নুসরাত হত্যার বিচারে সরকার কতটা আন্তরিক?

নুসরাত জাহান।
নুসরাত জাহান।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ওসি মোয়াজ্জেমকে ধরার বিষয়ে সরকারের চেষ্টার ত্রুটি নেই। একজন লোক পলাতক হলে তাঁকে ধরা একটু কষ্টকরই হয়। গত সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকেরা তাঁর কাছে জানতে চান, নুসরাত হত্যা ঘটনায় ডিজিটাল আইনে অভিযুক্ত ফেনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন?

ওবায়দুল কাদের আরও বলেছেন, ফেনীর এই মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের যে নেতারা জড়িত তাঁরাও কারাগারে আছেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করতে চাইছেন যে সরকার নুসরাত হত্যার বিচারের বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মোয়াজ্জেম অপরাধ করলে তাঁকে শাস্তি পেতেই হবে।

দুই প্রভাবশালী মন্ত্রীর আশার বাণীতে বিচারপ্রার্থী নুসরাতের পরিবার তথা দেশবাসী কতটা আশ্বস্ত হবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সরকার এখন ওসি মোয়াজ্জেমকে ধরতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। কিন্তু তিনি থানায় নুসরাতের জবানবন্দির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার পরও বেশ কিছুদিন কর্মস্থলে ছিলেন। তখন কেন সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না?

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদেরও কারাগারে থাকার উদাহরণ দিয়ে ওবায়দুল কাদের নুসরাত হত্যা মামলার বিচারে সরকার যে আন্তরিক, সেটি প্রমাণ করতে চাইছেন। কিন্তু তিনি যেদিন দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছেন, সেদিনই আমরা ফেনীর আদালত প্রাঙ্গণে নুসরাত হত্যা মামলার আসামি পক্ষের মহড়া দেখলাম। আদালত প্রাঙ্গণে নুসরাত হত্যার বিচার চেয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করেছিলেন বিচারপ্রার্থীরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃতি দিয়ে সহযোগী একটি পত্রিকা জানায়, ‘সকালে আদালতের ভেতরে-বাইরে বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মীর বেষ্টনীর মধ্যে চার্জশিটভুক্ত ১৬ আসামিসহ গ্রেপ্তার ২১ জনকে বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। বিচারক শুরুতেই পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দাখিল করা অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাঁদের বক্তব্য শুনানি শেষে অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার দাবি করেন। সরকারপক্ষ এর বিরোধিতা করতে থাকে। এ সময় আদালতে হইচই শুরু হলে আইনজীবীদের কারও বক্তব্য শোনা যায়নি। বিচারক ন্যায়বিচারের স্বার্থে সবাইকে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করার অনুরোধ করতে থাকেন।...পরে আদালত মামলার আসামি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন, পৌর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আলম, নূর উদ্দিন, ইফতেখার উদ্দিন রানা, মো. শামীম ও আফসার উদ্দিনের জামিন আবেদনের ওপর শুনানি গ্রহণ করেন। আসামিপক্ষের শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী সৈয়দ আবুল হোসেন, গিয়াস উদ্দিন নান্নু, কামরুল হাসান ও বুলবুল আহাম্মদ সোহাগ। সরকারপক্ষে জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন পিপি হাফেজ আহাম্মদ, অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু প্রমুখ। শুনানি শেষে আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আসামিদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

সোনাগাজীর ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।
সোনাগাজীর ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।

এ সময় আদালতের প্রবেশপথে একদল যুবক আসামিদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের দাবিতে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি কিছুদূর অগ্রসর হলে ৪০-৫০ জন তাঁদের ওপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে। এ সময় দুপক্ষে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। একপর্যায়ে শাস্তির দাবিতে মিছিলকারীরা হামলার মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে আদালত চত্বর এলাকায় মহড়া দেয়। এতে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ফেনী থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, হামলাকারীদের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার নাম আলম হোসেন। (সমকাল, ১১ জুন ২০১৯)

ফেনীর ঘটনা ছয় বছর আগে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই মামলায়ও প্রধান অভিযুক্ত নূর হোসেন ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর। প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে তিনি খুন করিয়েছেন র‌্যাবের কর্মকর্তাদের দিয়ে। ফেনীতে নুসরাত হত্যার প্রধান আসামিও জামায়াতে ইসলামী থেকে হিজরত করা নব্য আওয়ামী লীগার ও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা। তাঁর হয়ে ফুলগাজী আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী আগুনে পুড়িয়ে নুসরাতকে হত্যা করেন। প্রথমে তাঁরা নুসরাতকে চাপ দিয়েছিলেন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা যৌন নির্যাতনের মামলা প্রত্যাহার করতে। নুসরাত রাজি না হওয়ায় কারাগারে বসেই সিরাজ উদদৌলা তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তাই অভিযোগপত্র গ্রহণের দিন যাঁরা আদালত প্রাঙ্গণে মহড়া দিয়েছেন, বিচারপ্রার্থীদের মিছিলে হামলা করেছেন, তাঁরা অচেনা কেউ নন। নারায়ণগঞ্জের গডফাদাররা সাত খুনের বিচার আটকে দিয়ে খুনিদের রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। পারেননি। কিন্তু ফেনীতেও সে রকম কোনো চেষ্টা হয়েছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

একজন মেয়েকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পর ঘাতকদের সহযোগীরা আদালত প্রাঙ্গণে এই ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহস কীভাবে পেলেন? হামলাকারীদের একজন গ্রেপ্তার হলেও অন্যরা কীভাবে পালিয়ে গেলেন? কেন সেখানে যথেষ্ট সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হলো না?

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় সেখানকার আইনজীবী সমিতি প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা কেউ খুনিদের পক্ষে দাঁড়াবে না। পরে সমিতির নেতৃত্বে পরিবর্তন এলে খুনিদের পক্ষে একশ্রেণির আইনজীবী দাঁড়ান। উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে সেই মামলার সঠিক তদন্ত হয়েছিল এবং অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছিলেন। ফেনীতে নুসরাত হত্যা মামলার শুরুতেই আসামিপক্ষ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় মামলা সঠিক খাতে প্রবাহিত করা কঠিন হবে বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। যাঁরা আদালত প্রাঙ্গণে বিচারপ্রার্থীদের ওপর হামলা করেছেন, তাঁদের ফুটেজ সিসি টিভিতে ধরা পড়ার কথা। সেই ছবি দেখে প্রত্যেককে পাকড়াও করা হোক। একই সঙ্গে নেপথ্যের মদদদাতাদের খুঁজে বের করা হোক। তারপর বলা যাবে সরকার নুসরাত হত্যার বিচারে আন্তরিক।

উল্লেখ্য, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে গত ৬ এপ্রিল কৌশলে ওই মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে না নেওয়ায় তাঁকে হত্যা করা হয়।

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।