গোকুলে বাড়ছেন তিনি

অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদি
অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদি

দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদির প্রথম দুটি সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন দুটি কমিটি গঠন তাঁর প্রথম সিদ্ধান্ত। একটি কমিটি নতুন লগ্নির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার বিষয়টি দেখবে, অন্য কমিটি দেখবে সেই প্রবৃদ্ধির ফলে যাতে দেশে কর্মসংস্থান বাড়ে। এই যে পাঁচটি বছর তিনি রাজত্ব করলেন, তাতে দেখা যাচ্ছে দেশের প্রবৃদ্ধি থমকে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার হার নিম্নগামী। সবচেয়ে বড় কথা, কর্মসংস্থান মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে গেছে। এই দুই সমস্যার দিকে তাই তিনি প্রথমেই নজর দিয়েছেন। দুটি কমিটিই একে অন্যের পরিপূরক।

লোকসভা ভোটের প্রচারে বিরোধীরা এই দুই সমস্যা বড় করে তুলে ধরেছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কৃষি ও কৃষকের সমস্যা। কিন্তু দেখা গেল, দেশের মানুষ সমস্যার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে সম্ভাব্য মুশকিল আসানকে। জনতা মনে করেছে, সমস্যা আছে ঠিক কথা। কিন্তু তার সমাধানের জন্য নরেন্দ্র মোদিকেই আরও একবার সুযোগ দেওয়া দরকার। কারণ, তিনিই এই মুহূর্তে যোগ্যতম নেতা। তা ছাড়া তিনি পরীক্ষিত।

৫ বছরে ১০ কোটি বেকারকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদি ক্ষমতায় এসেছিলেন। ভোটের আগে এই বিষয়কে বিরোধীরা বড় করে তুলেও ধরেছিল। প্রধানমন্ত্রী তার জবাবে বেকারত্বের অভিযোগ নস্যাৎ করার পাশাপাশি ‘পকৌড়া’ বা তেলেভাজার বিক্রিবাট্টাকেও রোজগার হিসেবে উল্লেখ করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। ঠিক ওই সময় কর্মসংস্থান নিয়ে সরকারি রিপোর্ট প্রায় প্রকাশ হয়ে যাচ্ছিল। কোনোরকমে তা চেপে দেওয়া হয়। সেই রিপোর্ট ভোটের ফল বেরোনোর পর প্রকাশ হয়েছে। সরকারের ‘ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস’ বা ‘এনএসএসও’ জানিয়েছে, ২০১৭–১৮ অর্থবছরে দেশে বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ, যা কিনা গত ৪৫ বছরে সবচেয়ে বেশি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেকার যুবক–যুবতীদের সংখ্যা ২০১১–১২ থেকে ২০১৭–১৮ সালে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে। ভোটের আগে শেষ তিন মাসের প্রবৃদ্ধির হারও প্রকাশ করা হয়নি। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, শেষ তিন মাসের প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। সারা বছরের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, যা কিনা লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে। দেশের অর্থসচিব জানিয়েছেন, প্রবৃদ্ধি আরও কমতে পারে।

ক্ষমতাসীন হয়ে এই জোড়া সমস্যার সমাধানে মোদির সচেষ্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত, পাঁচ বছরে এই দুটি ক্ষেত্রেই তিনি নিদারুণ ব্যর্থ। নতুন দুটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত এক অর্থে তাঁর সেই ব্যর্থতারই স্বীকারোক্তি।

প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত অমিত শাহকে প্রকারান্তরে দ্বিতীয় ক্ষমতাবান করে তোলা। নতুন ওই দুই কমিটি গঠনের পাশাপাশি মোদি তাঁর মন্ত্রিসভার আরও ছয়টি পুরোনো কমিটি পুনর্গঠন করেন। আশ্চর্যের বিষয়, প্রথমবার মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি কমিটিতেই রাখা হয়েছে অমিত শাহকে। সে জায়গায় প্রধানমন্ত্রী নিজে আছেন সাত কমিটিতে। অমিত শাহর চেয়ে সিনিয়র মন্ত্রী যাঁরা, বয়স ও অভিজ্ঞতায়, যেমন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন কিংবা পরিবহনমন্ত্রী নিতিন গড়কড়ি কেউই অতগুলো কমিটির সদস্য নন। খুবই সচেতনভাবে মোদি এই গুরুত্ব অমিত শাহকে দিয়েছেন এটা বোঝাতে যে মন্ত্রিসভায় তাঁর পরেই স্থান তাঁরই রাজ্যের ভূমিপুত্রের, যাঁর সঙ্গে তাঁর জুটি সেই গুজরাট থেকে এখনো অবিচ্ছিন্ন।

অমিত শাহকে এত গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চেয়েছিলেন দলে বিদ্রোহ–জাতীয় কিছু ঘটে কি না। আগামী দিনে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের সেই সম্ভাব্য স্থানবদল যে মসৃণভাবে ঘটে যাবে, সেই ইঙ্গিত কিন্তু পাওয়া যায়নি। বিদায়ী মন্ত্রিসভায় ২ নম্বর জায়গাটা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের। এবার তাঁর বদল ঘটেছে। রাজনাথের হাত থেকে স্বরাষ্ট্র নিয়ে তাঁকে দেওয়া হয় প্রতিরক্ষা। শপথ গ্রহণের দিন ক্রমানুযায়ীও রাজনাথ ছিলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি। কিন্তু কমিটি গঠনের আগের দিনেই দেখা গেল অমিত শাহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বৈঠক ডাকলেন। বোঝানো হলো, নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখবেন না। পরের দিন কমিটি গঠন হলো। সব কমিটিতেই তিনি। সে জায়গায় রাজনাথ সিং মাত্র দুটিতে। বিজেপির অন্দর মহলের খবর, কমিটি গঠন দেখেই ক্ষুব্ধ রাজনাথ পদত্যাগের কথা জানিয়ে দেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেদিনই সন্ধ্যায় আরও চার কমিটির সদস্য করে রাজনাথের ক্ষোভ প্রশমিত করা হয়। পরের দিন রাজনাথের ডাকা বৈঠকে অমিত শাহ তাঁর বাড়ি যান। সেই খবর ও ছবি কাগজে ছাপা হয়। বোঝানো হয়, রাজনাথকে অসম্মান করা মোদির লক্ষ্য নয়।

প্রকাশ্যে যা–ই হোক না কেন, এই বিশ্বাস মোটামুটি দৃঢ় যে সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি অমিত শাহই। মন্ত্রিসভার নিয়োগ–সংক্রান্ত কমিটিই ঠিক করে আমলাশাহির কোন কর্তাকে কোন দায়িত্বে আনা হবে। এই কমিটিতে মোদি ও অমিত শাহ ছাড়া তৃতীয় কারও উপস্থিতি নেই। ক্রমেই এই ধারণাও দৃঢ় হয়ে উঠছে যে মোদির পর ক্ষমতার ব্যাটন ধীরে অথচ নিশ্চিতভাবে অমিত শাহর হাতেই তুলে দেওয়া হবে। এখন চলছে তারই প্রস্তুতি। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য রাজ্যসভা, তারপর লোকসভায় প্রথমবারের মতো জিতে আসা সত্ত্বেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির বাংলোটি অমিত শাহকে তুলে দেওয়াও রাজনৈতিক দিক থেকে তারই ইঙ্গিতবাহী।

বিজেপির ঠিক করা নীতি হলো ‘এক ব্যক্তি এক পদ’। সেই নীতি অনুযায়ী অমিত শাহকে দলের সভাপতির পদ ছাড়তে হয়। প্রশ্ন হলো, শাহ তা করবেন কি না। চলতি সপ্তাহে এ নিয়ে দলের বৈঠক ডাকা হয়েছে। এমনিতে দলীয় সভাপতি হিসেবে শাহের মেয়াদ এই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। বছরের শেষাশেষি মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও ঝাড়খন্ড বিধানসভার ভোট। তিন রাজ্যের দলীয় কর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে সেদিন ম্যারাথন বৈঠক করলেন শাহ। তাঁর অনুগামীরা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, এখনই সভাপতির পদ থেকে তাঁকে যেন সরানো না হয়।

সেই দাবি মানা না হলে দ্বিতীয় এক সম্ভাবনা উঁকি মারছে। শোনা যাচ্ছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত অমিত শাহর ঘনিষ্ঠ কাউকে বিজেপির ‘ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট’ বা কার্যকর সভাপতি করা হতে পারে। তাঁকে সামনে খাড়া করে অমিত শাহ যাতে দল পরিচালনার কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। বিদায়ী সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন জগৎ প্রতাপ নাড্ডা। শাহর খুবই ঘনিষ্ঠ তিনি। এই চর্চায় তাঁর নাম উঠে এসেছে প্রবলভাবে।

সেপ্টেম্বর মাসে নরেন্দ্র মোদি ৬৯ বছরে পা দেবেন। ৫ বছর পর ২০২৪ সালের ভোটের সময় তাঁর বয়স হবে ৭৩। নিজের তৈরি করা নিয়ম মানলে ৭৫ বছর বয়সে অবসর গ্রহণে তাঁর বাকি থাকবে আরও ২ বছর। অর্থাৎ ২০২৪ সালের ভোটের প্রধান মুখও থাকবেন মোদিই। তারপর নিজের তৈরি নিয়ম মানলে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্ন উঠবে। দলে কানাঘুষো, এখন গোকুলে বাড়ছেন তিনি। নরেন্দ্র মোদির যাওয়ার সময় হলে তত দিনে তিনি তৈরি হয়ে যাবেন। এখন চলছে জমি তৈরির প্রস্তুতি।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি