কার বাজেট, কার সময়?

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সারা দেশে এখন সরগরম আলোচনা। সরকারি দলের নেতারা সংসদে ও সংসদের বাইরে প্রস্তাবিত বাজেটের পক্ষে বিরামহীন কথা বলছেন। অন্যদিকে, বিরোধী দল অনুচ্চকণ্ঠে হলেও বাজেটের কড়া সমালোচনা করছেন। প্রধানমন্ত্রী বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে যাঁরা বাজেটের ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরেছেন, তাঁদের মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন সাধারণত করে থাকেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এবারে তিনি অসুস্থ থাকায় প্রধানমন্ত্রীই সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বাজেট নিয়ে আলোচনা করছেন। কথা বলছেন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষও। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন গোলটেবিল আলোচনার মাধ্যমেও তাদের বক্তব্য তুলে ধরছে। সবাই নিজের লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছেন।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সংসদে এখনো আলোচনা হয়নি। সম্পূরক বা চলতি বছরের সংশোধিত বাজেট নিয়ে রোববার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের অনুপস্থিতিতে আলোচনা হয়েছে। সংসদে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতারা বাজেটের পক্ষে গুনগান গাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক। গত বছর যখন বাজেট পেশ হয়, তখন যাঁরা ট্রেজারি বেঞ্চে ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন না ঘরকা না ঘাটকা। তাঁরা সরকারি বা বিরোধী দল, বোঝা যাচ্ছে না। বিরোধী দলে গেলে এরশাদের নেতৃত্ব মানতে হয়। কেননা, এই সংসদে সাবেক স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই বিরোধী দলের নেতা। আবার সরকারি দল আওয়ামী লীগও তাদের নিতে চাইছে না।

১৪ দলের শরিফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন নুরুল আম্বিয়ার বাংলাদেশ জাসদ বাজেটে বড় ঋণখেলাপিদের ও কালোটাকার মালিকদের একচোখা সুবিধা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে সমালোচনা করেছে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও মহাজোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান বলেছেন, কালোটাকার মালিক, ঋণখেলাপিরা প্রণোদনা পান অথচ কৃষকেরা পান না। দলের সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশার মতে, ৯৫ শতাংশ মানুষের শ্রমের ফসল ৫ শতাংশ মানুষ লুট করে নিচ্ছে। গণসংহতির দাবি, নতুন লুটেরাদের স্থান করে দিতে বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

বাজেট নিয়ে সমালোচনা করেছেন সংস্কৃতিসেবীরাও। তাঁরা বলছেন, বাজেটে সংস্কৃতি খাতে অত্যন্ত কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ বাড়ানোর দাবিতে তাঁরা রাজপথে নামারও ঘোষণা দিয়েছেন। এঁরা কেউ সরকারবিরোধী নন। শিক্ষাবিদেরা বলেছেন, শিক্ষা খাতেও সরকার বরাদ্দ তেমন বাড়ায়নি। আর কৃষকদের সহায়তা বাড়ানোর কোনো প্রস্তাবও বাজেটে নেই। তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের ১ শতাংশ প্রণোদনা দিলেও শ্রমিকদের কোনো প্রণোদনা নেই। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১০০ কোটি টাকা। লাখ লাখ শিক্ষিত বেকারের দেশে ১০০ কোটি টাকার তহবিল খুবই নগণ্য।

গত রোববার জাতীয় সংসদে সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনাকালে সংসদ কিছুটা হলেও সরগরম হয়ে ওঠে। সেখানে প্রশ্ন উঠেছে, বাজেটটি আসলে কার?

রোববার আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির নারী সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, ‘আপনারা কেউ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হননি।’ তাঁর ভাষায়, ‘সংবিধানের ৬৫ (২) ধারায় বলা আছে, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে হবে। ...এখানে যারা আছেন, তাঁরা কয়জন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করুন।’

রুমিন বলেন, ‘যখন আমরা সংসদে যোগ দিই, তখন আমাদের বলা হয়েছিল আমরা আমাদের কথা বলতে পারব। কিন্তু আমার প্রথম দিনের বক্তব্য ছিল দুই মিনিট, আমি এক মিনিটও শান্তিতে কথা বলতে পারিনি। একই ঘটনা আজকেও ঘটছে। তাহলে আমরা কোন গণতন্ত্রের কথা বলি, কোন বাক্‌স্বাধীনতার কথা বলি, কোন সংসদের কথা বলি। এভাবে তো একটা সংসদ চলতে পারে না।’

বর্তমান সংসদ নির্বাচিত নয় দাবি করে রুমিন বলেন, ‘এরপরও আমরা সংসদে যোগ দিয়েছি। কারণ, আমাদের মিছিল করতে দেওয়া হয় না, জনসমাবেশ করতে দেওয়া হয় না। ভেবেছি আমরা সংসদে একটা জায়গা পাব। যেখানে আমরা দেশের কথা, জনগণের কথা, আমাদের নেতা-কর্মীদের কথা বলতে পারব।’ ৩০০ আসন লুট করে নেওয়া হয়েছে অভিযোগ তুলে রুমিন বলেন, ‘তাঁদের এতটুকু ধৈর্য নেই যে, আমার মতো একজন সংসদ সদস্যের এতটুক কথা শোনার।’

এ সময় স্পিকার বলেন, ‘আপনি এমন কথা বলবেন না, যেটা এক্সপাঞ্জ করতে হবে।’ তখন রুমিন বলেন, ‘এটা আপনার (স্পিকার) এখতিয়ার, আমার কিছু করার নেই।’ এ সময় রুমিন দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, দেশে আইন আছে, আদালত আছে। কিন্তু আইনের শাসন নেই। গত এক মাসে ১৬৮ জন হত্যার শিকার হয়েছে। ১ বছরের শিশু থেকে ১০০ বছরের বৃদ্ধা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরে স্পিকার বলেন, সম্পূরক বাজেটের বাইরে দেওয়া রুমিনের অসংসদীয় শব্দগুলো সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হবে।

রুমিনের আগে বক্তব্য দেন বিএনপিদলীয় সাংসদ হারুন উর রশীদ। তিনি নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে বলেন, তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। তাদের সরিয়ে দেওয়া উচিত। তারা বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

গণফেরামের সাংসদ মোকাব্বির খান বলেছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটকে অর্থমন্ত্রী নাম দিয়েছেন সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের। সময় এখন বাংলাদেশের। বাস্তবে সময় এখন কালোটাকার মালিকদের। সময় এখন লুটেরাদের এবং অর্থ পাচারকারীদের।

আসলে বাজেটটি কার? অর্থমন্ত্রী একটি স্মার্ট বাজেট দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা বলেছেন, এটি মোটেই স্মার্ট নয়। বরং পদ পদে আছে গোঁজামিল ও শুভংকরের ফাঁকি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এবারের বাজেটে ধনীদের সুরক্ষা থাকলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য কোনো সুরক্ষা নেই। দরিদ্র মানুষের জন্য যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে, তার কতটা তারা পাবেন, আর কতটা লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়ে নেবে বলা কঠিন। বাজেটে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির সুফল কারা পাবেন। অতীতে ধনীরাই বেশি পেয়েছেন। এবারেও এর ব্যতিক্রম হবে না। পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। এখন ২২ হাজার পরিবার তৈরি হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে এবং গরিব মানুষের পক্ষে কথা বলার লোক নেই। যে সরকারে ও সংসদে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের আধিক্য, সেই সরকার ও সংসদের বাজেটে তাদের স্বার্থই সুরক্ষিত হবে।

দেশি–বিদেশি বিভিন্ন জরিপ বলছে, বাংলাদেশ থেকে ফিবছর কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাজেটে অর্থ পাচার বন্ধের কোনো দিকনির্দেশনা না থাকলেও কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থা আছে। ১০ শতাংশ জরিমানা দিলেই কালোটাকা সাদা হয়ে যাবে। এর উৎস নিয়ে কেউ প্রশ্ন করবেন না। আর যে ঋণখেলাপিদের কারণে ব্যাংকিং খাত নাজুক হয়ে পড়েছে, সেই খেলাপিদের ক্রমাগত ছাড় দিয়ে আসছে সরকার।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ এবং ‘সময় এখন আমাদের’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেই সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সুফল যদি গুটিকয়েক লোকের হাতে পুঞ্জীভূত থাকে, তাহলে সেই বাজেট আর যা–ই হোক জনবান্ধব বাজেট হতে পারে না।

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক