সরকারের বোঝা বাড়ছেই

একটি ইংরেজি দৈনিকের খবর, সরকারের গাড়িঋণ সুবিধার উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। যেসব সরকারি কর্মকর্তা বিনা সুদে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন, তাঁদের কেউ কেউ ব্যবস্থাটির অপব্যবহার করছেন। ঋণসুবিধা দেওয়ার সময় আশা করা হয়েছিল, সরকারের ওপর থেকে প্রতিবছর নতুন গাড়ি কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণের চাপ ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। কিন্তু তা হচ্ছে না, বরং উল্টোটাই ঘটছে।

ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তাদের যথাক্রমে ১৬৫, ২১৯ ও ২৩৪টি গাড়ি কেনার জন্য ঋণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার ফলে সরকারি পরিবহন পুলের ব্যয় কমেনি, বরং ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। ওই তিন বছরের সরকারি পরিবহন পুলের বাজেট ছিল যথাক্রমে ১২৬, ১৪৬ ও ১৬২ কোটি টাকা। এ হিসাবের মধ্যে নতুন গাড়ি কেনার টাকা অন্তর্ভুক্ত নয় বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ শুধু ২০১৭-১৮ অর্থবছরেই সরকার গাড়ির জন্য ঋণ দিয়েছে ৩৭০ কোটি টাকা। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় বেড়েই চলছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এ খাতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮০ কোটি টাকার বাজেট ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের বাজেট ৭১ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৯ কোটি টাকা।

ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা দাপ্তরিক কাজে অনেক আগে থেকেই গাড়ির সুবিধা ভোগ করছিলেন। সামান্য মাশুল দিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের বিধানও ছিল। কিন্তু সরকারি গাড়ির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দরদ ও যত্নের অভাবে সেগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়; অল্প সময়ের ব্যবধানে সরকারকে অনেক নতুন গাড়ি কিনতে হয়, ফলে সরকারের ব্যয় বাড়তে থাকে। এর বদলে সরকারি কর্মকর্তাদের একটি গাড়ি কেনার জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিলে এই খাতে ব্যয়বৃদ্ধি এড়ানো যাবে—এই বিবেচনা থেকে বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়; সেই সঙ্গে চালকের বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হিসেবে মাসে ৫০ হাজার টাকা। এই ঋণ বছরে শতকরা ১০ শতাংশ অবচয় হিসেবে কমে যায়। সেই হিসাবে কিস্তি হ্রাস পায়।

সুযোগটি ন্যায্য বলেই বিবেচনা করা যায়। পাশাপাশি ধরে নেওয়া যায়, গাড়ি সুবিধা হিসেবে এটা সন্তোষজনক ও পর্যাপ্ত। নিয়ম অনুসারে এই সুবিধা ভোগকারীরা সরকারের অন্য কোনো গাড়ি সুবিধা ভোগ করতে পারেন না। শুধু সচিবরা ঋণের টাকায় কেনা গাড়ি ছাড়াও সরকারি কাজের জন্য একটি জিপ ব্যবহার করে থাকেন। অবশ্য অন্যরা দূরদূরান্তে যেতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনসাপেক্ষে সাময়িকভাবে অতিরিক্ত গাড়ি সুবিধা পেতে পারেন। তবে ঢাকায় অবস্থানকালে অফিস-বাসায় যাতায়াতের জন্য অন্য গাড়ি ব্যবহার তাঁদের কেউ কেউ কীভাবে করতে পারেন, তা বোধগম্য নয়। এসব বিষয় দেখার জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর বলে মনে হচ্ছে না।

আগে সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধার আওতায় ছিলেন যুগ্ম সচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা। এখন উপসচিবদেরও এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। প্রকাশিত সংবাদটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কর্মকর্তাদের একটি অংশ এসব গাড়ি প্রথম বছর ফার্স্ট পার্টি বিমা করলেও পরবর্তী সময়ে থার্ড পার্টি বিমা করে চলছে। কথাটি বলেছেন একটি বিমা কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। অথচ নীতিমালায় পূর্ণাঙ্গ বিমার আওতায় রাখার বিধান রয়েছে। তা ছাড়া, কর্মকর্তাদের কেউ কেউ উবারসহ অন্য রাইড শেয়ারিংয়ে গাড়ি ব্যবহার করছেন, এমন কথারও উল্লেখ রয়েছে। খবরটির কোনো প্রতিবাদ আসেনি। অথচ বিষয়টি পীড়াদায়ক ও অস্বস্তিকর। সরকারি কর্মকর্তারা ভালো সুবিধাদি পান, এটা অনেকেই চায়। এরূপ সুবিধাদি দেওয়া হলে অধিকতর মেধাবীদের চাকরিতে আসার প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে, এটাও অনস্বীকার্য।

তবে কোনো সুবিধাই শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে দেওয়া যায় না। এ সুদমুক্ত ঋণ এবং মাসে ৫০ হাজার ভাতা সুবিধাটি ভোগ করার পাশাপাশি কেউ অফিস-বাসায় আসা-যাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের মাইক্রোবাস কিংবা অধীনস্থ দপ্তর সংস্থার গাড়িনির্ভর হবেন, এমনটা আশা করা যায় না। উবারসহ রাইড শেয়ারে এসব গাড়ি ব্যবহারও অগ্রহণযোগ্য। কিছু ভাগ্যবান ব্যক্তিকে সরকারের সুবিধা ব্যবহারের পাশাপাশি অন্যায্য সুবিধা ভোগ করার সুবিধা দেওয়া যায় না। বিষয়টি শুধু নৈতিকতার নয়, সুস্পষ্ট আর্থিক শৃঙ্খলারও। কেউ কেউ এ শৃঙ্খলা ভাঙতে সক্রিয়।

দৈনিকটির প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, সরকারে এখন সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে ‘পদায়িত’ আছেন যথাক্রমে ৫৯, ৫১০, ৭২৭ ও ১ হাজার ৮৩৪ জন কর্মকর্তা। কত পদের বিপরীতে এ পদায়ন, এটা উল্লেখ নেই। পদ ছাড়া পদোন্নতি চলছে বছরের পর বছর। অতিরিক্ত সচিব পদে তিন গুণ এবং উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে দ্বিগুণের বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদের উপযুক্ত কাজ নেই। নেই তেমন বসার ব্যবস্থা। কিন্তু গাড়ি সুবিধা দিতে এ নীতিমালা উদারভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে চাপ পড়ছে এদিকে। ফলে মন্ত্রণালয়/বিভাগে বা পরিবহন পুলে খরচ না কমে বেড়ে যাওয়ারই কথা। পদ ছাড়াই আরও নতুন নতুন পদোন্নতির খবর আসছে। চাপ বেড়ে চলবে। সরকারের তেমন কোনো কাজে আসছে না এত সংখ্যক পদোন্নতি। অধিশাখা চালানোর কথা উপসচিবের। আর অনুবিভাগ যুগ্ম বা অতিরিক্ত সচিবের। অথচ এখন ভূরি ভূরি অধিশাখার দায়িত্বে থাকছেন অতিরিক্ত সচিবেরা।

ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক গাড়ির প্রাধিকার প্রাপ্তি শুধু সুবিধা নয়, মর্যাদারও বিষয়। আশা করা সংগত, তাঁরা সুবিধাটি সুসংহত ব্যবহারের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। অনেকে নিশ্চয়ই তা করছেন। তবে গুটি কয়েকের মন্দ কাজ বিষয়টিকে করতে পারে প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি একপর্যায়ে সরকার বিপরীতধর্মী কোনো সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এমনটা যাতে না হয়, সে জন্য তো সরকারি বিধিবিধান রয়েছে। এসব বিধান কার্যকর করার ব্যবস্থাও আছে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই করতে হবে।

ন্যায়সংগতভাবে যেটুকু সুবিধা একজন কর্মকর্তার প্রাপ্য, তা তিনি নেবেন। এমনকি যৌক্তিক হলে সুবিধাটি প্রসারিত করার জন্যও দাবি জানানো যায়। তবে সেসব সুবিধার সঙ্গে যে দায়বদ্ধতা যুক্ত থাকে, তা প্রতিপালন না করা অন্যায্য ও অসংগত। গাড়ি নগদায়ন সুবিধা চালু করা হয়েছিল সরকারের দায় ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার জন্য। সরকারি পরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনার জন্য। কিছু কর্মকর্তার অন্যায্য আচরণের জন্য এটা ভেস্তে যাবে, এমনটা হতে দেওয়া যায় না।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব