বিএনপির তৈরি জুতায় আওয়ামী লীগের পা

যে আইনটি ৭ এপ্রিল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সেই আইনটি কীভাবে মে মাসের ২৭ তারিখ নবায়িত হলো?
যে আইনটি ৭ এপ্রিল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সেই আইনটি কীভাবে মে মাসের ২৭ তারিখ নবায়িত হলো?

বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আইনের বয়সও বাড়ছে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হলো, কিন্তু কোনো অ-আওয়ামী লীগ সরকারও সেটি বাতিল করেনি। আওয়ামী লীগ সরকার তার তৈরি আইন বাতিল করবে, এটি আশা করা কঠিন। কেননা আমাদের দেশে সরকার কোনো ভুল করে না। তারা শতভাগ সঠিক। আবার ক্ষমতার বাইরে গেলে সেই সঠিক আইনই বেঠিক হয়ে যায়।

১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী লীগ ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। তাদের উত্তরসূরি কোনো সরকার সেই আইনটি বাতিল করার প্রয়োজন বোধ করেনি। একইভাবে বিএনপি বা এরশাদ আমলে প্রণীত যেসব আইনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ জিহাদ ঘোষণা করেছিল, তারা ক্ষমতায় এসে সেসব আইনে একটি চিমটিও কাটেনি। বরং পূর্ববর্তী সরকারের তৈরি জুতায় পা রেখে চলতে তারা স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রণীত জননিরাপত্তা আইনটি বিএনপি সরকার ২০০২ সালে বাতিল করলেও সেই আইনের অধীনে মামলাগুলো বহাল রেখেছিল। এখনো অনেক মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। আবার বিএনপি-জামায়াত সরকার জননিরাপত্তা আইনটি বাতিল করলেও তার স্থলে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন পাস করে। দুটি আইনের মধ্যে মৌলিক ফারাক নেই। তারা আইনটি প্রথমে করেছিল দুই বছরের জন্য। এরপর থেকে কত সরকার এল-গেল কিন্তু আইনটি ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার হয়েই আছে। এমনকি গত ৮ এপ্রিল আইনটি আনুষ্ঠানিকভাবে অক্কা পাওয়ার পরও এটি বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করে বর্তমান সরকার।

গত ২৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই আইনের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু গোল বেঁধেছে যখন মন্ত্রিসভা আইনটি নবায়নের উদ্যোগ নেয়, তখন আর এর অস্তিত্ব নেই। কেন নেই, সে কথা লিখেছেন শাহদীন মালিক গত ২ জুন প্রথম আলায়। তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল, ‘আইনটি মারা গেছে’। মৃত মানুষকে যেমন জীবিত করা যায় না, তেমনি মৃত আইনকেও বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।

আইনটি যে সত্যি সত্যি মারা গেছে, তার প্রমাণ পেলাম জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণীতেও।

গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) (সংশোধন) আইন-২০১৮’ পাসের প্রস্তাব করেন। কোনো বিরোধিতা ছাড়াই বহুল আলোচিত আইনটির সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়।

চাঁদাবাজি, যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, যানবাহনের ক্ষতিসাধন, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিনষ্ট, ছিনতাই, দস্যুতা, ত্রাস ও সন্ত্রাস সৃষ্টি, অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি, দরপত্র কেনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ বিভিন্ন অপরাধ দ্রুততার সঙ্গে বিচারের জন্য এ আইন করা হয়েছিল। আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ’ করলে দ্রুত বিচার আইনে তাঁর বিচার হবে। বিলে সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ২০০২ সালে দ্রুত বিচার আইন জারি করে দুই বছরের জন্য তা কার্যকর করা হয়। এরপর বেশ কয়েক দফা ওই আইনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল আইনটি সংশোধন করে পাঁচ বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ায় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। এবার আইনের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। আইনটি ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে বলা হয়েছিল (১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ প্রথম আলো)।

যে আইনটি ৭ এপ্রিল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সেই আইনটি কীভাবে মে মাসের ২৭ তারিখ নবায়িত হলো? আমাদের মন্ত্রিসভায় ঝানু ঝানু আইনজ্ঞ আছেন। সরকারের অনেক জাঁদরেল আইন উপদেষ্টা আছেন। তারপরও এই ভুল কীভাবে তাঁরা করলেন, সেই প্রশ্নই তুলেছেন শাহদীন মালিক।

তবে অস্তিত্বহীন আইন নবায়ন না করা গেলে সরকার একই আদলে আরকটি আইন করতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারের মন্ত্রীরা, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যখন বিরোধী দলের আন্দোলনের মুরোদ নেই বলে উপহাস করেন, তখন আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী আইনের প্রয়োজন কেন পড়ল?

আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা, অতি ও পাতিনেতারা কথায় কথায় বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা করেন। আবার তাদের আমলে প্রণীত মৃত আইনটি কবর থেকে তুলে এনে জীবিত করতে চাইছেন। আসলে আওয়ামী লীগ নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক দাবি করলেও বিএনপি-জামায়াতের অনেক কিছুই আঁকড়ে আছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, ২০১৩, ২০১৪ বা ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত আগুন সন্ত্রাস চালিয়েছে। এরপর যে দলটি ঘরে ঢুকেছে, আর বের হতে পারেনি। এখন রাজনীতি থেকে সংসদ, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সচিবালয়—সবই সরকারের একক নিয়ন্ত্রণে। তারপরও ভয় দেখানো আইনটির প্রয়োজন কেন পড়ল? তাহলে কি মন্ত্রীরা মুখে যত বড় কথাই বলুন না কেন, মনে ভীতি কাজ করছে?

বাতিল হওয়ার আইনের বিধান অনুযায়ী, ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বা বেআইনি বল প্রয়োগ করে কোনো ব্যক্তি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা, সাহায্য বা অন্য কোনো নামে অর্থ বা মালামাল দাবি বা আদায় বা আদায়ের চেষ্টা করলে, তা এ আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া স্থল, রেল, জল বা আকাশপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে যানের গতি ভিন্নপথে পরিবর্তন করা, ইচ্ছাকৃত কোনো যানবাহনের ক্ষতি করা; ইচ্ছাকৃতভাবে সরকার, ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ভাঙচুর করাসহ ৯ ধরনের অপরাধের জন্য এই আইনের অধীনে সাজা দেওয়া যাবে।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রচলিত আইন দিয়ে অপরাধ দমন করতে না পারে, সেটি সরকারের পদ্ধতিগত ব্যর্থতা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথা বিরোধী দলকে দমনের জন্য তৈরি আইনটি (বিএনপি আমলে এ রকম সমালোচনাই করেছিল আওয়ামী লীগ) আঁকড়ে না ধরে সরকারের উচিত ফৌজদারি আইন প্রয়োগের ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলো দূর করা।

২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ‘জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন আইন ২০০০’ পাস হয়। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দরপত্র ইত্যাদিতে হস্তক্ষেপ, গাড়ি ভাঙচুর ও সম্পদের ক্ষতিসাধন, যান চলাচলে বাধা, মুক্তিপণ দাবি ও আদায়, ভয়ভীতি সৃষ্টিসংক্রান্ত নানা অপরাধকে এ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। ২ বছর ১ মাস ১৯ দিন পর ২০০২ সালের ৩ এপ্রিল আইনটি বাতিল করে বিএনপি সরকার আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) নামে যে নতুন আইন চালু করে, সেটি ছিল আসলে নতুন বোতলে পুরোনো মদ। এতে মৌলিক কোনো পার্থক্য ছিল না।

এমনকি বাতিল হওয়া আইনে বিচারাধীন অনেক মামলা এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে; যদিও আইনটি করার সময় তদন্ত এবং বিচারের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ৪৬ জেলার আদালতে গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত জননিরাপত্তা আইনের অধীন বিচারাধীন ছিল ৭৭৮টি মামলা।

আর ‘নবায়িত’ আইনে গায়েবি মামলার সংখ্যা যে কত, তার কিছুটা হিসাব প্রথম আলো নির্বাচনের আগে দিয়েছিল। এখন সেই সংখ্যা বেড়েছে বৈ কমেনি। এভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের যতই জনবান্ধব সরকার দাবি করুক না কেন, তারা আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী ধরার নামে গণবিরোধী আইন টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট থাকে। একজনের তৈরি জুতায় আরেকজন পা রাখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। কিন্তু আমজনগণের দুর্ভোগের কথা কেউ ভাবে না।

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।