কাছের মানুষ সরদার ফজলুল করিম

সরদার ফজলুল করিম
সরদার ফজলুল করিম

কৃষকের সন্তানের কোনো শৈশব নেই—সরদার ফজলুল করিমের উক্তিটি আমার একান্ত আপন মনে হয়। তিনি জন্মেছিলেন এক কৃষকের ঘরে; যে কৃষক লাঙল নিয়ে খেতে যান আর পেছনে হাল ধরে তাঁর ছেলে।
১৯২৫ সালের ১ মে বরিশালের আটপাড়া গ্রামে কৃষকের ঘরে সরদার ফজলুল করিমের জন্ম। কিন্তু তিনি নিজের অধ্যবসায় ও প্রতিভাবলে হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না, নিজেকে আজীবন নিয়োজিত করেছিলেন জ্ঞানসাধনায়।

কৃষকের সন্তান সরদার ফজলুল করিম নিজেকে তৈরি করেছিলেন সাম্যবাদী চিন্তায়। তিনি বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের মানুষকে অন্তর দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন। প্রাচীন গ্রিক দর্শন ও মার্ক্সীয় দর্শনে বাংলা ভাষাভাষী পাঠককে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি অনুবাদ করেন প্লেটো, অ্যারিস্টটল, অ্যাঙ্গেলস, রুশোর রচনা। বাঙালির মনে সঞ্চারিত করেন সাম্যবাদী চিন্তাকে। দর্শনের মতো কঠিন বিষয়কে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন।

সরদার ফজলুল করিম ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চিত জীবন বেছে নিয়েছিলেন। বিদেশে উচ্চ শিক্ষার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কমিউনিস্ট রাজনীতির কারণে তিনি দীর্ঘ সময় কাপাসিয়া, মনোহরদী, চরসিন্ধুর প্রভৃতি গ্রামে আত্মগোপনে ছিলেন। কৃষকের লুঙ্গি গামছা পরে তাঁদের সঙ্গেই থাকতেন। বৈষয়িক কোনো বৈভব তাঁকে কখনো আকর্ষণ করতে পারেনি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল আমৃত্যু। রিকশাচালক, মাছবিক্রেতাসহ সব শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি নিজেকে কখনো নেতা মনে করতেন না। ছাত্রদের সঙ্গে সব বিষয়ে নিঃসংকোচে আলাপ করতেন। বলতেন, তাদের কাছ থেকেই তিনি শিখছেন।

সরদার ফজলুল করিম একসময় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদেরও সদস্য ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকবর্গ জাতীয় পরিষদের সদস্য থাকা অবস্থায়ই তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে দীর্ঘদিন কারাগারে কাটাতে হয়। তিনি তাঁর পরিবার, স্ত্রী, পুত্র-কন্যার প্রতি ছিলেন অসম্ভব দরদি একজন মানুষ।

চির নবীন, চির সবুজ সরদার ফজলুল করিম তরুণদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে অবসর নিলেও তাঁর কোনো খেদ ছিল না। তাঁর জীবনে আসলে কোনো অবসর ছিল না। পরেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। আজীবন মানুষের কল্যাণ সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

সরদার ফজলুল করিমের বৈষয়িক কোনো চাওয়া–পাওয়া ছিল না। তবু তিনি সুখী মানুষ ছিলেন। তাঁর মূল্যায়ন করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তাঁর অসাম্প্রদায়িক ও কুসংস্কারমুক্ত চিন্তা ভোরের আলোর মতো আমাদের আলোকিত করে। আমি ধন্য যে কিছুদিনের জন্যও তাঁর সংস্পর্শে ছিলাম। তাঁর লেখা ও চিন্তা আমাদের প্রেরণা জোগায়, শক্তি জাগায়। তাঁর লেখার মধ্যে আমরা বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাই। মনে আছে, বাংলা একাডেমির একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করছিলেন। তাঁর সেই কণ্ঠস্বর আজও আমার কানে বাজে। তাঁর সেই কণ্ঠস্বর যেন এক তরুণের কণ্ঠস্বর ছিল। তাঁর মন ছিল তারুণ্যের জোয়ারে ভরপুর। যে তরুণ কারও ওপর নির্ভরশীল নয়, যে তরুণ দৃঢ়তার সঙ্গে জরাকে জয় করেছে, যে তরুণ কিছুতেই পিছিয়ে পড়বে না, যে তরুণ আবহমান কাল ধরে পথের কাঁটা দূর করে গেছেন, তিনি যেন ছিলেন সেই তারুণ্যের প্রতিনিধি। সরদার ফজলুল করিম আমাকে নানাভাবে সাহায্য–সহযোগিতা করেছেন। নিরাশার মধ্যে আশার বাণী শুনিয়েছেন।

আমি গর্বিত যে বদরুন্নেছা সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রধান অতিথি হিসেবে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। তাঁর জন্য গাড়ি প্রস্তুত ছিল না, তিনি গাড়িতে আসেনওনি। রিকশায় করে বলা যায় চুপিচুপি এসে সেই অনুষ্ঠানকে আলোকিত করেছিলেন। ছাত্রীরা তাঁর বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। তাঁকে অনেকে অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেন। মনীষী, পণ্ডিত, জ্ঞানতাপস। না, আমি কোনো বিশেষণে তাঁকে বিশেষায়িত করব না। শুধু বলব, তিনি ছিলেন আমার কাছের মানুষ। মৃত্যু দিবসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সুলতানা জাফর: কলেজশিক্ষক