শিক্ষা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে না: রাশেদা কে চৌধূরী

রাশেদা কে চৌধূরী
রাশেদা কে চৌধূরী
রাশেদা কে চৌধূরী। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। শিক্ষার সার্বিক অবস্থা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান


প্রথম আলো: শিক্ষার এই দুরবস্থা কেন?

রাশেদা কে চৌধূরী: শিক্ষা দুরবস্থায় আছে, সে কথা আমি বলব না। বাংলাদেশে শিক্ষায় সবচেয়ে বড় অর্জন হলো এর প্রতি সর্বস্তরের মানুষের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। একজন বিত্তহীন থেকে উচ্চবিত্তের মানুষ—সবাই বলবেন, আমি আমার সন্তানকে অবশ্যই লেখাপড়া করাতে চাই। আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও কোনো কোনো রাজ্যে কৃষকেরা বলেন, সন্তানকে লেখাপড়া করিয়ে কী লাভ? বাংলাদেশে এ কথাটি এখন কেউ বলে না। আরেকটি অর্জন হলো নারীশিক্ষার ব্যাপক বিস্তার। নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিটি সরকারই মেয়েদের শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছে, যার ফল এখন আমরা ঘরে তুলছি।

প্রথম আলো: আপনি বলছেন, শিক্ষার প্রতি সর্বস্তরের মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু যে শিক্ষা রাষ্ট্র দিচ্ছে, সেই শিক্ষা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে কি?

রাশেদা কে চৌধূরী: এটাই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে, অন্যদিকে শিক্ষিত তরুণেরা চাকরি পাচ্ছেন না। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। কিন্তু আমরা তাঁদের সবাইকে কাজ দিতে পারি না। এখানেই হতাশা। আবার সরকারি যে শিক্ষাব্যবস্থা, তার প্রতি ভরসা রাখতে পারছেন না বলে অনেকে অন্য ধরনের শিক্ষার প্রতি ঝুঁকছেন। কোচিং–বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। শিক্ষা ক্রমাগত পণ্যে পরিণত হচ্ছে। রাষ্ট্র লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বড় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেই।

প্রথম আলো: ২০১০ সালে সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে যে শিক্ষানীতি চালু করেছিল, তা বাস্তবায়িত হলো না কেন?

রাশেদা কে চৌধূরী: স্বাধীনতার পর অরেক দিন আমরা পূর্ণাঙ্গ কোনো শিক্ষানীতি পাইনি। ১৯৭৪ সালে কুদরাত–এ–খুদা শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তীকালের সব শিক্ষানীতি ছিল খণ্ডিত। কিন্তু ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের কথা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা ছিল। এই শিক্ষানীতিতে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন ও একটি সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রণয়নের কথাও বলা ছিল। কিন্তু এর কোনোটাই কার্যকর হয়নি। শিক্ষা আইন খসড়া পর্যায়েই রয়ে গেছে। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা সম্ভব। কিন্তু সেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হয়নি।

প্রথম আলো: কেন বাস্তবায়িত হলো না?

রাশেদা কে চৌধূরী: আমার ধারণা, শিক্ষাকে এখনো খণ্ডিত আকারে দেখা হয়। নীতিনির্ধারণের জায়গা থেকে শিক্ষানীতিকে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতি হিসেবে দেখা হয় না। ফলে যা হয়েছে খণ্ডিত, বিক্ষিপ্ত। প্রাথমিক স্তরে সরকারের একধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সবকিছু চলছে খণ্ডিতভাবে। প্রকল্পের ভিত্তিতে।

প্রথম আলো: ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার প্রস্তাব ছিল। গত আট বছরেও তা কেন হলো না?

রাশেদা কে চৌধূরী: বড় একটা ফাঁক তো থেকেই গেল। আমাদের শিক্ষাটা এখন জ্ঞানকেন্দ্রিক না হয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার আগে চারটি পাবলিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। পঞ্চম শ্রেণি, অষ্টম শ্রেণি, এসএসসি ও এইচএসসি। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত পাবলিক পরীক্ষা নেই। বরং শ্রেণিকক্ষভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়।

প্রথম আলো: কিন্তু আমাদের এখানে সেই পরীক্ষাটিও তো ঠিকমতো হয় না। খাতায় কিছু না লিখলেও তো পাস করিয়ে দেওয়া হয়।

রাশেদা কে চৌধূরী: পাবলিক পরীক্ষার মূল যে লক্ষ্য দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই, সেটি আমাদের পরীক্ষায় হয় না। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে। এই যে পরীক্ষায় ব্যাপক হারে পাস করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারপরও গবেষণায় দেখা যায় ইংরেজিতে মাত্র ২৫ শতাংশ ও গণিতে ৩৫ শতাংশ দক্ষতা অর্জন করে। তাহলে পাবলিক পরীক্ষার প্রয়োজন কী। ইদানীং নীতিনির্ধারকেরাও প্রাথমিক স্তরের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে পরীক্ষা তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। আমি মনে করি, সেটি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত করা প্রয়োজন। তাহলে পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা থেকে আমরা মুক্তি পাব। কোচিং–বাণিজ্যের দৌরাত্ম্যও কমবে। জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, চতুর্থ শ্রেণি থেকেই কোচিং–বাণিজ্যের দৌরাত্ম্য শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা গাইড বইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

প্রথম আলো: গত ১০ বছরে শিক্ষার মানের আরও অবনতি হলো কেন?

রাশেদা কে চৌধূরী: গত ১০ বছরেই যে শিক্ষার মানের অবনতি হয়েছে, তা বলব না। তবে শিক্ষার মান যে প্রশ্নের মুখে, সেটি স্বীকার করতে হবে। আমাদের শিক্ষা পরীক্ষাকেন্দ্রিক বলেই ৫৬ ঘণ্টা পরীক্ষা দেওয়ার পরও একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বা প্রকৌশলে ঢোকার জন্য আবার পরীক্ষা দিতে হয়। এর অর্থ ওই পাবলিক পরীক্ষার প্রতি সংশ্লিষ্টদের আস্থা নেই।

প্রথম আলো: শিক্ষার মান নিয়ে যখন কথা উঠেছে, তখন শিক্ষা যাঁরা দেবেন, অর্থাৎ শিক্ষকদের মানের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সরকার শিক্ষকদের মান উন্নয়নে কী করছে?

রাশেদা কে চৌধূরী: শিক্ষকদের মান উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দাতা সংস্থাগুলোও নিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি শুধু মানের নয়। শিক্ষকেরা হলেন শিক্ষাব্যবস্থার চালিকাশক্তি। প্রশ্ন হলো, যুগের চাহিদা মেটাতে পারে, এমন শিক্ষা তাঁরা নিতে পেরেছেন কি না। আবার নিলেও সেটি পাঠকক্ষে প্রয়োগ করতে পারছেন কি না। আমাদের মনিটরিং ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। বেশির ভাগ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। সরকার বিনা মূল্যে বই দেয়, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয়। কিন্তু সেখানে নিয়োগ–বাণিজ্য চলে। ফলে মানসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়া যায় না।

প্রথম আলো: বাজেট ঘোষণা হয়েছে। শিক্ষা খাতের বরাদ্দে কি আপনি খুশি?

রাশেদা কে চৌধূরী: কয়েক বছর ধরে আমরা লক্ষ করছি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জিডিপির দুই থেকে আড়াই শতাংশ। শিক্ষার বাজেটকে টাকার অঙ্কে দেখলে হবে না। একজন শিক্ষার্থীর পেছনে কত টাকা ব্যয় হয়, সেটা দেখতে হবে। আবার এই বরাদ্দেও তারতম্য আছে। ক্যাডেট কলেজের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যয়ের অনেক ফারাক। মনে হচ্ছে রাষ্ট্র শিক্ষার দায়িত্ব থেকে ক্রমাগত পিছু হটছে। এটি আমাদের সংবিধানের মূল নীতির পরিপন্থী।

প্রথম আলো: শিক্ষানীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঋদ্ধ ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার কথা বলা হয়েছিল। অথচ এই সরকারের আমলেই তো মহলবিশেষের দাবির মুখে পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আনা হলো। অনেক প্রগতিশীল লেখক-কবির রচনা বাদ দেওয়া হলো। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

রাশেদা কে চৌধূরী: আমি বলব, এটি ভোটের রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেই প্রতিক্রিয়াশীল মহল ধর্মের ধুয়া তুলে তার বিরুদ্ধে হইচই শুরু করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধিতা নেই। সরকার সম্প্রতি কারিকুলাম সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, আমরা আশা করি, সেখানে মুক্তবুদ্ধির ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে কিছু থাকবে না। মুক্তবুদ্ধির মানুষদের এই দাবি আরও জোরালোভাবে তুলতে হবে। সাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে, এমন কিছু পাঠ্যবইয়ে থাকতে পারে না।

প্রথম আলো: শিক্ষা সমাজকে এগিয়ে নেবে, না সমাজ শিক্ষাকে এগিয়ে নেবে?

রাশেদা কে চৌধূরী: আমি কবিগুরুর ভাষায় বলতে চাই, মূর্খদের কারণে সমাজ নষ্ট হয় না। সমাজ নষ্ট হয় শিক্ষিতদের মূর্খ আচরণে। শিক্ষার নামে এখানে অনেক তথাকথিত শিক্ষিতজন যা করছেন, তা মেনে নেওয়া যায় না। তাঁরা সমাজকে পেছনে টানতে চাইছেন।

প্রথম আলো: আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে, কিন্তু চাহিদা মেটাতে পারছে কি?

রাশেদা কে চৌধূরী: আমরা যে জনশক্তি তৈরি করছি, সেটি বর্তমান যুগের চাহিদা মেটাতে পারছে কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পসহ অনেক খাতেই ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত জনশক্তির বড় অংশ আনতে হচ্ছে বিদেশ থেকে। আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারছি না। আবার আমাদের জনশক্তির একটি অংশ বিদেশে যাচ্ছেন। তাঁরা অদক্ষ বলে মজুরিও কম। আমাদের যে জনশক্তি, তাঁদের সবার জন্য কর্মসংস্থান করতে পারছি না। এ নিয়ে সরকারের নিবিড় কোনো গবেষণাও আছে বলে মনে হয় না। আমরা কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ করে লাভবান হয়েছি। কৃষিতে বিপ্লব হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা ও শ্রমবাজার নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হচ্ছে না। একটি বিষয়ে আমরা অবাক হই যে বর্তমান সরকারে যাঁরা মন্ত্রী আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ব্যবসায়ী। তাঁদের তো ভালো জানার কথা আমাদের কী ধরনের জনশক্তি প্রয়োজন। সক্ষম জনশক্তি গড়ে তুলতে না পারলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। বৈষম্যও কমবে না।

প্রথম আলো: আমাদের শিক্ষা কি বৈষম্য বাড়াচ্ছে না?

রাশেদা কে চৌধূরী: অবশ্যই বাড়াচ্ছে। যারা ভালো সুযোগ পাচ্ছে, তারা ভালো আয়–রোজগারও করতে পারছে। কিন্তু যারা সেই সুযোগ পাচ্ছে না, তারা পিছিয়েই থাকছে।

প্রথম আলো: শিক্ষা খাতে দুর্নীতি বেড়েছে।

রাশেদা কে চৌধূরী: মোটা দাগে শিক্ষা খাতে দুর্নীতির কথা সবাই জানেন। ভর্তি–বাণিজ্য, নিয়োগ–বাণিজ্য আছে। কোচিং–বাণিজ্য আছে। শিক্ষার মান নিয়ে আমরা যখন কথা বলছি, তখনই পত্রিকায় দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ জন শিক্ষার্থী প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। এটি শুধু দুর্নীতি নয়, ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা কিংবা জিপিএ–৫ সংস্কৃতি মূল্যবোধকে দৃঢ় করে না—এই সত্যটি আমাদের সবাইকে স্বীকার করতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

রাশেদা কে চৌধূরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।