ক্রিকেট, আড়ং, চমস্কি

নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের কাছে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সঙ্গে সঙ্গে কে বা কারা দায়ী খুঁজতে শুরু করলাম আমরা। আমি নিজে সরাসরি কাউকে দায়ী না করলেও একগাদা উপদেশ দিতে ভুললাম না। ফেসবুকে লিখলাম, মিঠুনকে বাদ দেওয়া উচিত। পরের ম্যাচে মাশরাফির পরিবর্তে অন্য একজন বোলারকে নামানো যায় কি না, এ প্রশ্নও তুললাম সেখানে।

ঘণ্টা ছয়েক পর ফেসবুকে গিয়ে দেখি, তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে সেখানে। পনেরো হাজার মানুষের পছন্দ হয়েছে আমার কথা। প্রায় আড়াই হাজার মানুষ নিজেরাই বিভিন্ন মতামত দিয়েছে। প্রায় সবাই ঝানু নির্বাচকের মতো বলা শুরু করেছে কাকে বাদ দিতে হবে। প্রথম কয়েকটা পড়ে বুঝলাম, সাকিব বাদে ক্রিকেট দলের ১১ জনের ১০ জনই বাদ পড়ে গেছে কারও না কারও বিবেচনায়। আমি নিশ্চিত, একটা-দুটো খেলা খারাপ খেললে বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা খেলোয়াড় সাকিবকে বাদ দেওয়ার মতো নির্বাচকের অভাব হবে না এ দেশে।

এটি হয়তো স্বাভাবিক একটা বিষয় গোটা উপমহাদেশেই। ক্রিকেট এখানে এমন একটা জায়গা, যাতে জনমানুষের সবার অংশগ্রহণ আছে, আছে ক্রিকেট দলের গৌরব আর সম্মানে অংশীদারত্ব। তাই সেখানে একচুল ব্যর্থতা, একটু বিচ্যুতি, সামান্য ভুল মানতে চাই না আমরা। ক্রিকেটে আমরা হাথুরুসিংহে, পাপন, সাকিব, সৌম্য—কার না ব্যবচ্ছেদ করেছি আর করি প্রায় প্রতিটা সময়!

তবে এটা শুধু ক্রিকেটপ্রেমের কারণে না। এর সঙ্গে আমাদের স্পর্শকাতর মন, নির্দ্বিধায় মতামত প্রকাশের মানসিকতা এবং জাজমেন্টাল হয়ে ওঠার অভ্যাসেরও সম্পর্ক আছে। ফেসবুকের কল্যাণে আমরা এখন এটি ভালোভাবে বুঝতে পারি। অনেক বিষয়ে ফেসবুকে আমরা এখন অতি দ্রুত নিজের মতামত জানাই। এটা কতটা বেড়েছে, কতটা এর ফলাফল, তার দুটো অতি সাম্প্রতিক প্রমাণ আমরা পেয়েছি আড়ংয়ে অভিযানকারী সরকারি কর্মকর্তার স্বীয় পদে পুনরায় বহাল হওয়ার এবং চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ঘটনায়।

তবে ফেসবুকে কালো আইনের ভয় আছে, অতি ক্ষমতাবান কারও বিরুদ্ধে কিছু বললে মামলা-হামলার শিকার হতে হয়, তার বহু নজির আছে আমাদের দেশে। সে জন্য আমরা ফেসবুককেন্দ্রিক বিতর্কের আরেকটা লক্ষণ দেখি এখানে। ফেসবুকে অনেক সময় আমাদের বিতর্ক বা প্রতিবাদটা হয় অবস্থা জেনে, ঝুঁকি মেপে, হাওয়া বুঝে। ক্রিকেট দলের মতো কারও বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ঝুঁকি না থাকলে তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা। যেখানে মামলা আর হেনস্তার ভয়, সেখানে প্রতিবাদ হয় রয়ে-সয়ে।

এই প্রবণতা বাড়ছে দিনকে দিন।

২.
সামাজিক মাধ্যমে আমরা একটা তুলকালাম বিতর্ক দেখলাম সম্প্রতি আড়ংকে কেন্দ্র করে। আড়ংয়ের একটি আউটলেটে ভুলে বা সজ্ঞানে একটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বিক্রয় হচ্ছিল। এই অপরাধে বিরাট অঙ্কের জরিমানা হয় আউটলেটটির, সেটি বন্ধও রাখা হয় এক দিন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আড়ংকে একেবারে বর্জন করার ডাক দিয়ে দিল কিছু মানুষ ফেসবুকে। আড়ংয়ে অভিযান চালানো সরকারি কর্মকর্তাকে বদলি করে দেওয়া হলো ২৪ ঘণ্টার মাথায়। বর্জনের ডাকের প্লাবন নামল এবার।

আড়ং বর্জন হলে গরিব উৎপাদন কর্মীর ক্ষতি, বৈধ-অবৈধ বিদেশি পণ্যের লাভ, আড়ংয়ের উপার্জন কমলে তৃণমূল মানুষের কল্যাণমূলক প্রকল্প, সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান, দেশের ইমেজ সবকিছুর ক্ষতি—এসব বিবেচনায় নিল না প্রায় কেউই। আড়ংয়ের বিরুদ্ধে মাত্রাহীন প্রতিবাদেও ঝুঁকি নেই, এটাও বোধ হয় উদ্দীপ্ত করল বহু মানুষকে।

আড়ংয়ের বিরুদ্ধে কি তাই বলে প্রতিবাদ করা যাবে না, আড়ং কি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকবে? প্রশ্নই আসে না। আড়ং অপরাধ করলে শাস্তি পাবে, সে তার পণ্যের প্রস্তুতকারীদের ন্যায্যমূল্য না দিলে, তার পণ্যের দাম বা মান ঠিক না থাকলে অবশ্যই এর সমালোচনা হবে—এসব স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু যে প্রবল ক্রোধে আড়ংকে বর্জনের ডাক আসে, তাতে মনে হয় ক্রেতা অধিকার, মানবাধিকার, সরকারি নিয়মনীতি—এসব বিষয়ে আমরা একটা অতি উচ্চ মানে আছি এ দেশে, এই মানে আঘাত অসহনীয় হয়ে উঠেছে আড়ংয়ের কর্মকাণ্ডে।

কিন্তু আসলে বিষয়টা তো এমন নয়। আড়ং যে ভুল বা অন্যায় করেছে, তার চেয়ে বহুগুণে আপত্তিকর কর্মকাণ্ডে আমরা তো এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠি না। অতি ক্ষমতাবান যেসব রথী-মহারথী শেয়ার মার্কেটে কারসাজি করে বহু মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে বা ব্যাংকে রাখা মানুষের টাকা মেরে যারা দেশের হাজার কোটি টাকার ক্ষতি করেছে, তাদের প্রতিষ্ঠান বা তাদের পণ্য আমরা কি বর্জনের ডাক দিই সেভাবে?

আমাদের প্রতিবাদটা সুবিধাবাদী অন্যান্য ক্ষেত্রেও। যাদের সম্পর্কে গুম, খুন, নির্যাতনসহ প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে কি প্রতিবাদে সোচ্চার হই আমরা একই মাত্রায়? সরকারি কর্মকর্তারা যখন, এমনকি বিচারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বদলি, হেনস্তা, চাকরিচ্যুত হন, তখন আমরা কি রুখে দাঁড়াই এর বিরুদ্ধে? যে ভোট-বঞ্চনার শিকার হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ গত নির্বাচনে, তার বিরুদ্ধে কি সবাই মিলে প্রতিবাদ করেছি ফেসবুকেরই পাতায়?

এ রকম বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে, যেখানে আমরা বহুল সংখ্যায় প্রতিবাদ করিনি, বর্জনের ডাক দিইনি বা আমাদের প্রতিবাদের স্বর ছিল অতি মৃদু। বরং এত এত দুষ্কর্মের কথা যে লিখলাম ওপরে, তার পক্ষেও সাফাই গাওয়া হয়েছে, এমন উদাহরণও আছে অনেক।

৩.
আড়ংয়ের বিরুদ্ধে বর্জনের ডাকটা তাই অস্বাভাবিক মনে হয়েছে আমার কাছে। একটা ম্যাচে খারাপ খেললে ক্রিকেটারদের মুণ্ডুপাত, এমনকি দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলাও ঠিক স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ মনে হয় না আমার কাছে। কিছুদিন আগে ‘গা-ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ মেয়েদের জন্য এমন একটি টি-শার্ট বাজারে ছাড়া হলো। বহু মানুষ এর মধ্যে অশ্লীলতা ও রুচিহীনতার পরিচয় পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাসেম বিন আবু বকরের বই বা মাহফুজুর রহমানের গান শুনে সাহিত্য-সংস্কৃতি গেল বলে শোরগোল তোলা হয় ফেসবুকে।

আমার কাছে মনে হয়, এত প্রতিবাদ, এমন সুউচ্চ রুচি ও বিবেকবোধ আরও অনেক বড় বড় ঘটনায় কোথায় থাকে আমাদের? বাংলাদেশের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের সম্পর্ককে যখন এক মন্ত্রী স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেন, অন্য দেশের টিভি যখন অসুস্থ বিনোদনে আমোদিত করে আমাদের, বাংলাদেশের চাকরির বাজার যখন খেয়ে নেয় অন্য দেশের মানুষ, গুরুত্বপূর্ণ কারও সম্পর্কে একটু এদিক-সেদিক হলে মামলার বন্যা বয়ে যায়, রাষ্ট্রের অর্থ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন যখন ব্যক্তির নামে প্রচার করা হয়, রাস্তায় অতি পরাক্রমশালীরা চলাচল করলে যখন নাভিশ্বাস ওঠে সাধারণ মানুষের, তখন কেন আমরা এতটা সোচ্চার হয়ে উঠি না?

হয়তো এর উত্তর আছে কোথাও। আমি কোটেশন দিতে পছন্দ করি না। তবু এখানে নোয়াম চমস্কিকে উদ্ধৃত না করে পারছি না। ১৯৯৮ সালে তাঁর দ্য কমন গুড গ্রন্থে (পাতা-৪৩) তিনি বলেছেন: মানুষকে বাধ্যগত রাখার স্মার্ট উপায় হচ্ছে সে কোন কোন বিষয়ে মতামত দিতে পারবে, তার সীমা কড়াকড়িভাবে ঠিক করে দেওয়া, কিন্তু এই সীমার মধ্যে তাকে প্রাণবন্ত বিতর্ক করতে দেওয়া। এটি মানুষকে এমন ধারণা দেয় যে সমাজে মুক্তচিন্তা হচ্ছে, যদিও তর্কবিতর্কের ওপর রাষ্ট্রের আরোপিত সীমারেখা সব সময় আরও শক্তিশালী করা হতে থাকে।

আমাদের দেশে খুব সম্ভবত এটাই হচ্ছে। আমাদের মনে গেঁথে গেছে ভয়ের নোঙর, আমরা প্রতিবাদ করি ঝুঁকি মেপে মেপে। আবার নিজেকে ভারমুক্ত বোধ করার জন্য অতিমাত্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ি নিরাপদ ভূমিতে।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক