ছাত্রদলের 'তালা' ও ছাত্রলীগের 'কালো তালিকা'

কে বলে আওয়ামী লীগ ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে বিএনপির ঘরানার রাজনীতির মিল নেই! অবশ্যই মিল আছে। বিশেষ করে দুই প্রধান দল যাদের ওপর ভর করে জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করছে, সেই ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।

আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। আর বিএনপির সহযোগী ছাত্রসংগঠন হলো ছাত্রদল। দুই সংগঠনের ঘোষিত নীতি ও আদর্শে যতই ফারাক থাকুক না কেন, তাদের কর্মপদ্ধতি ও কৌশল প্রায় অভিন্ন।

সম্প্রতি বিএনপির নেতৃত্ব মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদলের কমিটি ভেঙে দিয়ে এই ফরমান জারি করে যে ২০০০ সালের পর যাঁরা এসএসসি পাস করেছেন, তঁারাই ছাত্রদলের নেতা হতে পারবেন। অর্থাৎ যঁারা ২০০০ সালের আগে এসএসসি পাস করেছেন, তাঁরা ছাত্রনেতৃত্বে আসতে পারবেন না। কিন্তু ছাত্রদলের আদুভাই নেতারা অভিভাবক সংগঠনের এই শর্ত মানতে রাজি নন। তাঁদের বক্তব্য হলো তাঁরা যত দিন খুশি ছাত্রনেতৃত্বে থাকতে আগ্রহী, তত দিন দিতে হবে।

নির্ধারিত বয়সসীমা বাতিল করার দাবিতে ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ নেতারা ১১ জুন রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এর আগে ৩ জুন রাতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছিল। এতে আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের কথা বলা হয়। নতুন কমিটিতে নেতা হওয়ার যোগ্যতা হিসেবে ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী যেকোনো বছরে এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে বলে জানানো হয়।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের অক্টোবরে রাজীব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই বছরের জন্য ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি করা হয়। ২০১৬ সালের অক্টোবরে এই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। এরপরও প্রায় আড়াই বছর কমিটি বহাল ছিল। বিলুপ্ত কমিটির এক নম্বর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এজমল হোসেন ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে বিক্ষোভ হয়। তাঁরা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে কার্যালয় থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানান। জিয়ার আদর্শের সৈনিকই বটে! গত মার্চ মাসে ছাত্রদলের নতুন
কমিটি গঠনের লক্ষ্যে সংগঠনের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন—এমন ১২ জন নেতার সমন্বয়ে সার্চ কমিটি করা হয়। তাঁরা হলেন শামসুজ্জামান, রুহুল কবির রিজভী, আসাদুজ্জামান, আমান উল্লাহ, খায়রুল কবির, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, এ বি এম মোশাররফ হোসেন, আজিজুল বারী, আমিরুল ইসলাম খান, শফিউল বারী, আবদুল কাদির ভূঁইয়া, হাবিবুর রশীদ। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল বা এর সহযোগী সংগঠনের কমিটির জন্য সার্চ কমিটি গঠন এই প্রথম।

বিরোধী দলে থাকা বিএনপির এই সহযোগী ছাত্রসংগঠনটির নেতা-কর্মীরা সরকারের কোনো অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কর্মসূচি নিতে না পারলেও বুড়ো নেতাদের পদে রাখার দাবিতে দলীয় কার্যালয়ে তালা দিয়ে নিজেদের শক্তির প্রমাণ দিতে কসুর করেন না। সেদিন দলীয়
কার্যালয়ের সামনে ছাত্রদলের কয়েক শ নেতা-কর্মীকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। কিন্তু জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আয়োজিত বিএনপির মানববন্ধনে ৫০ জনের বেশি লোক পাওয়া যায় না। বিএনপির নেতারা বলেছেন, সরকার জাতীয়তাবাদী শক্তির কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা দলীয় অফিসে তালা ঝুলিয়ে জাতীয়বাদী শক্তিকে কতটা সুরক্ষিত করছেন?

২.

এদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এর সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায়-টিভিতে খবর হচ্ছে। ভালো কাজের জন্য নয়, মন্দ কাজের জন্য। ঈদের আগে ডাকসুর সহসভাপতি নুরুল হকের ইফতার পার্টি ঠেকানোর শপথ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছিলেন এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের ক্ষোভ ডাকসুর সহসভাপতির পদটি তাঁর কারণেই ছাত্রলীগের হাতছাড়া হয়ে গেছে। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতারা একবারও ভেবে দেখেন না যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪ হাজার শিক্ষার্থী যদি নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারতেন, তাহলে ফল অন্য রকম হতো। অরাজনৈতিক সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদই ক্যাম্পাসে প্রধান রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হতো।

ছাত্রলীগ নিজেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত দেশের বৃহত্তম ছাত্রসংগঠন দাবি করে। কিন্তু সম্মেলনের ১৩ মাস পরও তারা কমিটি গঠন নিয়ে সৃষ্ট ‘ছোট্ট বিরোধটি’ মেটাতে পারেনি। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বড় বড় নেতা দফায় দফায় বৈঠক করে ৩০১ সদস্যের যে কমিটি ঘোষণা করলেন, শুরুতেই তা কঠিন চ্যালেঞ্জর মুখে পড়ে। পদবঞ্চিতদের দাবি, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি, মাদকসেবী, বিএনপি-জামায়াত ও রাজাকার পরিবারের সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিতে যুক্ত, বিবাহিত, সংগঠনে নিষ্ক্রিয় এবং অছাত্ররাও স্থান পেয়েছেন। তাঁরা নতুন কমিটির ৯৯ জনকে বিতর্কিত ও কালো তালিকাভুক্ত করে বাদ দিতে বলেছিলেন।

ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত নতুন কমিটি থেকে ১৯ জনকে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দিলেও পদবঞ্চিতরা মানেননি। অন্যদিকে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর মারামারির ঘটনায় একজনকে স্থায়ীভাবে এবং চারজনকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে সাময়িক বরখাস্ত একজন নারী কর্মী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বলেও পত্রিকায় খবর এসেছে। দুই বছরের জন্য ছাত্রলীগের কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও ইতিমধ্যে ১৩ মাস পার হয়ে গেছে। বাকি আছে ১১ মাস।

অতীতে প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা আমাদের পথ দেখিয়েছে। কিন্তু এখন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরাই পথহারা। তাঁরা কীভাবে অন্যদের পথ দেখাবেন? ক্ষমতায় থাকুন আর ক্ষমতার বাইরে থাকুন, পদপদবিই একমাত্র মোক্ষ তঁাদের। ‘এই ছাত্ররাজনীতি লইয়া আমরা কী করিব?’

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি