উৎসাহিত হবেন ঋণখেলাপিরা

প্রকৃতপক্ষে এতে খেলাপি ঋণ বাড়বে, যা প্রকাশিত হবে না। এটি ব্যাংকের জন্য একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি ডেকে আনবে। আরেকটি সার্কুলারে আরও বিপজ্জনক পন্থা বর্ণিত হয়েছিল। সেটি বাস্তবায়নে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় এটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা না করাই সংগত। শুধু এটুকুই বলা যায়, এই সার্কুলারেও খেলাপিদের অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।

বাজেট বক্তৃতায় মন্ত্রী ব্যাংকে এক্সিট পলিসি নেই বলে দাবি করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের নিরিখে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের বিষয়গুলো নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে সুদের অঙ্কে অনেক ছাড় দেওয়া হয়। তাতেও যদি ঋণগ্রহীতা শোধ দিতে না পারেন, তাহলে তিনি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারেন। এ–সংক্রান্ত দেউলিয়া আইন বর্তমানে রয়েছে। সে আইনে আধুনিকায়ন আনা যেতে পারে।

এবারের বাজেট বেশ বড় অঙ্কের। তবে আমাদের জাতীয় আয়ের তুলনায় এটিকে বড় বলা যাবে না। মূল সংকট হলো ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত মাত্র ১০ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই অনুপাত ২০ শতাংশের ওপরে এবং ভুটানে ৩০ শতাংশ। বাজেটে করের আওতা বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এতে নতুন করদাতাদের করজালে নিয়ে আসা হবে। কিন্তু নতুন করদাতারা দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মতো কর জমা দেন। এতে কর জিডিপি অনুপাত আশানুরূপ বাড়বে না।

বাংলাদেশের অর্থসম্পদ শতকরা ৫ ভাগ মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত। তাঁরাই ঠিকমতো কর দেন না। ওই গোষ্ঠীকে আঘাত করতে না পারলে অনুমিত আয় আদায় করা সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে মন্ত্রী কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু ওই শক্তিশালী অংশের প্রভাববলয় থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার একটি বড় দিক হলো আয়বৈষম্য। একদিকে যেমন উচ্চ ধনী ব্যক্তি, অন্যদিকে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রের সংখ্যা অনেক বেশি। শতকরা ৫ ভাগ উচ্চবিত্তের তুলনায় ৯৫ ভাগই স্বল্প আয়ভোগী। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কোনো ব্যবস্থা বর্তমান বাজেটে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। উচ্চবিত্তবানদের কাছ থেকে উপযুক্ত কর আদায় করে বাজেটের মাধ্যমে সেই অর্থ ব্যয় করতে পারলে এই ব্যবস্থার একটা সুরাহা হতে পারে। তা ছাড়া সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি আরেকটি উপায়। এবার অবশ্য এই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এরপর মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তেমনটি নেই। এতে মানবসম্পদ উন্নয়ন ব্যাহত হবে। ক্ষুদ্র ও মধ্যম সারির উদ্যোক্তাদের জন্য এবার বাজেটে প্রথমবারের মতো এক শ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এটি অভিনন্দনযোগ্য। তবে বরাদ্দ রাখার পর এটির সাফল্যজনক ব্যবহারের জন্য নজর দেওয়ার প্রয়োজন হবে। সরকারের এই বাজেট অঙ্কের সঙ্গে দেশের ব্যাংকগুলো যদি পরিপূরক টাকা বরাদ্দ দেয়, তাহলে উদ্যোক্তা তহবিলটি বেশ বড় হতে পারে।

কৃষি খাতে দরিদ্র কৃষকদের অবস্থা বেশ খারাপ। তাঁরা ধান উৎপাদন করেও উৎপাদন খরচ তুলতে পারেন না। এ বিষয়টিতে বাজেটে তেমন কোনো সুপারিশও নেই। আমরা মনে করি ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য নগদ অনুদানের প্রয়োজন রয়েছে, যেমনটা ১৯৯৭-৯৮ সালে দেওয়া হয়েছিল। তখন কৃষকদের দুই ভাগে ভাগ করে কৃষকপ্রতি আট শ টাকা এবং এক হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র কৃষকদের জনপ্রতি অন্তত তিন হাজার টাকা নগদ অনুদান দেওয়া প্রয়োজন।

এবারও কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থা হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অনৈতিক। তারপরও যদি বেশি পরিমাণ কালোটাকা সাদা হয়, তাহলে বিষয়টিকে নমনীয়ভাবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এর আগের বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, কালোটাকার মালিকেরা কালোটাকা সাদা করতে উৎসাহী নন। কালোটাকা বেশি পরিমাণে সাদা হবে, এমনটা আশা করা যায় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে ছাড় দিয়ে নয়, বরং কালোটাকার মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করাটাই সংগত।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর