জাহাঁপনা, এতটা জালিম হবেন না

বাদশা সালমান, প্রজা মুর্তাজা কুরেইরিস, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
বাদশা সালমান, প্রজা মুর্তাজা কুরেইরিস, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।

মানো, নাহয় মরো। রাজতান্ত্রিক শাসকেরা প্রজাদের ‘অনুগত’ রাখতে এই কঠোর কৌশল প্রয়োগ করেন। তাঁরা কথায় কথায় প্রজার প্রাণ নেন। ‘প্রাণদণ্ডকে’ মসনদ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। সৌদি আরবের কিশোর প্রজা মুর্তাজা কুরেইরিসের ভাগ্যেও ঠিক একই ঘটনা ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় মুর্তাজার বয়স ছিল মাত্র ১০। তাঁর বাড়ি দেশটির শিয়া-অধ্যুষিত ইস্টার্ন প্রদেশে। সেখানে আরব বসন্তের হালকা ঝাপটা লেগেছিল। প্রতিবাদী বিক্ষোভে শামিল হয়েছিল মুর্তাজা। সে নেতৃত্ব দিয়েছিল সাইকেল শোভাযাত্রায়।

তিন বছর পর ২০১৪ সালে মুর্তাজাকে গ্রেপ্তার করে সৌদি কর্তৃপক্ষ। তখন তার বয়স ১৩। এই গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে মুর্তাজা সৌদির সর্বকনিষ্ঠ রাজবন্দী হয়।

মুর্তাজা একাই শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসার শিকার নয়। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও মূল্য দিচ্ছেন। মুর্তাজার বয়স যখন ১১, তখন তার এক ভাই বিক্ষোভে অংশ নিয়ে নিহত হয়। তার আরেক ভাইকে জেল দেওয়া হয়েছে। তার বাবাকে গত বছর আটক করা হয়।

মুর্তাজা এখন ১৮ বছরের তরুণ। চার বছর কারাভোগের পর এখন তিনি মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি।

বিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড সৌদি আরবে নতুন কিছু নয়। গত এপ্রিলে এক দিনেই ৩৭ নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সৌদি কর্তৃপক্ষ। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের। ২০১৬ সালে সৌদি আরবে এমন আরেকটি গণ-মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের খবর পাওয়া যায়। সেসময় সৌদি শিয়া নেতা নিমর আল-নিমরসহ ৪৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

কঠোর বিধিনিষেধের কারণে সৌদির সব খবর বাইরে আসে না। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের পরিসংখ্যান নিয়ে দেশটির কর্তৃপক্ষের স্বীকার করা তথ্যই উদ্বেগজনক। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সৌদি আরবে অন্তত ১০০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে বলে সৌদি প্রেস এজেন্সি জানিয়েছে।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব অন্যতম। অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় সংঘটিত কথিত অপরাধের জন্যও দেশটি তাদের নাগরিকদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আসছে। কথিত এই বিচার ফ্যাসিবাদী শাসনকেও হার মানায়।

সৌদি আরবে ফৌজদারি অপরাধে দায়ের বয়সসীমা অস্পষ্ট। আর এই সুযোগটাকেই দেশটির শাসকেরা নিজেদের হীন স্বার্থে কাজে লাগায়।

তবে ২০০৬ সালে সৌদি আরব কমিটি অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ডকে জানিয়েছিল, ফৌজদারি অপরাধের দায়ের বয়সসীমা বাড়িয়ে ১২ বছর করা হয়েছে।

তা ছাড়া দেশটি জাতিসংঘকে বলেছিল, নির্দিষ্ট বয়সসীমার আগে অপরাধ সংঘটনের দায়ে তারা কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয় না। কিন্তু বাস্তবের চিত্র ভিন্ন। এই এখন যেমন মুর্তাজার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছে।

শিশু মুর্তাজার বিরুদ্ধে হাস্যকর সব অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে সরকার-বিরোধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ, সহিংসতায় সহযোগিতা, সন্ত্রাসীবাদী গোষ্ঠীতে যোগদান ইত্যাদি।

এখন সন্ত্রাসবাদবিরোধী আদালতে মুর্তাজার বিচার চলছে। সরকারি কৌঁসুলিরা তাঁর মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন। তাঁদের যুক্তি, সরকার অমান্যে প্ররোচনার জন্য মুর্তাজার সর্বোচ্চ শাস্তিই হওয়া উচিত। এ জন্য অভিযোগপত্র তাঁর মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ করা হয়েছে।

মুর্তাজা তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, তাঁর কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করেছে কর্তৃপক্ষ।

২০১১ সালে সৌদির ইস্টার্ন প্রদেশে যে বিক্ষোভের জেরে মুর্তাজা আজ মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি, তার বর্ণনা দেশটির অধিকারকর্মীদের ভাষ্যে উঠে এসেছে। তারা জোর দিয়ে বলেছেন, ওই সময়কার বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ। বিক্ষোভে কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। সৌদির কর্তৃপক্ষও তখন এমন কিছু বলেনি। কিন্তু এখন কর্তৃপক্ষ বলছে, বিক্ষোভে সহিংসতা হয়েছিল।

বিরোধীদের বিরুদ্ধে ‘বানানো’ অভিযোগ তৈরির ক্ষেত্রে সৌদির কর্তৃপক্ষের জুড়ি নেই। দেশটিতে কেউ অধিকার চাইলে, গণতন্ত্রের পক্ষে রাস্তায় নামলে তাকে রাষ্ট্রবিরোধী ও সহিংস কর্মকাণ্ডের তকমা দেওয়া সৌদির শাসকদের পুরোনো অভ্যাস। পাশাপাশি বিরোধীদের নির্মমভাবে দমন করার বিষয়টি তো আছেই।

সৌদি আরব মুর্তাজাকে মৃত্যুদণ্ড দিলে তা মোটেই আশ্চর্যের হবে না। কারণ, চলতি বছরই তারা এমন তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে, যাদের বয়স কথিত অপরাধ সংঘটনের সময় ১৮ বছরের নিচে ছিল।

বাদশা বা তাঁর দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির আদেশে সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। বাদশা সালমান সৌদির সিংহাসনে থাকলেও কার্যত সব কাজ চালাচ্ছেন তাঁর ছেলে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।

যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েই বিরোধী বা ভিন্ন-মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে দমন-অভিযান জোরদার করেন। ক্ষমতা সুসংহত করতে তিনি শুধু নিজ দেশেই নৃশংসতা চালাচ্ছেন না। বাইরেও চলছে ‘কিলিং মিশন’। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে দেশটির সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে নির্মমভাবে খুনের পর তাঁর লাশ গুম করে দেওয়ার জন্য যুবরাজকেই দায়ী করা হয়।

যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশনায় ইয়েমেনে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমা ফেলছে সৌদি আরব। গত বছরের আগস্টে ইয়েমেনে সৌদির ছোড়া এক বোমাতেই ৪০ শিশু নিহত হয়। এ রকম বহু নিরীহ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে দেশটিতে। ইয়েমেন এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। এভাবেই ক্ষমতার গরম দেখাচ্ছেন সৌদি যুবরাজ।

এখন সৌদির বাদশা ও যুবরাজের ক্ষমতার লোভের বলি হওয়ার পথে মুর্তাজা।

সৌদির জাহাঁপনাকে বলি, এতটা জালিম হবেন না। মনে রাখবেন, জালিমেরা বেশি দিন টেকে না।

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]