মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা

‘তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি/ছোটে নৌকাগুলি/প্রাণপণে ফেলে জাল, টানে দড়ি/অর্ধনগ্ন যারা, তারা খাদ্যহীন’—বুদ্ধদেব বসুর ‘ইলিশ’ কবিতার ‘অর্ধনগ্ন’ জেলেদের মতো উপকূলের জেলে সম্প্রদায় আজ মহা বিপাকে। সরকারি নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে তাঁরা এখন কার্যত ‘খাদ্যহীন’। ভুখা-নাঙ্গা এই মৎস্যজীবীরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গত রোববার যখন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি তুলছিলেন, তখন জাতীয় উপলব্ধির দরজায় মানবিকতা যেন সশব্দে করাঘাত করছিল।

যে দেশ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির যানে অগ্রসরমাণ বলে দাবি করে, যে সরকার নিজেদের দরিদ্রবান্ধব শাসক হিসেবে মনে করে, সেই দেশে সেই সরকারের আমলে উপকূলের ৩৮ জেলেপল্লির হাজার হাজার নারী-পুরুষের রুটি-রুজির নিশ্চয়তার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ রাষ্ট্রের প্রশাসনিক নীতিকে স্পষ্টতই প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা না করেই টানা দুই মাসের বেশি সময়ের জন্য একটা বিরাট জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে ছেদ টানার কথা নীতিনির্ধারকদের মাথায় কীভাবে আসতে পারে, সেটিও একটি বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর ৬৫ দিন মাছ আহরণ নিষিদ্ধ। গত বছর পর্যন্ত শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকলেও এ বছর ২৫ হাজার ট্রলার ও ছোট ছোট ডিঙিকেও এর আওতায় আনা হয়েছে। এ বছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। এর আগে নদীতে কয়েক ধাপে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা গেছে। এরপর কোনো ধরনের রেশন বা আর্থিক সহায়তা না দিয়ে এত লম্বা সময়ের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা যেকোনো বিবেচনায়ই অমানবিক।

এ কথা সত্য যে এই নিষেধাজ্ঞায় মৎস্যভান্ডার সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময়ের বেকারত্ব তাঁদের কী পরিমাণ ক্ষতির মুখে ফেলবে এবং তা পোষাতে সরকারের ভূমিকা কী থাকবে, সেটাও ভাবা দরকার ছিল। বাস্তবতা হলো, উপকূলীয় লাখো মৎস্যজীবী পরিবার এখন অর্ধাহার–অনাহারে রয়েছে। মাছ ধরতে না পেরে পেটের দায়ে অনেক জেলে চুরি, দস্যুতা, মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। অনেকে মহাজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আগাম দাদনসহ বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তে তাঁরা মহা বিপদে পড়েছেন। এখন তাঁরা কী করবেন, সে বিষয়ে সরকারের দিক থেকেও কোনো বক্তব্য নেই।

দরিদ্র মানুষগুলোকে ফের রাস্তায় যাতে নামতে না হয়, সে জন্য সরকারকে মানবিক কোনো সমাধানের রাস্তায় যেতে হবে। এসব অন্ত্যজ শ্রেণির জীবন–জীবিকার বিষয়কে গুরুত্ব না দেওয়া যে গোটা জাতির সামগ্রিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে, তা নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে।