টিকে থাকার লড়াইয়ে এগিয়েছে বাংলাদেশ

গত এপ্রিলে বাংলাদেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ফণী। ফাইল ছবি
গত এপ্রিলে বাংলাদেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ফণী। ফাইল ছবি

গত এপ্রিলে যখন বাংলাদেশ উপকূলের দিকে ঘূর্ণিঝড় ফণী ধেয়ে আসছিল, অনেকেরই মনে পড়ছিল এর আগের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়গুলোর কথা। সেই স্মৃতি ছিল আতঙ্কজাগানিয়া। ১৯৭০ সালে একই গতির ঘূর্ণিঝড়ে ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার আরম্ভ মূলত সে সময় থেকেই। এর ফলও পেয়েছে বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আগের চেয়ে বড় সংখ্যায় কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

এবার যখন ফণী শক্তি সঞ্চয় করছিল, বাংলাদেশ সরকার এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠনগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ১৬ লাখ মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়। সমন্বয়ের একটি লক্ষণীয় দৃষ্টান্ত এই উদ্যোগ। ঠিক এ কারণেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে আজ একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত। তবে এটি এক দিনে সম্ভব হয়নি।

ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ সব সময়ই জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা একটি দেশ। আর এই দেশের উন্নয়ন–সহযোগী হিসেবে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও সুইডেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই। ত্রিপক্ষীয় এই অংশীদারত্বের মূলে রয়েছে দুটি বিষয়—জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া ও পরিবেশ।

গর্বের বিষয় হচ্ছে, বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে সমর্থন দিয়ে এসেছি, যা দেশটিকে দুর্যোগে আরও ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করেছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন থেকে শুরু করে একটি কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তৈরির মতো কাজও রয়েছে।

সন্দেহের অবকাশ নেই, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় রয়েছে। নিয়মিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটছে, গত দুই দশকে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েরা ছেলেদের ছাড়িয়ে গেছে এবং স্বাস্থ্য খাতের সূচকগুলোতেও এসেছে উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

তবে বাংলাদেশকে বেশ কিছু কঠিন সমস্যারও মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যেমন জেন্ডারভেদে আয়বৈষম্য, কোনো কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গায় দারিদ্র্য ও বেকারত্ব এবং জোরদার গণতন্ত্র—যেখানে সবাই মানবাধিকার পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারে। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পৌনঃপুনিকতা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এতে লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে এবং ভবিষ্যতেও এই আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় রাখতে হবে সব সময়। তারা যেন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

গত দুই দশকে নিয়মিতভাবে ইউএনডিপি ও সুইডেন বাংলাদেশের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করে চলেছে। এই প্রতিশ্রুতির প্রধান বিষয় হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে দেশটির উপকূলীয় অঞ্চলের ও অন্য এলাকার লাখ লাখ মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ও উন্নয়ন–সহযোগীদের গুরুত্বপূর্ণ যৌথ কর্মসূচি হচ্ছে ‘কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম’, সংক্ষেপে সিডিএমপি। এর আওতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনা এবং ঝুঁকি হ্রাসকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কাজ হয়েছে। অন্যান্য উন্নয়ন–সহযোগীর সঙ্গে এই কর্মসূচিতে সরাসরি যুক্ত ছিল ইউএনডিপি ও সুইডেন।

‘লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (লজিক) নামে নতুন আরেকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার আওতায় ১৭ হাজার পরিবারকে দুর্যোগ সহনশীলের প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এই উদ্যোগে ইউএনডিপি-সুইডেনের পাশে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

বাংলাদেশের সমাজে এখনো নারী-পুরুষ প্রথাবদ্ধ ভূমিকা পালন করে থাকে। নারীরা ঘর-গৃহস্থালির চাপ পুরোটা সামলায়। তাদের অনেকেই বাড়িঘর ও পরিবারের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত যে দুর্যোগের সময় তারা বাড়িতেই থাকে। এই নারী ও মেয়েশিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যে ঝুঁকি, তার সবচেয়ে বড় শিকার হতে পারে। তা ছাড়া, স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে নারী নেতৃত্বের অভাব একটি বিরাট বাধা।

মানবাধিকার ও সমতার সমর্থক ও প্রচারক হিসেবে আমরা মনে করি, মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনযাপন নিশ্চিতে পরিপূর্ণ ও সমতাভিত্তিক জীবন অপরিহার্য। কার্যকর গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো আইনের শাসন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি। সে কারণে আমরা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছি, যেন কমিশন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা ও জেন্ডার সমতা অর্জন ও মানবাধিকারকে পূর্ণ ও সমান মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে সংলাপ চালিয়ে যেতে পারে। আমরা কমিশনকে অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন ও মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে যুক্ততার ব্যাপারেও সহযোগিতা করছি। আমরা যৌথভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি, যেন তারা নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করতে পারে। আমরা নারী ও তরুণসমাজকে সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সামনের কাতারে আরও জোরালোভাবে নিয়ে আসার পক্ষে। সেই বিষয় মাথায় রেখে আমরা কাজও করে চলছি।

২০১৭ সালের পর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এখন প্রায় ১০ লাখ মানুষের বাস। আমরা চাই সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে সক্ষমতা অর্জিত হোক, আর সেই দিকে লক্ষ রেখে আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। এখানেও আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষ, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের। সেখানে আমরা বর্জ্য নিষ্কাশনে একটা টেকসই ব্যবস্থা তৈরির জন্য কাজ করছি। এতে আমরা আশা করছি, স্বাস্থ্যগত যেসব ঝুঁকি রয়েছে সেগুলো কমে আসবে এবং পরিবেশের সুরক্ষা হবে। শরণার্থী ও তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রয়োজন মেটাতে আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাব। এ ছাড়া প্রয়োজন মানবাধিকারের সুরক্ষা ও প্রসারের প্রতি সম্মান দেখানো।

ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং শিশুশিক্ষা ও জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রতিশ্রুতির স্মারক। আর এই যাত্রায় সুইডেন ও ইউএনডিপি ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সঙ্গে থাকবে এবং টেকসই অগ্রগতি ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অংশীদার হিসেবে থাকবে।

শার্লটা স্লাইটার: ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত
সুদীপ্ত মুখার্জি: ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি