ওসি মোয়াজ্জেম ও ভানুমতীর খেল

নুসরাত জাহান।
নুসরাত জাহান।

আমাদের জাতীয় জীবন যেন এক ভানুর কৌতুক। কিংবদন্তি কৌতুকাভিনেতা ভানুর কাছে এসেছে নিতাই। তার ভাই খোকনকে জেল থেকে বের করতে হবে। ভানুর একটাই কথা, ‘হে হে হে, আমার উপর ভরসা রাখ...মইরা তো যাই নাই...। আমি তো আছি...।’

খোকনের ফাঁসির আদেশ হলেও ভানুর একই আশ্বাস, ‘আরে ধুর! আমি কি মইরা গেছি নাকি? আমি তো আছি...। আমার উপর বিশ্বাস রাখ, হাইকোর্ট করুম। এমন উকিল দিমু, প্রতিপক্ষের মুণ্ডু ঘুরাইয়া দিমু। তবে আরও খরচ হইব। হাজার সাতেক টাকা লইয়া আয়, কিচ্ছু ভাবিস না। আমি তো আছি...।’

খোকনের ফাঁসির আদেশ হলেও ভানু আশাবাদী, ‘না, তগ দেখছি আমার উপর কুনু আস্থাই নাই! এতকাল তো আমারে বিশ্বাস কইরা আইছস, ঠকছস কুনুদিন? আমি তো মৈরা যাই নাই...। বাঁইচা তো আছি...। খোকনেরে গিয়া ঝুইলা পরতে ক...। আমি তো আছিইইইই...।’

ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে সাত দিন ধরে ঢাকা-ফেনী-রংপুরে লুকোচুরি খেলল পুলিশ। ফেনীর পুলিশ সুপার প্রথমে পরোয়ানা পাওয়ার কথা অস্বীকার করেন। তাঁকে দিয়ে সেটা স্বীকার করাতে লেগে যায় প্রায় এক সপ্তাহ। সেটা রংপুরে পাঠাতে আরও দুই দিন। রংপুর রেঞ্জের পুলিশ বলে, পরোয়ানা নাকি বিধি মোতাবেক হয়নি। এই সাপলুডু খেলার মওকায় ওসি মোয়াজ্জেম পগারপার। তিনি পালিয়েছেন, নাকি তাঁকে পালাতে সাহায্য করা হয়েছে, সেই প্রশ্ন এখন মানুষের মনে।

এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘খুঁজে পেতে একটু সময় লাগলেও তাঁকে বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে।’

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘পালিয়ে গেলে ধরা তো কঠিন। সময় লাগে। তবে সরকার এ ব্যাপারে সিরিয়াস। কোনো শৈথিল্য দেখানো হবে না।’ ওসি মোয়াজ্জেম জেনে গেলেন, তাঁর হাতে সময় আছে। সময়ে কত–কী না হয়। কত ফাঁসির আসামি সময়ের মওকায় বিদেশে অবমুক্ত হয়ে যায়!

আমাদের কানে কেবল ভানুর সংলাপটি বাজে, ‘খোকনেরে গিয়া ঝুইলা পড়তে ক...। আমি তো আছিইইইই...।’

তনু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সময়ও আমরা সরকারের ‘সিরিয়াসনেস দেখেছি, পুলিশসহ মন্ত্রীদের আশ্বাস পেয়েছি’। নুসরাতের ঘটনার ভয়াবহতায় যেভাবে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ হয়েছিল, তাতে ভরসা আসতে পারত যে নুসরাত হত্যা মামলার বিচার তনু হত্যার মামলার মতো হবে না, সাগর-রুনি হত্যা মামলার মতো হবে না। কিন্তু সকলই গরল ভেল। যেই লাউ সেই কদু।

ওসি মোয়াজ্জেম সাধারণ লোক নন, তিনি পুলিশবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। তাঁর গতিবিধি সংশ্লিষ্ট মহলের নজরে থাকার কথা। তা ছাড়া যত বড় ঘটনা, তাতে করেও তাঁর পালানো কঠিন ছিল। সেই কঠিন কর্মটি তিনি করতে পেরেছেন কেবল নিজের ‘প্রতিভার’ জোরে? বিশ্বাস করা কঠিন।

ঘটনাটা নৃশংসতার। কিন্তু নৃশংসতা কি গা-সওয়া হয়ে গেছে আমাদের?

বাড়তি ভাড়া নিয়ে প্রতিবাদ করায় বাসযাত্রীকে পিষে মারল ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের এক বাসচালক।

সোনাগাজীর ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।
সোনাগাজীর ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।

ঈদের ছুটিতে স্ত্রীসহ ফিরছিলেন সালাউদ্দিন। ভাড়া ২০০ টাকার জায়গায় ৩০০ টাকা দিতে রাজি হননি। তাই বাসের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে থাকা অবস্থায় তাঁর ওপর বাস চালিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর স্ত্রী তখন বাসের মধ্যে। দৃশ্যটি চিন্তা করুন। স্ত্রী বাসের ভেতর থেকে চিৎকার করছেন, স্বামী বাসের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছেন। বাসভর্তি যাত্রীরাও মানুষ। সেই সব উদাস মানুষ দৃশ্যটি দেখছেন, কেউ কেউ হয়তো উপভোগও করছেন। বাসটি একজন সহযাত্রীকে হত্যা করল সেই যাত্রীদের চোখের সামনে। নিহত ব্যক্তির স্ত্রী তখনো চিৎকার করছেন, কাঁদছেন, বাস থামাতে বলছেন। কিন্তু বাস থামানোর মতো একজনও সেখানে বোধ হয় ছিলেন না। নিহত ব্যক্তির স্ত্রী দেখলেন, সহযাত্রীরা পাশে নেই, কোথাও কেউ নেই। এই অবস্থায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে নিয়ে গিয়ে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে যায় বাস। ভাগ্যিস, তাঁকেও পিষে মারা হয়নি। মারতে চাইলে পারত, কারণ যাত্রীরা কেউ কোনো ঝুঁকি নেননি।

ভয়ের পরিবেশে এমন নির্বিকারত্ব মানুষকে পেয়ে বসে।

একই দিনের সংবাদ। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন যেটা হয়েছে, মালিক–শ্রমিকের প্রতিবাদের কারণেই তা বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে। ...তাদের খেপিয়ে তোলা ঠিক হবে না ভেবে সরকার আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছে।’

সাংবাদিকেরা প্রশ্ন তোলেন, সরকার কি তাহলে মালিক-শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে? জবাবে ওবায়দুল কাদের বললেন, ‘না, জিম্মি হওয়ার বিষয় না। প্রথমেই ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেওয়া কি ঠিক হতো?’

না, ঠিক হতো না। ঠিক যেমন সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের নিষ্ঠুরভাবে ঠান্ডা করা ঠিক হয়নি। তাদের ওপর যে সন্ত্রাসী লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সাংবাদিক নির্যাতন করা হয়েছিল, সেসবও ঠিক হয়নি। সেসবের বিচার না করাও একদম ঠিক হয়নি। কিন্তু ভিক্টিমরা নয়, সহানুভূতি ও ছাড় পেল তারাই, যারা নাকি সড়কের যম হিসেবে চিহ্নিত।

ছাত্ররা সড়কে বাসচালকের নিষ্ঠুরতার ন্যায্য বিচার চেয়েছিল আর মালিক-শ্রমিকেরা দাঁড়িয়েছিল ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে। মন্ত্রী কাদের পক্ষে, তা তাঁর বক্তব্যেই স্পষ্ট। তাঁর বক্তব্যে সহানুভূতির অভাব। যেমন তিনি ঈদের ছুটিতে দুর্ঘটনা নিয়ে বলেছেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার হার এবার কম ছিল। তবে নিহতের সংখ্যা বেশি।’ নিহত মানুষের সংখ্যা যদি বেশিই হয়, তাহলে কি দুর্ঘটনার হার নিয়ে কোনো সান্ত্বনা থাকে?

যেমন ওই নীরব বাসযাত্রীদের আচরণে ছিল মানবিকতার অভাব। সবদিকেই এই দৃশ্য।

তনু হত্যার বিচার আজো হয়নি
তনু হত্যার বিচার আজো হয়নি

মানুষকে মানুষ মনে করা হচ্ছে না, সাধারণ থেকে অসাধারণ যে-কেউই মুহূর্তেই নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত নজির দেখিয়ে দিতে পারেন। যেমন গতকালই ময়মনসিংহে যৌতুকের জন্য মারধরের পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এক নারীর গায়ে। যেমন ছাত্রীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় রাজবাড়ীতে। যেমন ঈদের নামাজ পড়ে এসে নাতনিকে ধর্ষণ করেন এক বৃদ্ধ। যেমন ঈদের সময় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হয় এক এলাকায়।

কী মনে হয় এসব দেখে? নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত মানবজমিন নষ্ট হয়ে গেছে, আরও যাচ্ছে। যখন জনগণ সিস্টেম বদলাতে পারে না, তখন সিস্টেমই তাদের বদলে দেয়। তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্নীতি, নৃশংসতা, নির্বিকারত্ব জনগণের মধ্যেও ছড়ায়। ওপরতলার দুর্নীতি-নির্যাতন-নির্মমতার ছায়া পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। গত শতকের মাঝামাঝি ফ্রান্সের দখলাধীন আলজেরিয়ায় রাষ্ট্রযন্ত্র্রের নৃশংসতার পাশাপাশি জনগণের মধ্যেও খুন-ধর্ষণ-নির্যাতনের হিড়িক বেড়েছিল। স্বামী বউ পেটালে বউ সেই রাগ ঝাড়ে কাজের লোকের ওপর। তেমনি চাপে থাকা মানুষ সেই চাপ চালান করে দেয় তার নিচের মানুষদের দিকে, দাপট দেখায় পরিবারে ও সমাজে। মনোবিকার এক জাতীয় ব্যাধি হয়ে পড়েছিল বলে দেখিয়েছেন সে সময়ের আলজেরিয়ার বিপ্লবী তাত্ত্বিক ও মনোরোগ চিকিৎসক ফ্রাঞ্জ ফ্যানো। আমরাও বোধ হয় সর্বনাশের ওই সীমায় পৌঁছে গেছি, যেখানে নদীর মতো জনতার মনও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। সরকারি নির্বিকারত্বের পাশাপাশি সামাজিক স্তরে নৃশংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। তনু থেকে নুসরাত, আগুন থেকে পিষে মারা, আসামি ধরা নিয়ে সাপলুডু খেলা—সবকিছু সেই ইঙ্গিতটাই দিচ্ছে।

এমন অবস্থায় আশ্বাসবাণীগুলোকে ভানুর সংলাপের মতো মনে হয়, ‘খোকনরে গিয়া ঝুইলা পড়তে ক, আমি তো আছিইই।’ এমন আশ্বাসে ভুক্তোভোগীরা আরও ভয় পায়, কিন্তু ভরসা পান ওসি মোয়াজ্জেমের মতো মানুষেরা। 

আরও পড়ুন...