রাজস্ব ঘাটতি মোকাবিলা এবং সামনের বাজেট

সাম্প্রতিক সময়ে বাজেটে ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, আয়ের খাত তার বিপরীতে অনেক কম বেড়েছে। গত বছরগুলোয় দেখা যাচ্ছে, উন্নয়ন বাজেটও বেড়ে গিয়েছে চিন্তার বাইরে। অন্যদিকে, উন্নয়নের জন্য যে সহায়তা পাওয়ার কথা, তা গত কয়েক বছরে অনেক কমে গিয়েছে। সংগত কারণেই ক্রমাগত স্থানীয় সম্পদের স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে বাজেটের বেশির ভাগ জোগান নিশ্চিত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

নব্বইয়ের দশকে যে ছকে বাঁধা বাজেট পেশ করা হতো, ইদানীং সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার একটা প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংক থেকেও মধ্যমেয়াদি বাজেটকে সমর্থন দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নেওয়ার একটা সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়, পাশাপাশি নীতিনির্ধারকেরা সহজেই তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিলের একটা সুযোগ পেয়ে যান। বিগত বছরগুলোয় কর্মসংস্থান সৃষ্টির (বিশেষ করে সেবা খাতে) সূত্র ধরে জিডিপিও বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে উদ্দিষ্ট প্রকল্পগুলোর মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অবশ্য তেমন বৃদ্ধি লক্ষ করা যায়নি।

স্থানীয় সরকার, যোগাযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো বেশি খরুচে মন্ত্রণালয়গুলোয় এখন প্রয়োজন উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন। এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত অডিট ব্যবস্থা, এমনকি সিএফও তথা প্রধান অর্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত নেই। তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রণীত বাজেট সংশোধনের জন্য একটি সুযোগ রাখতে আগ্রহী। সবচেয়ে বাজে বিষয় হচ্ছে, বাজেট নিয়ে সংসদে তেমনভাবে আলোচনা হতেও দেখা যাচ্ছে না।

এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করতে গেলে দেখা যাচ্ছে বাজেট এখন পর্যন্ত পুরোপুরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে মিল রেখে এই মন্ত্রণালয় বারবার সাজাতে দেখা যায়। সেখানে মন্ত্রীরা রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত না হলে এখানে পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক প্রভাব স্পষ্ট হতে পারত। এ ক্ষেত্রে অবশ্য প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখেছি, বাজেট বরাদ্দের ব্যবহার এমনকি ব্যবস্থাপনা নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। অন্যদিকে, বাজেট তৈরির আগে নীতিপ্রকল্পকদেরও উপযুক্ত বক্তব্য প্রদান ও মতপ্রকাশের খুব একটা সুযোগ থাকে না।

ধীরে ধীরে বাজেটের সঙ্গে মিল রেখেজিডিপিকেও বেশ বড় করে দেখানো হচ্ছে। তারপরও আমাদের জিডিপির মাত্র ১৮ শতাংশ এর আওতাভুক্ত হচ্ছে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে দেখা যাচ্ছে এই পরিমাণ বেড়ে গিয়েজিডিপির ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, তিনি এই পরিমাণ এগিয়ে নিতে চেষ্টা করবেন অন্ততপক্ষে জিডিপির ২০ শতাংশ পর্যন্ত। তবে তিনি রাজস্ব ক্ষেত্রে অবনমনের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্বল কর সংগ্রহ প্রক্রিয়াকে দুষেছেন। পাশাপাশি গৃহীত অনেক প্রকল্প শেষ অবধি কাঙ্ক্ষিত মানে বাস্তবায়ন করা যায়নি, সেটার দোষকেও তিনি চাপাতে চেয়েছেন দুর্বল রাজস্ব সংগৃহীত হওয়ার ওপর।

পত্রিকান্তরে জানা গিয়েছে, চলতি অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব ঘাটতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২ লাখ ৮০ হাজার ৬৩ কোটি টাকার মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত আদায় হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৯০ কোটি টাকা। জুন মাসে সাধারণত রাজস্ব আদায় বাড়লেও লক্ষ্য অর্জনে বাকি দুই মাসে যে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আহরণ করতে হবে, তা বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতায় প্রায় অসম্ভব বলা যায়। এর মধ্যেই আবার আসন্ন অর্থবছরের জন্য আরও বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি বাজেটের কথা শোনা গিয়েছে। রাজস্ব আহরণে ঘাটতির কারণে চলতি অর্থবছরেই বাজেট বাস্তবায়ন ব্যাহত হওয়ার কথা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী অর্থবছরেও বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে।

সাধারণত রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে এনবিআর ও সরকার বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরই চাপ দিয়ে থাকে। উদ্যোক্তাদের মতে, এতে ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি বাজেট নিয়ে এক আলোচনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁরা রাজস্ব আইন ও ব্যবস্থাপনা সর্বোপরি রাজস্ব আহরণে কিছু অসামঞ্জস্যের বিষয় তুলে ধরে সেগুলোর কাঠামোগত সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন।

রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য অর্জিত না হলে স্বাভাবিকভাবেই দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব পড়বে। একদিকে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থের জোগান বিঘ্নিত হতে পারে, অন্যদিকে সরকার ২০২১ সাল নাগাদ কর-জিডিপিঅনুপাত ১৪ শতাংশে উন্নীতের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, সে প্রক্রিয়াও বাধাপ্রাপ্ত হবে। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের একধরনের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। ফলে, নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি বিবেচনায় অনেক উন্নয়ন–সহযোগী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুদান কমিয়ে দিতে পারে। এতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে অর্থের সংকট দেখা দিতে পারে। অর্থের সে ঘাটতি অবশ্যই পূরণ করতে হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। আর সে জন্যই বাড়াতে হবে রাজস্ব আহরণ। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে রাজস্ব ঘাটতির কারণগুলো উদ্‌ঘাটন করা উচিত। এনবিআরকে রাজস্ব আহরণের বিদ্যমান উত্সগুলোর পাশাপাশি সম্ভাবনাময় নতুন উৎস অনুসন্ধান করতে হবে। সেটা করতে হলে এনবিআরের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশের মতো গতিশীল অর্থনীতির দেশে বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনেক বিষয় মাথায় রাখা উচিত। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অনেক প্রতিনিধি বা প্রতিষ্ঠানকে সরকারি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁদেরও উপযুক্ত কর্মভূমিকার মাধ্যমে নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা যেতে পারে। এর বাইরে বাণিজ্য বা ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদগুলোর যাঁরা শিক্ষক আছেন, তাঁদেরসহ দক্ষ হিসাবরক্ষকদেরও যুক্ত করা যেতে পারে।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক