বাংলাদেশ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে: হুমায়ুন কাইয়ুমি

ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কাইয়ুমি
ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কাইয়ুমি
>
আফগানিস্তানের বর্তমান অর্থমন্ত্রী এবং সে দেশের প্রেসিডেন্টের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কাইয়ুমি একাধারে প্রকৌশলী ও অধ্যাপক। তিনি প্রথম আফগান নাগরিক, যিনি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিসহ যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ছিলেন। ১৯৫২ সালে আফগানিস্তানের সাধারণ একটি পরিবারে জন্ম তাঁর। সম্প্রতি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের সমাবর্তনে প্রধান বক্তা হয়ে চট্টগ্রামে এসেছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে মুখোমুখি হন প্রথম আলোর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমেদ মুনির।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে প্রথমবার এসেছেন। কেমন অনুভূতি?

হুমায়ুন কাইয়ুমি: উপভোগ্য সফর। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তা অভাবনীয়। চট্টগ্রামে এসে এই উন্নতির নজির দেখলাম। বাংলাদেশের এই সাফল্য আফগানিস্তানের জন্য শিক্ষণীয়। বিশ্বের খুব কম দেশেরই এমন অর্জন রয়েছে। বিশেষ করে ৮ শতাংশের কাছাকাছি জিডিপি আর কয়টা দেশের আছে? কেবল অর্থনৈতিক অগ্রগতি নয়, জন্মনিয়ন্ত্রণ, মানবসম্পদের উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এ দেশের অর্জন খুবই উজ্জ্বল।

প্রথম আলো: শিক্ষা নিয়ে কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়। যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ছিলেন। আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয় কাজে আসছে।

হুমায়ুন কাইয়ুমি: অবশ্যই এই অভিজ্ঞতা ভীষণ কাজে দিচ্ছে। আমি প্রেসিডেন্টের মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করছি। চার বছরের মধ্যে দুই বছর এর মধ্যেই পার হয়েছে। এই সময়ে প্রাথমিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকার শিশুরাও এতে শিক্ষার আওতায় আসছে। পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্যক্রমও ঢেলে সাজানো হয়েছে একুশ শতকের উপযোগী করে। উচ্চশিক্ষার পরিসরও বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে ২৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে আফগানিস্তানে। আমি প্রাথমিকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়নের চেষ্টা করছি।

প্রথম আলো: শিক্ষকতার এমন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার ছেড়ে কেন রাজনীতিতে যোগ দিলেন? কী করে এই পরিবর্তন সম্ভব হলো?

হুমায়ুন কাইয়ুমি: সরকারে যোগ দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু এখনো রাজনীতিতে তেমন আগ্রহ জন্মায়নি। অবশ্য এ কথা ঠিক যে সরকার পরিচালনা করতে গেলে রাজনীতি এড়ানো সম্ভব নয়। আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন করেছি, তখনো টুকটাক রাজনীতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি মনে করি, প্রত্যেক মানুষেরই রাজনৈতিক সত্তা রয়েছে। আর একজন ভালো ব্যবস্থাপককে সবকিছু মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় আনতে হয়, যৌক্তিক হতে হয়, বুঝতে হয় সমকালের রাজনীতিও।

প্রথম আলো: সম্প্রতি একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক গণমাধ্যমে। কৃত্রিম পা সংযোজনের পর খুশিতে এক আফগান শিশু হাসপাতালে নাচতে শুরু করেছিল। এই ভিডিও দেখে মনে হয়েছে, এটা যেন এ সময়ের আফগানিস্তানের প্রতীকী ছবি। যার এক পাশে আছে বেদনা আর অন্য পাশে আশা। শেষ পর্যন্ত কোনটি জিতবে বলে মনে করেন?

হুমায়ুন কাইয়ুমি: আমি মনে করি, শেষ পর্যন্ত মানবতার শক্তির জয় হবে। আমাদের দেশের একটি গোষ্ঠীকে এবং প্রতিবেশী কিছু দেশকে বুঝতে হবে, তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই আফগানিস্তানে শান্তির দরকার আছে। সমৃদ্ধ আফগানিস্তান না হলে এই অঞ্চলের সমৃদ্ধিও থেমে যাবে। বাংলাদেশও এমন উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড, সামরিক শাসন—সবই দেখেছে। কিন্তু এখন বাংলাদেশ তো সেসব কাটিয়ে উঠে সারা বিশ্বের সামনে সাফল্যের উদাহরণ। তাহলে আফগানিস্তান কেন পারবে না?

প্রথম আলো: কিন্তু আফগানিস্তানের সামাজিক কাঠামো এ দেশের তুলনায় জটিল।

হুমায়ুন কাইয়ুমি: ঠিক, জটিলতা আছে। এখানে জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় বিভক্তি আছে। কিন্তু আপনি যখন সবকিছু একসঙ্গে মেশাবেন, তখন তো মানুষই থাকবে কেবল। আর সব পরিচয় মুখ্য থাকবে না। যদি লক্ষ করেন দেখবেন, সোভিয়েত দখলদারির আমল থেকে তালেবানের শাসনামল পর্যন্ত আফগানিস্তানের অসংখ্য চিকিৎসক, অধ্যাপক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষকে জেলে যেতে হয়েছে, দেশত্যাগ করতে হয়েছে, নয়তো তঁারা খুন হয়েছেন। এক অভাবনীয় মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গেছে দেশটি। তবু মানুষ কখনোই দমার পাত্র নয়। মানুষের প্রবণতাই হলো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

প্রথম আলো: আফগানিস্তানের ক্রিকেট দলের খেলা দেখলে মনে হয়, কোনো কিছুই তাদের আটকে রাখতে পারবে না। সাধারণ আফগানদের মধ্যেও এমন সম্ভাবনা আছে নিশ্চয়ই।

হুমায়ুন কাইয়ুমি: আফগান ক্রিকেটাররা এখন জাতীয় অনুপ্রেরণার উৎস। এটা প্রমাণ করে, আমাদের সামর্থ্য আছে, শক্তি আছে। নানা ক্ষেত্রেই এই শক্তি আর সামর্থ্যের নজির দেখাতে চাই। একসময় আফগানিস্তান ছিল জাফরান উৎপাদনে পৃথিবীর এক নম্বর দেশ। গৃহযুদ্ধের সময় জাফরান উৎপাদন শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। কিন্তু আফগানিস্তানে আবার এর চাষ শুরু হয়েছে। বর্তমানে জাফরান উৎপাদনে আফগানিস্তান বিশ্বে চতুর্থ।

প্রথম আলো: আফগানিস্তানে পশতু, তাজিক, হাজেরা, উজবেকসহ বহু জনজাতি রয়েছে। কিন্তু পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসের কথাও শোনা যায়। শান্তিপূর্ণ বহুজাতিক আফগানিস্তান কি সম্ভব?

হুমায়ুন কাইয়ুমি: সোভিয়েতরা চলে যাওয়ার পর শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের সময় আফগানিস্তানে নানা দেশি-বিদেশি শক্তি এই বিভাজনকে কাজে লাগিয়েছে নিজেদের স্বার্থে। জাতীয় স্বার্থের চেয়ে তখন গোষ্ঠীগত স্বার্থ বড় হয়ে উঠেছে। এখন নতুন প্রজন্ম জাতিগত ঐক্য চায়। যতই দিন যাচ্ছে, যুদ্ধবাজ নেতাদের প্রভাব ততই কমছে। নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারছে, শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই কেবল মানুষ।

প্রথম আলো: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি আর নিরাপত্তা—এই তিনটির মধ্যে আফগান সরকারের জন্য কোনটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ?

হুমায়ুন কাইয়ুমি: আমি বলব দুর্নীতি। কারণ, দুর্নীতিই আর সব সমস্যাকে ডেকে আনে। গোটা ব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এ জন্য সরকারব্যবস্থায় স্বচ্ছতা তৈরি খুব জরুরি।

প্রথম আলো: দুর্নীতি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে?

হুমায়ুন কাইয়ুমি: ৩০ বছরের গৃহযুদ্ধের জঞ্জাল পরিষ্কার করা খুব সহজ নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে অনেক অন্ধকারের শক্তি ডালপালা মেলেছে। সেগুলোকে এক এক করে ছেঁটে ফেলতে সময় লাগবে। আমরা আশাবাদী, দুর্নীতির মতো ব্যাধিও দূর হবে।

প্রথম আলো: আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচক ৫১ দশমিক ৫। বৈশ্বিক তালিকায় একেবারে শেষের দিকে অবস্থান।

হুমায়ুন কাইয়ুমি: এ জন্য আমরা প্রথমেই বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দেওয়ার নীতি নিয়েছি। গত তিন বছরে সরকারের আয় ৯০ শতাংশ বেড়েছে। শুল্ক আরোপসহ নানাভাবে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের দিকেও আমরা মনোযোগ দিচ্ছি। চেষ্টা করা হচ্ছে দুর্নীতি প্রতিরোধের।

প্রথম আলো: তালেবানকে নিরস্ত্রীকরণ ও তাদের সঙ্গে সফল একটি শান্তিচুক্তির বিষয়ে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে?

হুমায়ুন কাইয়ুমি: আসলে এটা নির্ভর করছে আপনি তালেবানকে কোন চোখে দেখছেন? তালেবানের বহুমাত্রিক উপস্থিতি আপনি দেখতে পাবেন, যদি তালেবানের কথা বলেন, তবে আপনাকে স্পষ্ট করতে হবে কোন তালেবানের কথা বলছেন—যারা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে, সেই তালেবানের কথা, অথবা যারা স্কুল, হাসপাতাল আর জনসমাগমে হত্যালীলা চালায় কিংবা যারা কেবলই বিদেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে? অর্থাৎ তাদের অনেক রকম চেহারা। দেড় বছর আগে যখন শান্তিচুক্তির বিষয়ে কথা হচ্ছিল, তখন আমি তাদের অনেকের মধ্যে শান্তির জন্য আকুতি দেখেছি। তালেবানের নেতাদের ভাবার সময় এসেছে, তঁারা যে মাত্রায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন, দেশের মানুষের যে বিপুল দুর্দশা ডেকে এনেছেন, তার মধ্য দিয়ে তঁারা কি অর্জন করেছে? বিষয়টি তঁারা গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে আর বিদেশি নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারলে শান্তি আসবে বলে মনে করি।

প্রথম আলো: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে রহমত নামের এক আফগানের গল্প বলেছিলেন, সৈয়দ মুজতবা আলী সে দেশ নিয়ে লিখলেন দেশে বিদেশে উপন্যাস। তাই আফগানিস্তান আর বাংলাদেশের সম্পর্কের সেতুবন্ধ বহু পুরোনো। দুই দেশ নানা ক্ষেত্রে কীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে?

হুমায়ুন কাইয়ুমি: আসলে দুই দেশের সম্পর্ক বহু পুরোনো। আমরা বাংলাদেশ থেকে শিখতে চাই, কীভাবে দেশটি নানা ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে। এসব ক্ষেত্রে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি। কেবল বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ মানুষের বসবাস। এই অঞ্চলের যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগাতে হলে সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত ভেদাভেদ ভুলে আমাদের এক হয়ে কাজ করা ছাড়া অন্য বিকল্প নেই।

প্রথম আলো: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

হুমায়ুন কাইয়ুমি: আপনাকেও ধন্যবাদ।