কৃষকই কেন ঠকতে থাকবেন

ধান চাষ বাংলাদেশের ঐতিহ্য আর পরিচয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। দেশে-বিদেশে যেখানেই বাস করি না কেন, এক মুঠো ভাত পেটে না পড়লে বাঙালির খিদে মেটে না। আর গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিটি এখন পর্যন্ত ধান উৎপাদনকে আবর্তন করে রয়েছে। বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তার নিশ্চিত করতে ধান উৎপাদন যেমন মুখ্য ভূমিকা পালন করে, তেমনি দেশের সিংহভাগ নাগরিক, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বাঁচা-মরা তথা আর্থসামাজিক উন্নয়ন ধান উৎপাদন ও মূল্যের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে।

কৃষকেরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, এটা এখন বাংলাদেশের সর্বত্র আলোচনার বিষয়। এখন পর্যন্ত কৃষিমন্ত্রী বা খাদ্যমন্ত্রী কেউই এ বিষয় নিয়ে কোনো আশাব্যঞ্জক কথা বলেননি। নতুন বছরের বাজেটেও সুসংবাদ নেই। বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদও নীরব। যে দু-একজন কথা বলছেন, তা পুরোটা বিশ্লেষণের নিরিখে বলছেন বলে ধরে নেওয়া যায় না।
বাংলাদেশের উন্নয়নে কৃষকের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আজকের অনেকটা খাদ্যে উদ্বৃত্ত বাংলাদেশ কোনো জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় হয়নি। এর পেছনে রয়েছে কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম। গত এক দশকে বাংলাদেশে কৃষির গর্ব করার মতো যে অর্জন হয়েছে তার পেছনে সরকারের অবদানও প্রশংসা করার মতো। এ ছাড়া রয়েছে বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের অগ্রযাত্রা আর সম্প্রসারণ কর্মীদের পরিশ্রম।
বলা হচ্ছে, এ বছর বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন বেশি হয়েছে। সূত্রমতে, এবার গত বছরের তুলনায় কম জমিতে বোরো চাষ হলেও অনুকূল আবহাওয়া, উন্নত জাত (৮৮ শতাংশ উফশী, ১১ শতাংশ হাইব্রিড) ও প্রণোদনা দেওয়ার কারণে বোরোর উৎপাদন ৭ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে পূর্বাভাস ছিল। তা ছাড়া আমন ও আউশের ফলনও ভালো হয়েছে। ধান উৎপাদনের এই ক্রমবর্ধিত প্রবণতা গত কয়েক বছর থেকেই দৃশ্যমান। আর গত কয়েক বছরই কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য নিয়ে বিপাকে রয়েছেন। ধান কাটার মজুর-সংকট ও খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবারের অবস্থা গত বছরগুলো থেকে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার সরকারের সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষকেরা আজ মধ্যস্বত্বভোগী মুনাফাখোর ধান-চাল ব্যবসায়ীদের কাছে মণপ্রতি ৪০০ থেকে ৬০০ হারে ধান বেচতে বাধ্য হচ্ছেন, যেখানে এক মণ ধানের উৎপাদন খরচ নিদেনপক্ষে হাজার টাকার ওপরে। উৎপাদিত পণ্যের সঠিক দাম না পাওয়ার কারণে অনেকের স্বপ্ন পূরণের পথ বন্ধুর হয়ে গেছে, অনেকেই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

কৃষি সারা বিশ্বেই যেমন একটি মহৎ পেশা, তেমনি এতে রয়েছে অনেক বাধা-বিপত্তি ও ঝুঁকি। এই বাধা-বিপত্তি ও ঝুঁকি উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই কৃষির জন্য কম-বেশি প্রযোজ্য। কৃষককে যেমন প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়, তেমনি তাঁর উৎপাদিত পণ্যের দামের জন্য নির্ভর করতে হয় উৎপাদনশীলতার ওপর, জোগান ও চাহিদার ভারসাম্যের ওপর। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য তো আছেই। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ আর কৃষকেরা যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে বিষয়টি অনেক দেশেই সরকার প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ করে থাকে। বাংলাদেশে নতুন হলেও, আধুনিক কৃষির প্রণোদনা গত শতাব্দীর শুরুতেই শুরু করেছিল আমেরিকা। আজ কৃষিতে উন্নয়নের শিখরে অবস্থান পাওয়া জাপান বিশ্বে কৃষিতে সবচে বেশি প্রণোদনা প্রদানকারী দেশ হিসেবে বিবেচিত।

কৃষিতে প্রণোদনা বিভিন্ন পদ্ধতিতে দেওয়া হয়ে থাকে যেমন সরাসরি প্রণোদনা, রেগুলেশন করে সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ, আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, শস্যবিমা, সরকার কর্তৃক ন্যায্যমূল্যে শস্য ক্রয় ও সংরক্ষণের মাধ্যমে মূল্য সহায়তা প্রদান করে কৃষককে সরাসরি লোকসান থেকে মুক্তি দেওয়া প্রভৃতি। মূল্য সহায়তার মাধ্যমে কৃষিপণ্যের বাজার স্থিতিশীল, কম উপার্জনের কৃষককে সহায়তা, কৃষিকাজ থেকে অভাবনীয় ক্ষতি কমিয়ে আনা, খাদ্যনিরাপত্তার নিশ্চয়তা, কৃষিপণ্যের রপ্তানিকে সহজ করাসহ গ্রামীণ উন্নয়নকে বেগবান করা সম্ভব। আর এ জন্য অনেক বছর থেকে বহু দেশে কৃষির সঙ্গে জড়িত বা কৃষকের আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য এটিকে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমেরিকা প্রতিবছরই দানাশস্য থেকে শুরু করে গবাদিপশু পালন ও উৎপাদনে ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চয়তার জন্য প্রণোদনা ও মূল্য সহায়তা দিয়ে আসছে।

নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, কোরিয়া, জাপান, আইসল্যান্ডসহ অনেক দেশেই কৃষিপণ্যের উৎপাদন মূল্যের প্রায় ৬০ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে আসছে। জাপান ও কোরিয়া ধানের উৎপাদনে বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রণোদনা দিয়ে আসছে। অনেক অর্থনীতিবিদ মূল্য সহায়তা তথা কৃষিতে প্রণোদনার বিরোধিতা ও ডেডওয়েট লসের (deadweight loss) যুক্তি দেখালেও কৃষকের ক্ষতি পোষাবার অন্য কোনো বিকল্পের জুতসই ব্যবস্থাপনার সন্ধান দিতে পারেননি। আজ আমাদের কৃষকেরা তাঁদের কৃষিপণ্যের দাম নিয়ে যে এক হতাশার মধ্যে পড়েছেন, তা থেকে মুক্তির সঠিক পথ বের করবার গুরুদায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়, এটি সরকারেরই দায়িত্ব। এটি স্পষ্ট যে ধান উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কৃষককে সমূহ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মূল্য সহায়তার অন্য কোনো বিকল্প এখন নেই বললেই চলে। আর কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চয়তার জন্য ভেল্যু চেইনের অব্যবস্থাগুলো দূর করাও জরুরি। মধ্যস্বত্বভোগী ও পণ্যমূল্যের সিন্ডিকেট, অনৈতিকতা রোধ ও সার্ভিসের অব্যবস্থাও জরুরি ভিত্তিতে নিরসন করাও অত্যন্ত জরুরি। কৃষককে কীভাবে মূল্য সহায়তা দিলে কৃষক লাভবান হবেন, তা নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। আর দ্রুত একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নেরও প্রয়োজন রয়েছে।

কৃষি ব্যবস্থাপনা ও বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত অনেকের মতে কৃষককে মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সরকারের উচিত হবে কৃষকের কাছ থেকেই ন্যায্যমূল্যে ধান ক্রয় করা। সরকারি উদ্যোগেই এই ধান সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা। সরকারের কেনা ধান আংশিক সরকারি ব্যবস্থাপনায় রপ্তানি আর আংশিক চাল বানিয়ে ন্যায্যমূল্যে বাজারজাত করার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক অভিজ্ঞ কৃষি বিশেষজ্ঞ। সঙ্গে সঙ্গে ধান-চাল আমদানিতে নিষেধজ্ঞার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যত দিন পর্যন্ত দেশে উদ্বৃত্ত ধান-চাল রয়েছে। অনেকেই প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে ধান সংরক্ষণাগার গড়ে তোলার আবশ্যকতার কথা বলেছেন, যেখানে কৃষক প্রয়োজনমতো ধান মজুত করতে পারবেন আর মজুত করা ধানের ৮০ শতাংশের ন্যায্যমূল্যের সমপরিমাণ অর্থ যেকোনো তফসিলি ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নিতে পারবেন। এতে ব্যাংক যেমন লাভবান হবে, তেমনি কৃষকদের আর্থিক নিরাপত্তা এবং মূল্য নিশ্চিত করা সহজ হবে। সঙ্গে সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য থেকে রেহাই পাবেন কৃষক।

আজ যে ধানের অধিক ফলন হয়েছে, দেশে ধানের উৎপাদন উদ্বৃত্ত হয়েছে, তা আমাদের জন্য বড় সুখবর। আমরা এ নিয়ে গর্ব করতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষির এই সাফল্যেরও একটি সূচনা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দূরদর্শিতার কারণেই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনে প্রাণের স্পন্দন পেয়েছিল। ধানের উদ্বৃত্ত উৎপাদন ও ন্যায্যমূল্যের অব্যবস্থাপনা আজ এক অন্য রকম সংকট, যা মোকাবিলা করার জন্যও চাই দূরদর্শিতা। আমাদের কৃষককে কৃষিতে অনুপ্রাণিত করেই দেশের কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’।

ড. এজাজ মামুন: প্রবাসী, বিজ্ঞানী।