মিজান-বাসিরের ঘুষ নিয়ে ঘুষাঘুষি

মিজানুর রহমান ও খন্দকার এনামুল বাসির
মিজানুর রহমান ও খন্দকার এনামুল বাসির

চোরে ঢাকনা নিয়ে গেছে। সেই সুবাদে ম্যানহোলে পড়ে ঠ্যাং ভাঙার পর এক পৌরবাসী নালিশ নিয়ে গেছেন মেয়রের কাছে। মেয়র রাজনীতি করা লোক। ভোটারকে খুশি রাখা তাঁর কাজ। তিনি বললেন, ‘ভাতিজা, তুমি নো টেনশনে থাকো। চোরের বাপও যাতে আর ঢাকনা চুরি করবার না পারে, সেই ব্যবস্থা নিতেছি।’ লোকটা বলল, ‘কী ব্যবস্থা?’

মেয়র বললেন, ‘পইত্যেক ম্যানহোল পাহারা দেওয়ার জন্যি একজন করে সিকুরিটি গার্ড ফিট করব। সেই গার্ডরা ঠিকমতো ডিউটি করতিছে কি না, তাই দেখবার জন্যি দশজন সুপারভাইজার বসাব। সেই সুপারভাইজাররা ঠিকমতো ডিউটি করতেছে কি না, তাই দেখবার জন্যি পাঁচজন অবজারভার রাখব। সেই অবজারভাররা ঠিকমতো ডিউটি করতিছে কি না, তাই দেখবার জন্যি দুই শ সিসি ক্যামেরা ফিট করব। তারপর আমি ডোরোইং রুমে বইসে বইসে টিভির মধ্যি দ্যাখব শালার ব্যাটারা কী করে।’ পৌরবাসী লোকটা বলল, ‘সবই ঠিক আছে। কিন্তু কারেন্ট না থাকলি তো ক্যামেরা কাজ করবিনানে। আন্ধার পড়লিই তো আবার ঢাকনা চুরি হবিনে। গার্ড, সুপারভাইজার, অবজারভার—কাউরেই তো তহন নজরে আনতি পারবেননানে।’ মেয়র বললেন, ‘জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে আর কারেন্টের উপর কারু হাত নাই। কারেন্ট না থাকলি আমারও করার কিছু নাই।’

এবার লোকটা স্বস্তি ফেলে বলল, ‘আপনার যেহেতু কিছু করার নাই, তাইলে সত্যি কথাডা কয়া ফেলি। আমি বিদ্যুৎ বিভাগে সুইচম্যানের চাকরি করি, মানে কোনো এলাকায় কখন কারেন্ট থাকবে না থাকবে, তার সুইচ অফ অন করার কাম করি। আর আউট ইনকাম হিসেবে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করি।’

এই গল্পের পৌরবাসীর মতো আমরাও ডেইলি ডেইলি ম্যানহোলে পড়ি। ডেইলি ডেইলি ঠ্যাং ভাঙি। ডেইলি ডেইলি নালিশ করি। যাঁদের কাছে নালিশ করি, তাঁরা নতুন নতুন বরাদ্দ পাস করিয়ে চৌকিদার, দফাদার, পাইক–পেয়াদা, বরকন্দাজ, সিসি ক্যামেরা, স্যাটেলাইট—আরও যা যা আছে, সব বসান। কিন্তু যেহেতু আমরা নিজেরাই ‘কারেন্টের কাম’ করি এবং ‘সাইড ইনকাম’ হিসেবে ঢাকনা সরাই, সেহেতু ঢাকনা চুরি বন্ধ হয় না। আমাদের ঠ্যাং ভাঙতেই থাকে।

যারা দুর্নীতি-অনিয়ম করে, তাদের ধরতে পুলিশ, র‍্যাব, গোয়েন্দাসহ বহু সংস্থা বানানো হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ ‘বে-লাইনে’ গেলে তাকে ধরার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আছে। এখন দুদকের কেউ ‘বে-লাইনে’ গেলে তাকে ‘লাইনে’ আনবে কে? পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমান (তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়েছে) এবং দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাসিরকে (তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে) নিয়ে যেসব খবরাখবর বের হচ্ছে, তারপর এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

মিজানুর সাহেব বলছেন, বাসির সাহেব তাঁকে মামলা থেকে বাঁচিয়ে দেবেন বলে জবান দিয়েছিলেন। আজকালকার বাজারে খালি খালি কেউ কাউকে বাঁচায় না। খরচা আছে। খরচা বাবদ বাসির সাহেব মোটে লাখ পঞ্চাশেক টাকা চেয়েছিলেন। দেনদরবার করে ৪০ লাখ টাকায় আপসরফা হয়েছিল। দুই কিস্তিতে মিজান সাহেব বাসির সাহেবকে টাকাটা দিয়েছিলেন। কিন্তু কথা রাখেননি বাসির সাহেব। তাই মিজানুর সাহেব ‘মরবই যখন, তখন তোমাকে নিয়েই মরব’ নীতি নিয়েছেন।

পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদে যদু–মধু যেতে পারেন না, এ জন্য একজন অফিসারকে বহু কৃতিত্ব দেখাতে হয়। সেই সব পথ পার হয়ে মিজানুর রহমান এই পদে এসেছিলেন। কিন্তু কপাল খারাপ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দ্বিতীয় স্ত্রী মরিয়ম আক্তারকে গ্রেপ্তার করানোর অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। এক সংবাদপাঠিকাকে প্রাণনাশের হুমকি ও উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে তাঁর নামে জিডিও হয়েছিল। এসবের জের ধরে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে তাঁকে। এরপর তাঁর অবৈধ সম্পদের তদন্ত শুরু করেছিল দুদক। মিজানুরের দুর্নীতির তদন্তের ভার পড়েছিল এনামুল বাসিরের ওপর। তিনি মিজানুরকে অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর মিজানুর খেপে গিয়ে ঘুষ নেওয়ার কথা বলেছেন। প্রমাণ হিসেবে হাজির করেছেন এনামুল বাসিরের সঙ্গে কথোপকথনের একাধিক অডিও রেকর্ড। এনামুল বাসির বলেছেন, তিনি মিজানুরের সঙ্গে ‘খোশগল্প’ করেছেন। টাকাপয়সার আলাপের প্রশ্নই আসে না। অডিও রেকর্ডটি বানোয়াট।

ঘুষ দেওয়া তো খারাপ, দিতে গেলেন কেন? এই প্রশ্নের জবাবে মিজান সাহেব বলেছেন, তিনি ঘুষ দেননি। বাসির সাহেবকে ফাঁদে ফেলার ‘চার’ হিসেবে টাকাটা দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি চাকরি করে ক্যাশ ৪০ লাখ টাকা কোথায় পেলেন, তা নিয়ে অবশ্য তিনি কিছু বলেননি।

এই দেশে কেঁচো খুঁড়তে গেলেই সাপ বের হয়। তাই সাধারণ কেঁচো খুঁড়তে যাওয়া হয় না। কিন্তু সাপ যখন নিজেই বের হয়ে আসে, তখন তো তাঁকে না ধরে উপায় থাকে না। মিজানুর সাহেব যে বাসির সাহেবকে পয়সা দিয়েছেন, তা তো কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদক খুঁচিয়ে বের করেননি। মিজানুর সাহেব নিজেই সাংবাদিক ডেকে এ কথা বলেছেন।

ঘুষ দেওয়া-নেওয়া দুটোই অপরাধ, তা সবাই জানে। কিন্তু ঘুষদাতা ও গ্রহীতা যদি পুলিশ ও দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হন, তাহলে ওই দুই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে পাবলিকের কী ধারণা হয়, তা বুঝতে আর কারও বাকি থাকে না। দুদকের চেয়ারম্যান বলেছেন, ব্যক্তির দায় দুদক নেবে না। বাসির সাহেব ঘুষ নিয়ে থাকলে দুদকের নাকি বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। এটা কেমন কথা? বাসির সাহেব যদি দুদকের পরিচালক না হয়ে শিশুপার্কের সামনের বাদাম বিক্রেতা হতেন, তাহলে টাকার বস্তা নিয়ে তাঁর কাছে কে যেত? দুদকের পরিচয়ের জোর খাটিয়ে যদি কেউ আর্থিক সুবিধা হাতিয়ে নিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর পরোক্ষ দায় দুদকের ঘাড়েই পড়ে। অবশ্য দুদক খুব দ্রুতই বাসিরকে সাময়িক বরখাস্ত করে এ বিষয়ে তদন্ত করা শুরু করেছে।

এখন কথা হলো, মিজানুর বা বাসির—যিনিই দোষী হোন, পুলিশ ও দুদকের ক্ষতি যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে। পাবলিকের কাছে আবারও পরিষ্কার হয়েছে ম্যানহোলের ঢাকনা পাহারায় যে চৌকিদার, দফাদার বসানো হয়েছে তাঁদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছেন, যাঁরা ইনকামের চেয়ে ‘আউট ইনকামে’ বেশি আগ্রহী। এঁদের ব্যক্তিচরিত্রের কারণে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট এই দুই মহান প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নিয়ে মানুষ সন্দিহান হয়ে পড়ছে।

সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো, মিজানুর কিংবা বাসির সাহেবের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে কোনো ‘সুললিত’ অভিব্যক্তি দেখা যায়নি। একজন বীরোচিত ভঙ্গিমায় বলেছেন, ঘুষ দিয়েছেন। আরেকজন বলেছেন, কোনো ঘুষ নেননি। তাঁদের মধ্যে ঘুষ নিয়ে রীতিমতো ঘুষাঘুষি বেধে গেছে। ঘুষাঘুষি নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে আবার কানাঘুষা চলছে। কিন্তু তাতে তাঁরা লজ্জা পাচ্ছেন না। এত বড় অঙ্কের টাকা লেনদেনের সঙ্গে নিজেদের নাম জড়ানোর মধ্যে যেন একধরনের গৌরব নিহিত আছে—তাঁদের শরীরী ভাষা যেন সেটিই বারবার বলে দিচ্ছে।

২০০৮ সালে জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপি দুর্নীতিবিষয়ক একটি প্রাইমার প্রকাশ করেছিল। সেই নথিতে দুর্নীতির বর্গীকরণ করা হয়েছিল। সেই তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘ঘুষ’ মানে কাউকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে টাকা, পরিষেবা বা অন্য কোনো সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। ‘জালিয়াতি’ মানে কোনো অন্যায্য সুবিধা পাওয়ার জন্য ভ্রান্ত বা মিথ্যা তথ্য পেশ করা। ‘মানি লন্ডারিং’ মানে কালোটাকা সাদা করা, মানে অন্যায় পথে অর্জিত অর্থকে এক খাত থেকে অন্য খাতে পাঠিয়ে তাকে আইনি করে তোলা, ‘কিকব্যাক’ হলো বখরা, অন্যায়ভাবে কিছু টাকা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সেই টাকার একটা হিস্যা পাওয়া। সরকারি লাল ফিতার ফাঁস আলগা করে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুত কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য যে টাকা দেওয়া হয়, তার নাম ‘স্পিড মানি’।

ইউএনডিপি অকাজ–কুকাজকে বৈধতা দেওয়ার জন্য বা এই অন্যায়গুলোকে লঘু করে দেখার জন্য এই সব সংজ্ঞা দেয়নি। কিন্তু আমাদের কাছে এই সংজ্ঞাগুলো খুবই উপাদেয় হিসেবে হাজির হয়েছে। বিরাট বিরাট পদে থাকা লোকজন যখন বেতনবহির্ভূত আর্থিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, তখন আমরা এসব ইংরেজি মোড়ানো টার্ম ব্যবহার করি। এতে তাঁদের সামাজিক জেল্লার ক্ষতি হয় না। দুর্নীতি দমন কমিশন যে লোককে তলব করে, তাঁর সঙ্গে আত্মীয়তা করতে পারলে আমাদের জাতে ওঠা নিশ্চিত হয়। এই এলিট দুর্নীতিগ্রস্তদের লজ্জা ঢেকে রাখতে একটা কৃত্রিম অন্ধকার আমরা তৈরি করি। এতে আগের মতোই তাঁরা মান–মর্যাদা ভোগ এবং উপভোগ—দুটোই করতে থাকেন। একের পর এক আমাদের ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি যেতে থাকে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, প্রথম আলো

ই–মেইল: [email protected]