মেক্সিকো চুক্তি থেকে ট্রাম্পই বেশি লাভবান

মার্কিন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

কোরীয় উপদ্বীপে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকির অবসানে ভূমিকা রাখার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার গুঞ্জন উঠেছিল কবে, তা কি আপনাদের মনে আছে? এটা বেশি দিন নয়, বছরখানেক আগের কথা। ট্রাম্প তখন সিঙ্গাপুরে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। কংগ্রেসের কয়েকজন রিপাবলিকান সদস্য তখন ট্রাম্পকে নোবেল দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। ট্রাম্পের একটি সমাবেশে জনতা স্লোগান ধরেছিল, ‘নো-বেল!’

সবশেষে দেখা গেল ট্রাম্প-উন বৈঠকের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো উত্তর কোরিয়ার। প্রোপাগান্ডার দিক থেকে তাদের জয় হলো। ট্রাম্পও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে হম্বিতম্বি করা বন্ধ করে শান্ত হয়ে গেলেন। কিম জং-উন পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সম্মত হলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক খবরের ছিটেফোঁটারও যারা খোঁজ রাখে তারা জানে উত্তর কোরিয়া ‘পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ কার্যক্রম’-এর যে সংজ্ঞা দিয়েছে, তার মধ্যে উত্তর-পূর্ব এশিয়া থেকে আমেরিকান পরমাণু কার্যক্রম সর্বাংশে গুটিয়ে নেওয়ার শর্ত অন্তর্ভুক্ত আছে। ওই ‘পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ কার্যক্রম’-এ উত্তর কোরিয়া যে ছাড় দিতে রাজি হয়েছে, তা একেবারেই অপ্রতুল।

 উনের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য ডানপন্থীরা এককভাবে ট্রাম্পকে কৃতিত্ব দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলেন। এমনকি প্রগতিশীল ও উদারপন্থী আলোচকেরাও ট্রাম্পের এই উদ্যোগকে মহান কূটনীতি হিসেবে স্বাগত জানালেন। দিন শেষে যেটি দাঁড়াল, সেটি হলো উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কার্যক্রম অব্যাহত থাকল, বিশ্বমঞ্চে উনের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ল এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হিসেবে ট্রাম্প প্রশংসা কুড়ালেন। কাজের কাজ কিছুই হলো না।

কয়েক দিন আগে প্রায় একই ধরনের একটি কাণ্ড ঘটালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মেক্সিকোর সঙ্গে একটি চুক্তি করার মাধ্যমে তিনি ‘সীমান্তে শরণার্থীর স্রোত আটকানোর ব্যবস্থা’ করেছেন। গত মাসে ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন, সীমান্তে অবৈধ শরণার্থীদের প্রবেশ ঠেকাতে মেক্সিকো ব্যবস্থা না নিলে মেক্সিকো থেকে আমদানি করা পণ্যে ৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হবে। পরে মেক্সিকো চুক্তি করে দেশজুড়ে, বিশেষত মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করতে রাজি হয়। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী মর্যাদাপ্রত্যাশীদের মেক্সিকোতে পাঠানো এবং এ-সংক্রান্ত আইনি লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সেখানেই অপেক্ষমাণ রাখার কর্মসূচিও বিস্তৃত করবে ওয়াশিংটন।

কট্টর রক্ষণশীলেরা এই চুক্তির পর ট্রাম্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। ট্রাম্প এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যে তাঁর প্রতিপক্ষের লোকজনের পক্ষে এ নিয়ে সমালোচনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে এ নিয়ে ট্রাম্পকে কৃতিত্ব দেওয়ার কিছু নেই। কারণ, কয়েক মাস আগেই মেক্সিকো একটি কার্যক্রম শুরু করেছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী মর্যাদাপ্রত্যাশীদের আইনি লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত মেক্সিকোতে রাখা এবং সীমান্তে আরও বেশি ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়। তার মানে এই চুক্তির মধ্য দিয়ে মেক্সিকোর অভ্যন্তরীণ উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র সহায়ক ভূমিকা রাখল। কিন্তু ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকেরা বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করলেন যেন আমেরিকান ও মেক্সিকান অর্থনীতিকে তিনি বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং জোরালো হলো।

মেক্সিকো সীমান্তে আটকে থাকা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে অনেকেই মানবেতর অবস্থায় আছেন। সে বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্র পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। বাড়তি শুল্ক দেওয়ার ভয়ে মেক্সিকোও তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না। এই মানবিক দিক ট্রাম্প ও তাঁর অনুসারীরা সুকৌশলে আড়াল করে রাখছেন। সমালোচকেরা মেক্সিকো সীমান্তের এই চুক্তি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঠাট্টা-মশকরা করার পর ট্রাম্প টুইট করে বলেছেন, মেক্সিকো যদি চুক্তি মানতে ব্যর্থ হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপের বিষয়টি কার্যকর করবে। অর্থাৎ চুক্তিটি কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে খোদ ট্রাম্পেরই সংশয় রয়ে গেছে এবং তিনি যে বরাবরের মতোই মেক্সিকো ইস্যুতে আবারও কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতে পারেন, তা-ও তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন।

উত্তর কোরিয়ার নেতার সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেও শেষ পর্যন্ত চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। এটি যে ট্রাম্পের বড় একটি ব্যর্থতা, সেটি ট্রাম্প শিবিরের কেউ স্বীকার করেন না। মেক্সিকোর সঙ্গে চুক্তি হলেও সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। এটি বাস্তবায়িত না হলে সে ব্যর্থতার দায়ও যে ট্রাম্প নেবেন না, তা জানা কথা।

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মিশেল গোল্ডবার্গ: লেখক ও নিউইয়র্ক টাইমস–এর কলামিস্ট