পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস

পাবলিক পরীক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতিবিরোধী কঠোর ব্যবস্থা আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত প্রশ্নপত্র ফাঁস মামলার অভিযোগপত্র চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে পাঁচ জেলায় প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে আটকের খবর বেরোল। এখন আমরা কায়মনোবাক্যে আশা করব, পাবলিক পরীক্ষায় শুদ্ধতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই পদক্ষেপকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। আর সেই দায়িত্ব শুধুই সরকারের ওপর বর্তাবে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের কাছ থেকে নগদ জব্দ করা ২০ কোটি টাকার জোগানদাতা অভিভাবকদের আত্মজিজ্ঞাসাও জরুরি।

তবে পাবলিক পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনকে রুখতে সরকার যে সত্যিই জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে, তাকে সর্বতোভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাই সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা একটা দীর্ঘ সময় ধরে পাবলিক পরীক্ষার দুর্নীতি বন্ধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছিলাম। একসঙ্গে ছাত্রলীগের ২১ জনের বিরুদ্ধে সিআইডির অভিযোগপত্র প্রস্তুতের ঘটনা পরীক্ষা-অপরাধ দমনে ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা মনে করি।

সিআইডি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ জন শিক্ষার্থীসহ ১২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করেছে এবং জনগুরুত্ব বিবেচনায় তারা সংবাদ সম্মেলন করে তা প্রকাশ করেছে। এটা প্রমাণ করছে যে আমাদের এই গোয়েন্দা বিভাগটির সামর্থ্য রয়েছে, তারা চাইলে পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ আরও যত ধরনের চক্র সারা দেশে গড়ে উঠেছে, তারা তাদের মূলোৎপাটন করতে পারে। আর জনগণ সেটাই দেখতে চাইবে। বিদ্যোৎসাহী মহলে ঐকমত্য রয়েছে যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক গুণগত মানে অব্যাহতভাবে উদ্বেগজনক অবনতি ঘটছে। এটা এমন একটি সমস্যা, যা রাতারাতি দূর করা যাবে না। তবে এখানে যথাসংস্কার বা পরিবর্তন আনতে চাইলে উচ্চপর্যায়ের প্রমাণিত রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। বিশেষ করে উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার বিষয় সরে গিয়ে স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাত এবং দলীয়করণ জায়গা করে নিয়েছে। এই একটি অব্যবস্থাই মূলত গোটা শিক্ষাব্যবস্থার ভিতকে দুর্বল এবং দুর্নীতিবান্ধব করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। স্কুল-কলেজের এমপিওভুক্তকরণ ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। কিন্তু এটা প্রতিরোধে তেমন কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

প্রকৃতপক্ষে গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধস নেমেছে, তা থেকে পাবলিক পরীক্ষার দুর্নীতিকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। সুতরাং শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্নীতি প্রতিরোধে সম্ভব সব ধরনের প্রশাসনিক, আইনি এবং বিচারিক পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাকে না বাঁচালে কিছুই বাঁচবে না। প্রকৃত শিক্ষা না পাওয়া জনশক্তি নিজেদেরসহ জাতি ডুবিয়ে দিতে পারে। সুতরাং এই চেতনাকে জাগ্রত রেখে পাবলিক পরীক্ষায় দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান শুরু হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য প্রশ্নপত্র তৈরি এবং বিতরণের প্রক্রিয়ায় সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ বিষয়ে নানা ধরনের উপায় বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে বাতলেছেন এবং তার আলোকে প্রতিটি পরীক্ষা পর্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে যাঁরাই শৈথিল্য দেখাবেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে যাতে কোনো শিথিল মনোভাব না দেখা যায়।

দীর্ঘ বিরতিতে হলেও সিআইডি একটি উদাহরণ তৈরির দ্বারপ্রান্তে। এই অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার পরে দ্রুত বিচার নিশ্চিতে আমরা হাইকোর্টের তদারকি আশা করব। তবে নাম-ঠিকানা যাচাইয়ের অপেক্ষায় থাকা ৮৯ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র কত তাড়াতাড়ি দেওয়া হয়, সেটা জানতে আমরা অপেক্ষায় থাকব। এখন পুলিশের কাজ পলাতক ৭৮ অভিযুক্তকে পাকড়াও করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তদের বহিষ্কারে কালক্ষেপণ করলে তার থেকে হতাশা ও বেদনার আর কিছুই হবে না।