিতেছেন ছিন্দওয়াড়া আসন। রাজস্থানের ২৫টি আসনের একটাও এবারও কংগ্রেস জেতেনি। যেমন জেতেনি গুজরাটের ২৬, দিল্লির ৭, হরিয়ানার ১০, হিমাচল প্রদেশের ৪ এবং উত্তরাখন্ডের ৫ আসনের একটাও। মধ্যপ্রদেশের ২৯ আসনের মধ্যে গতবার কংগ্রেস ২টি জিতেছিল, এবার একমাত্র নকুলই শিবরাত্রির সলতে।

মধ্যপ্রদেশে ততটা না হলেও রাজস্থানে কংগ্রেস দল ও সরকারে গেল গেল ভাব। তুমুল লেগে গেছে প্রবীণ গেহলট ও নবীন শচীন পাইলটের মধ্যে। দুই নেতার অনুগামীরা কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। প্রতিদিন দুই পক্ষই সংবাদের শিরোনামে। মহারাষ্ট্রে ভোটের আগেই কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়েছিল। তা এখনো অব্যাহত। দিন কয়েক আগে বহিষ্কৃত হন কংগ্রেস বিধায়ক আবদুল সাত্তার নবী, এই সেদিন হল ছাড়লেন প্রবীণ রাধাকৃষ্ণ ভিকে পাতিল। দুজনেই বিজেপিতে যাচ্ছেন বলে খবর। তাঁদের দাবি, আরও ৮-১০ জন কংগ্রেস বিধায়ক নাকি বিজেপিতে যেতে পা বাড়িয়ে রয়েছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অশোক চহ্বানের হাল রাহুলেরই মতো।

দিন তিনেক আগে দিল্লিতে রাহুল দেখা করেন এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ারের সঙ্গে। বৈঠকের পর কীভাবে যেন ছড়িয়ে পড়ে, দুজনের মধ্যে দুই দলের মিলন নিয়ে নাকি কথা হয়েছে। পাওয়ারের দিক থেকে তা বারবার অস্বীকার করা হয়। রাহুলের মুখ অবশ্য যথারীতি বন্ধ। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিরোধের ফলে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পাওয়ার প্রথমবার কংগ্রেস ত্যাগ করেছিলেন। পরে ভুল বুঝে ফিরে এলেও সোনিয়া গান্ধীর ‘বিদেশিনী’ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে দ্বিতীয়বারের মতো দলত্যাগ। ক্যানসারকে জয় করে ফিরে এলেও দলের দুর্দশা ঠেকাতে ক্রমে ব্যর্থ হচ্ছেন শরদ পাওয়ার। ক্রমেই হীনবল হচ্ছেন তিনি। নিজের খাসতালুক বারামতীতে এবার কোনো রকমে জেতাতে পেরেছেন কন্যা সুপ্রিয়া সুলেকে। কিন্তু ভাইপো পার্থ পাওয়ারকে জেতাতে পারেননি। তাঁর সঙ্গ একে একে ছেড়ে গেছেন মেঘালয়ের পূর্ণ সাংমা, বিহারের তারিক আনোয়ার। রাজনৈতিক জীবনের উপান্তে এসে ফের একবার ‘ঘরে ফিরে’ মিলেজুলে বাঁচার ইচ্ছা যদি তাঁর মনে চাগাড় দেয়, তাহলে সেই ভাবনাকে আমল না দেওয়া উচিত হবে কি না, তা ভেবে দেখার সময় তাঁর মতো আরও দলত্যাগী কংগ্রেসিদের বিবেচনা করা দরকার। বিজেপির সর্বগ্রাসী ক্ষুধা ক্রমেই গিলে ফেলছে ছোট ছোট আঞ্চলিক দলগুলোকে। এই অবস্থায় আগামী দিনে বেঁচে থাকার উপায়ের খোঁজ এখন থেকেই শুরু না করলে ভবিষ্যতে ভেসে যেতে হতে পারে। এবারের ভোট সেই দিক দিয়ে শরদ পাওয়ার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী, অখিলেশ, চন্দ্রশেখর রাও এবং অবশ্যই রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ।

ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াইয়ের কথা শুনিয়েছেন রাহুল। কিন্তু যুদ্ধে নামার আগে ঘর যে গুছিয়ে নিতে হয়? সেই কাজটাই তো এখনো অধরা। অন্যদিকে, নরেন্দ্র মোদি তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের রান সংগ্রহে নেমে পড়েছেন। অসম এই মোকাবিলায় ‘দিগ্ভ্রান্ত’ রাহুল কীভাবে দলের হাল ধরবেন, এখনো অজানা।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় : প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি