ঐক্যফ্রন্টের আয়ু আর কত দিন

রাজনীতিতে এখন মন্দা চলছে। ‘মন্দা’ বিষয়টি অর্থনীতির সঙ্গে বেশি খাপ খায়। অর্থনৈতিক মন্দা অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়। তখন বাজারে গতি আনতে রাষ্ট্রকে বিনিয়োগকারীর ভূমিকায় নামতে দেখা যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ এখনো আমাদের পাঠ্যসূচিতে আছে। আমাদের দেশেও বড় ধরনের ‘ডিপ্রেশন’ দেখেছি শেয়ারবাজারে। এ রকমটি ঘটেছে কমপক্ষে দুবার। সম্প্রতি তৃতীয় উদাহরণটি তৈরি হচ্ছে বলে কেউ কেউ আভাস দিচ্ছেন। শেয়ার মার্কেটকে ফাটকা বাজার বলে ডাকা হয়। এটা অনেকটাই বিধিবদ্ধ জুয়া খেলা। তা না হলে ১০ টাকার শেয়ার হাজার টাকায় কেনাবেচা হবে কেন? এ বাজারে এসে কারও বরাত খোলে, কারও কপাল পোড়ে।

রাজনীতির বাজারটিও এ রকম হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাদের অধিকাংশই জেলে ছিলেন। মাঠপর্যায়ে সংগঠনকে তখন সক্রিয় দেখা যায়নি। দারুণ একটা মন্দাভাব। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের জোয়ারে রাজনীতির ওই মন্দাভাব কেটে গিয়েছিল। তারপরও রাজনীতির তেজিভাব বেশি দিন বজায় থাকেনি। ১৯৭৫, ১৯৮২ ও ২০০৭ সালে আবারও মন্দার কবলে পড়েছিল জাতীয় রাজনীতি। এখানে রাজনীতি উচ্চবর্গের কবজায় কিংবা গোষ্ঠীতন্ত্রের খপ্পরে পড়েছে। রাজনীতির নাটাইটা অনেক সময় তাদের হাত থেকে ছিটকে পড়ে। শেয়ারবাজারের উত্থান-পতন যেমন সাধারণ মানুষকে ছুঁতে পারে না, তেমনি রাজনীতির কমেডি-ট্র্যাজেডি নিয়েও আমজনতার মাথাব্যথা নেই। কৃষককে পানির দামে ধান বেচতে হয়, চড়া সুদে টাকা ধার করতে হয়। বেকার তরুণকে ভিটেমাটি বেচে অনিশ্চয়তার পথে সাগর পাড়ি দিয়ে আশ্রয়শিবিরে জায়গা নিতে হয়, কিংবা সাগরের পানিতে ডুবে মরতে হয়। রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, ফ্রন্ট, ব্যানার, স্লোগান, মেনিফেস্টো, মিশন-ভিশন নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়, সুযোগ কিংবা ইচ্ছা আছে কয়জনের। তরুণদের চিন্তা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে এগুলো কোথায় বেচবে, কোন বাজারে।

রাজনীতির বারান্দা, বৈঠকখানা কিংবা অন্দরমহলে যাঁরা হাঁটাহাঁটি করেন, তাঁরা এবং গণমাধ্যম এখনো রাজনীতির পিদিমের সলতে জ্বালিয়ে রেখেছেন। মাঝেমধ্যে পিদিমের তেল ফুরিয়ে যায়। তখন আবার তেল ঢালতে হয়। তখন নিবু নিবু রাজনীতি হঠাৎ করেই জ্বলে ওঠে। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির পিদিম সহসা জ্বলে উঠেছিল।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। বিরোধী শিবিরকে এভাবে ‘সিঙ্গেল ডিজিটে’ নামিয়ে আনা হবে, এটা তাঁদের কাছে ছিল অভাবনীয়। আবার অনেকেই অবাক হননি। তাঁদের মতে, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। বেশি সৈন্যসামন্ত, হাতি-ঘোড়া আর বন্দুক-কামান থাকলেই যুদ্ধে জেতা যায় না। যুদ্ধে জিততে হয় কৌশলে। রবার্ট ক্লাইভ আর সিরাজউদ্দৌলার যুদ্ধ এটা আমাদের শিখিয়েছে। এটা তো বহুল প্রচলিত কথা—প্রেম, যুদ্ধ আর রাজনীতি ন্যায়শাস্ত্র পড়ে জেতা যায় না। দরকার নানান ছলাকলার।

গত ডিসেম্বরের নির্বাচনের একটি বড় চমক ছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এর নেতা ড. কামাল হোসেন। তাঁর নেতৃত্বে সাবেক আওয়ামী লীগাররা বর্তমান আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এককাট্টা হলেন। সঙ্গী হলো আওয়ামী লীগের চরম বৈরী বিএনপি। কানকথা শোনা যায়, এটাও নাকি একটা খেলা। বিএনপি গোঁ ধরেছিল, তারা নির্বাচনে যাবে না। কামাল হোসেন তাদের নির্বাচনে নিয়ে এলেন। ফ্রন্টের নেতা কামাল হোসেন, তাঁর একটা ফেসভেল্যু আছে। নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাঁর ভালো পরিচিতি আছে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে যে দলগুলো (বিএনপি ছাড়া) একত্র হয়েছিল, তাদের সাইনবোর্ড ছাড়া আর কোনো শক্তি ছিল না। ওই শক্তির জোগান বিএনপি দেবে, এটাই ছিল হিসাব। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের কৌশলের কাছে তারা হেরে গেল। এখানে সরকারের লাভ হলো দুটো। এক. বিএনপিকে তারা নির্বাচনে এনে দেখাতে পারল যে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ হয়েছে। দুই. ঐক্যফ্রন্টের সাতজনকে সংসদ ভবনে ঢুকিয়ে সরকার আবারও দেখাতে পারল, সংসদে বিরোধী দল মানেই ‘গৃহপালিত’ নয়, সত্যিকার বিরোধী দলও আছে। বিএনপিও শেষমেশ বলল, নির্বাচন, সংসদ, সবই অবৈধ। তবু যতটুকু স্পেস পাওয়া যায়, তাকে কাজে লাগাতে হবে।

নানান মেরুর নেতা ও দলকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। কারও কারও চিন্তাভাবনা ও কাজকর্ম একেবারেই বিপরীতধর্মী। এই প্ল্যাটফর্মে একধরনের জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ ‘জয় বাংলা’ আর ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ একই ছাদের তলায় মিলেমিশে ছিল। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল নিতান্তই একটি নির্বাচনী আঁতাত। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরও এটি কাগজে-কলমে টিকে আছে কেন এবং কীভাবে, তা নিয়ে আছে নানান আলোচনা।

ঐক্যফ্রন্টের তার ছিঁড়ে গেছে, বেসুরো আওয়াজ বের হচ্ছে। আবদুল কাদের সিদ্দিকী ইতিমধ্যে একটি আলটিমেটাম দিয়েছেন। ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে শুরু থেকেই ২০-দলীয় জোটে অস্বস্তি ছিল। তারা ভেবেছে, তাদের বেশি দাম দেওয়া হচ্ছে না। ‘স্টেজ শো’ ছিনতাই করে নিয়েছেন কামাল হোসেন। ২০-দলীয় জোটের সঙ্গী লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা অলি আহমদ হুংকার দিয়ে বলেছেন, ‘বিএনপি যদি নেতৃত্ব দিতে না পারে, তাহলে আমাদের হাতে অর্থাৎ ২০-দলীয় জোটের হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দিক।’ ২০-দলীয় জোটের অন্যতম সঙ্গী জামায়াতে ইসলামী এখন ঘাপটি মেরে আছে। তাদের পাঁচজন নেতার ফাঁসি এবং দুজনের আমৃত্যু কারাবাসের দণ্ড পাওয়ার পরও দলটি ভেঙে পড়েছে, এটা বলা যাবে না। বিএনপির নেতৃত্ব এখনো মনে করে, জামায়াত হলো তাদের দুর্দিনের সাথি এবং সত্যিকারের খুঁটি। তাদের কিছু লোকজন ভাগিয়ে এনে একটা প্রকাশ্য সভা করে নতুন দল বানানোর ঘোষণা দেওয়া হলেও তা সাড়া জাগাতে পারেনি।

বিএনপি-জামায়াত আঁতাত বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট সখ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যেন গলার কাঁটা, গেলা যায় না, উগরানোও যায় না। প্রকাশ্যে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা, বিশেষ করে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম বলছে, তাদের সম্পর্ক বিএনপির সঙ্গে, জামায়াতের সঙ্গে নয়। কিন্তু বিএনপি যে জামায়াতকে ছাড়ছে না, এটা তারা ভালো করেই জানে।

প্রশ্ন হলো, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আয়ু আর কত দিন? তাদের এক শরিকের নেতার সঙ্গে সম্প্রতি আলাপ হলো। আক্ষেপ করেই বললেন, ‘আমরা যাব কোথায়? কামাল হোসেন তো জমাতে পারছেন না। রাজনীতি এখন যেভাবে চলে, তা তিনি বোঝেনই না।’

অক্সফোর্ড মজলিশের সাবেক সভাপতি কামাল হোসেন বাংলাদেশের রাজনীতির পিচ্ছিল পথঘাটে বড়ই বেমানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেড়ে দেওয়া আসনে তিনি উপনির্বাচনে জিতে ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে সাংসদ হয়েছিলেন। এরপর আর কোনো নির্বাচনেই তিনি জিততে পারেননি। রাজনীতি এখন যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, সেখানে তাঁর মতো লোকের টেকা দায়। তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ হলো আমাদের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে একটি সংবিধান তৈরি করা। তিনি রাজনীতিতে না থাকলেও এই কীর্তির জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি বিশেষজ্ঞের মর্যাদায় ছিলেন। যা তিনি নন, তা হতে গিয়ে তিনি বারবার হোঁচট খাচ্ছেন। আবার উঠে দাঁড়াতে পারবেন বলে মনে হয় না। এটা তাঁর দোষ কিংবা অক্ষমতা নয়। এটা হয়তো আসলেই তাঁর পথ নয়। তাঁকে আঁকড়ে ধরে বিএনপি একটু দম নেওয়ার ফুরসত পেয়েছিল। এভাবে চলবে কত দিন?

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]