ভারতে ভিলেনদের হিরো হয়ে ওঠা

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও প্রতাপ চন্দ্র সারাঙ্গী
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও প্রতাপ চন্দ্র সারাঙ্গী

নতুন ‘নায়ক’দের সময়
ভারতের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ হয়েছে। আরও হবে। ভোটারদের ‘মন জয়’-এর কারণ হিসেবে বিজেপি ও মোদি জির অনেক ইতিবাচক কাজের বিবরণ জানাচ্ছেন আলোচকেরা। তবে একটি বিষয় আলোচনায় বেশি আসেনি। বিজেপি জোটের মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধে বিচারাধীন আসামির সংখ্যাও গতবারের চেয়ে বেশ বেড়েছে এবার। মোদির প্রথম মন্ত্রিসভায় ‘আসামি’ ছিল ৩১ শতাংশ। এবার হয়েছে ৩৯ শতাংশ। আসামি হলেও এঁরা ভোটেই ‘জিতে এসেছেন’; সেটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে!

ভারতের গবেষণা সংস্থা এডিআর জানাচ্ছে, ৩০ মে ভারতে নতুন যে মন্ত্রিসভা হলো, তার ৫৭ সদস্যের ২২ জনের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি মামলা আছে। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামাতেই সেটা উল্লেখ করেছিলেন এই মন্ত্রীরা। এর মধ্যে ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের ধরন ‘গুরুতর’। অর্থাৎ অনেকের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ ইত্যাদির মামলাও আছে। এ রকম সাতটি পর্যন্ত মামলা আছে এমন ব্যক্তিও মন্ত্রী হয়েছেন। এর মধ্যে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিরুদ্ধে রয়েছে চারটি মামলা। অথচ তাঁকে নিয়েই এই মুহূর্তে সমগ্র ভারত উচ্ছ্বসিত।

এবারের নির্বাচনের পর নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেও বিশ্লেষক ও প্রচারমাধ্যমে ক্ষণে ক্ষণে উচ্চারিত হচ্ছে অমিত শাহর নাম। তাঁকে নিয়ে বই প্রকাশের ঘোষণা এসেছে। সিনেমা তৈরির উদ্যোগ চলছে। বলা হচ্ছে, রাজনীতিতে অমিত শাহর আক্রমণাত্মক ভঙ্গি ও বিরোধীদের দলনে নির্মমতাই বিজেপির ভূমিধস বিজয়ের মূল জাদু। অমিতই মূল ‘নায়ক’।

গুজরাটের অমিত শাহ যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
জিন্নাহ ও গান্ধীর পরিবারের সূত্রে উপমহাদেশের ইতিহাসে গুজরাটের বিশেষ খ্যাতি আছে। সেই গুজরাট এখন আরও গর্বিত মোদি ও অমিত শাহকে নিয়ে। এই বিস্ময় ইতিমধ্যে ভারতীয়দের কেটে গেছে যে, গান্ধীর গুজরাট থেকেই অমিত শাহ উঠে এসেছেন।

গান্ধীর জগৎখ্যাত উক্তি ছিল, ‘চোখের বদলে চোখনীতি গোটা বিশ্বকে অন্ধ করে দেবে।’ অমিত শাহর সামনে অবশ্য এ মুহূর্তে উৎপাটনযোগ্য আর কিছু বাকি নেই। তিনি বহু কিছু ছিলেন। বহু কিছু হলেন। তার মধ্যে গুজরাট দাবা ফেডারেশনের একসময়কার সভাপতিও ছিলেন। অসাধারণ এই ‘দাবাড়ু’ ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিপক্ষদের তো বটেই খোদ বিজেপির আদভানি, সুষমা স্বরাজ, মুরলি মনোহর যোশিদেরই নিঃস্ব করে রাজনীতি থেকে বিদায় দিয়েছেন।

ভারতজুড়ে বহুল আলোচিত ‘সোহরাবুদ্দীন মার্ডার কেস’ দিয়ে ফৌজদারি মামলার জগতে অমিত শাহর অভিষেক হয়। সাধারণ মানুষ তো বটেই, তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ কর্মকর্তাদেরই আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিপুল দৃষ্টান্ত আছে। গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে যাঁরাই তাঁর কথা শোনেনি, তাদেরই খারাপভাবে বিদায় নিতে হয়েছে।

২০১২ সালে নির্বাচনী হলফনামায় স্ত্রীসহ অমিত শাহর সম্পদ দেখানো হয়েছিল ১২ কোটি রুপির। এবার সেটা দেখানো হয় ৩৯ কোটি। বিজেপির এক মেয়াদেই শাহ পরিবারের সম্পদের এরূপ বৃদ্ধি এ মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতিতে মোটেই কোনো ইস্যু নয়। বিজেপির সভাপতি হওয়ার পথে কোনো ধরনের অপরাধের অভিযোগ তাঁকে থামাতে পারেনি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আবির্ভাব তাই সমগ্র ভারতের জন্যই বিশেষ বার্তাবহ।

সাত মামলার আসামি পেলেন দুই মন্ত্রণালয়
ভারতে নতুন মন্ত্রিসভার অভিষেকের ৯ দিনের মাথায় মোদি শ্রীলঙ্কায় গেছেন। সেখানে তিনি জঙ্গি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত খ্রিষ্টানদের সহানুভূতি জানিয়েছেন। কিন্তু ভারতে তাঁর মন্ত্রিসভা নিয়ে খ্রিষ্টানরা চরম হতাশ ও ক্ষুব্ধ। কারণ তাতে স্থান দেওয়া হয়েছে প্রতাপ চন্দ্র সারাঙ্গীকে।

ফৌজদারি মামলার আসামি মন্ত্রীদের মধ্যে প্রতাপ চন্দ্র এ মুহূর্তে শুধু ভারত নয়, বৈশ্বিক মনোযোগ কেড়েছেন। বিজেপি প্রভাবিত মিডিয়াগুলো ওডিশার এই হিন্দুত্ববাদী সংগঠককে সাদাসিধা একজন মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে সচেষ্ট। ঢাকার প্রচারজগতেও তার ছাপ পড়েছে। এটা সত্য, সাধারণ পোশাক পরেন তিনি এবং থাকেন কুঁড়েঘরের মতো একটা বাড়িতে। তাঁর ব্যাংক ব্যালান্সও সামান্য। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এসব অতি বিরল এখন। কিন্তু প্রতাপ চন্দ্রের ক্ষেত্রে এসবকে বিভ্রান্তিকর প্রচ্ছদ বলেও গণ্য করা যায়।

৬৪ বছর বয়সী সাদাসিধা মানুষটি সাতটি ফৌজদারি মামলার আসামি। মারামারি, খুনোখুনি, অন্য ধর্মের মানুষদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উসকে দেওয়া ইত্যাদি নানান অভিযোগ ‘জনপ্রিয়’ এই নেতার বিরুদ্ধে। আরএসএস-বিজেপি পরিবারের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক গণসংগঠন বজরং দল ওডিশার সভাপতি তিনি। এই বজরং দলের কর্মীরাই ১৯৯৯-এ ওডিশায় অস্ট্রেলিয়ার খ্রিষ্টান পুরোহিত গ্রাহাম স্টেইনকে দুই ছেলেসহ ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে হত্যা করেন। প্রতাপ এখনো এই হত্যার মাঝে কোনো সমস্যা খুঁজে পান না।

২০০২ সালে ‘বজরং দল’, ‘দুর্গাবাহিনী’ এবং ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ মিলে ওডিশার বিধানসভা ভবনে যে হামলা করে, তাতেও প্রতাপ নেতৃত্বে ছিলেন বলে কথিত রয়েছে। সে সময় আটকও হন তিনি।

বিরুদ্ধবাদীদের অভিযোগ, উগ্র মতাদর্শ ও ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানোতে বিশেষ দক্ষ তিনি। এই ‘দক্ষতা’তেই ওডিশা থেকে লোকসভার সদস্য হয়ে মোদির টিমে যুক্ত হতে পেরেছেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য, তাঁকে দুটি দপ্তরের মন্ত্রী করা হয়েছে। সম্ভবত ভারতজুড়ে খ্রিষ্টানদের একটা শক্ত বার্তা দিতেই সচেতনভাবে প্রতাপ চন্দ্র সারাঙ্গীকে দুই দপ্তরের মন্ত্রী করা হলো।

বিজেপির কর্মীরা তাঁকে বলছেন ‘ওডিশার মোদি।’ তবে শুধু ওডিশা নয়, প্রায় সব রাজ্যেই এখন এ রকম মোদি বিপুল। অধিকাংশ ব্যক্তিই নায়কোচিত সংবর্ধনা নিয়ে উঠে আসছেন নয়াদিল্লির দিকে। কারও কারও জীবনবৃত্তান্ত অমিত শাহ ও প্রতাপ চন্দ্রের চেয়েও ‘সমৃদ্ধ’। হাল আমলের এ রকম আরেক তারকা প্রাগ্য ঠাকুর। এখনো মন্ত্রী হননি। তবে প্রতাপ চন্দ্রের মন্ত্রিত্ব পাওয়া প্রাগ্য ঠাকুরের মন্ত্রী হওয়ার পথে আশাবাদ তৈরি করেছে।

২০০৮-এর সেপ্টেম্বরে ভারতজুড়ে সিরিজ বোমা হামলার প্রধান কারিগর হিসেবে প্রাগ্যকে অভিযুক্ত করা হয়। কোথাও কোথাও মুসলমানদের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে এবং কোথাও আবার মুসলমানবিরোধী দাঙ্গা উসকে দিতে হিন্দু স্থাপনা লক্ষ্য করে ওই সন্ত্রাসী কাজ চালানো হয়। হামলার কাজে ব্যবহৃত প্রাগ্যর মোটরসাইকেলটি ঘটনাস্থলেই পাওয়া যায়। তাঁর নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী একটি গোষ্ঠী এই হামলায় যুক্ত বলে বিভিন্ন তদন্তে বেরিয়ে আসে। তাঁদের আদালতে আনা হলে সবাইকে চমকে দিয়ে ‘শ্রী রাম সেনা’ নামের একটি সংস্থা আইনি সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে। পরে বাড়তি তদন্তে দেখা যেতে থাকে ‘রাষ্ট্রীয় জাগরণ মঞ্চ’, ‘অভিনব ভারত’ ইত্যাদি নামে বহু গোপন সংগঠন প্রাগ্যদের সহযোগী। ওই ঘটনায় অন্তত ১০ জন মারা যান এবং শতাধিক মানুষ আহত হন। ঘটনায় সম্পৃক্ততার জন্য ইতিমধ্যে নয় বছর কারাগারেও কাটিয়েছেন প্রাগ্য। এবারের নির্বাচনে বিজেপি তাঁকে ভূপাল থেকে মনোনয়ন দেয়। মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দ্বিগবিজয় সিংকে প্রায় চার লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে প্রাগ্যের বিজয় প্রমাণ করছে, হত্যা ও দাঙ্গায় তাঁর সম্পৃক্ততা ভোটারদের কাছে তাঁর মর্যাদাই শুধু বাড়িয়েছে। নির্বাচনী প্রচারকালে প্রকাশ্যেই তিনি গান্ধীর হত্যাকারীকে ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে অভিহিত করতেন। অমিত শাহ নিজে প্রাগ্যের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগকে মিথ্যা বলছেন। আর এও হয়তো অনেক পাঠকের জানা, প্রাগ্য যে ঘটনার আসামি,Ñতার প্রধান তদন্তকারী কর্মকর্তা হেমন্ত কারকারে আরেক ‘সন্ত্রাসী’ ঘটনায় রহস্যজনকভাবে নিহত হন।

লোকসভা যেন বিচারাধীন আসামিদের মিলনমেলা
এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, প্রগ্যা ও প্রতাপরা বিচ্ছিন্ন কোনো প্রতীক। এদের তালিকা দীর্ঘ এবং তাঁরাই ভারতীয় রাজনীতিতে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ।

উল্লিখিত গবেষণা সংস্থা এডিআরের আরেক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভারতে এবার লোকসভায় যতজন এমপি হয়েছেন তাঁদের ২৩৩ জনের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো অপরাধের মামলা রয়েছে। এটা গত সংসদের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। এডিআরের তথ্য থেকে শঙ্কা হয় ভারতীয় পার্লামেন্ট বিচারাধীন আসামিদের মিলনমেলায় পরিণত হচ্ছে কি না। এ রকম আসামি এমপিরা সবাই বিজেপির নন, কংগ্রেসেরও আছেন। অন্য দলেরও আছেন। তবে বিজেপির প্রতিনিধি সংখ্যা অন্যদের চেয়ে বেশি। তাদের ৩৯ ভাগ এমপিই ফৌজদারি আসামি।

ভারতে বিচারাধীন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বাধা নেই। তবে অপরাধী প্রমাণিত হলে এমপিত্ব যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে, ঠিক কী ভরসায় এত এত অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন?

এর উত্তর খুব সোজা। এর উত্তর হলেন অমিত শাহ। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতায় থাকলে গুরুতর অভিযোগের ফৌজদারি মামলাও রাজনীতিতে আসামিদের স্তব্ধ করতে পারে না। এর তারকাসাক্ষী বিজেপির প্রেসিডেন্ট। এ রকম ক্ষেত্রে বিজেপি যা করেছে তা হলো অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ধর্মের ঢাল দিয়ে আড়াল করেছে। মুসলমান ও খ্রিষ্টান বিরোধিতার সৈনিক হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে বোমা হামলা, খুন, ধর্ষণের আসামিদেরও। ঠিক এই ফর্মুলাতেই আইনের চোখে ভিলেন হলেও ধর্মভীরু ভারতীয় হিন্দুদের কাছে অনেক ‘অপরাধী’ আজ হিরো। এরাই হয়ে দাঁড়িয়েছেন আম্বেদকর, গান্ধী, নেহরুদের উত্তরপুরুষ।

অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর চোখে ‘নিরপরাধ’ প্রাগ্য ঠাকুরের মামলার পরিণতি কী দাঁড়াবে, তা অনুমান করা দুঃসাধ্য নয়। আবার প্রাগ্য ঠাকুর মন্ত্রী হলে যাঁদের বিরুদ্ধে ২০০৮-এ বোমা বসানো হয়েছিল, তাদের যে আরও দুর্গতি আছে, সেটাও নিশ্চিত।

কিন্তু এটা ইতিমধ্যে চূড়ান্ত, অমিত শাহ, প্রতাপ চন্দ্র, প্রাগ্য ঠাকুররাই লোকসভায় বসে আগামী দিনের ভারতের নীতি নির্ধারণ করবেন। সে ভারতের অভিমুখটি অনুমান করা দুঃসাধ্য নয়। কিন্তু সে রকম এক ভারত কতটা স্বস্তিকর হবে?

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক