বাজেটে শিক্ষা খাত

বহু বছর ধরেই শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছিলেন শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু কোনো সরকারই 

বাজেটে তাদের দাবি আমলে নেয়নি। বর্তমান সরকারের আমলেও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১১-১২ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশের মধ্যে
ঘুরপাক খাচ্ছে। টাকার অঙ্কে ও হারে বরাদ্দ বাড়লেও আশান্বিত হওয়ার মতো কিছু দেখছি না।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উত্থাপিত বাজেটে যে শিক্ষা খাতে ৮৭ হাজার ৬২০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাবের কথা বলেছেন, তাতে শুভংকরের ফাঁকি আছে। তিনি বলেছেন, সরকারের ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু এর মধ্যে শিক্ষাবহির্ভূত খাতের বরাদ্দও আছে। যেহেতু বাজেটে মন্ত্রণালয় ধরে খাতওয়ারি বরাদ্দ হয়ে থাকে, সেহেতু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দই মূলত শিক্ষা খাতের বরাদ্দ হিসেবে করতে হবে। কিন্তু গত বছর থেকে সরকার বাজেট বরাদ্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগকে যুক্ত করে বরাদ্দের হিসাব করছে, যা যৌক্তিক নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দটি আলাদাভাবেই হিসাব করা উচিত।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ ছিল ২২ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ২৪ হাজার ৪১ কোটি টাকা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৮৮৮ কোট টাকা। আর আগামী অর্থবছরে প্রস্তাব করা হয়েছে ২৯ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা।

অন্যদিকে কারিগরি ও মাদ্রাসাশিক্ষা বিভাগে বরাদ্দ ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ গত অর্থবছরে ছিল ৫৩ হাজার ৫৪ কোটি টাকা এবং ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও বাজেটে শিক্ষা খাতে কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দ না থাকা দুর্ভাগ্যজনক। জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে শিক্ষায় বরাদ্দ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি সেই বরাদ্দ কীভাবে খরচ হচ্ছে, সেটিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় জাপানের উদাহরণ টেনে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার কথা বলেছেন। প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা যেতে পারে। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষাঙ্গনে এমন পরিবেশ তৈরি করা, যাতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে ও থাকতে উৎসাহিত হন। শিক্ষাঙ্গনকে রাখতে হবে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত। সেই সঙ্গে যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে পদায়ন করতে হবে।

অর্থমন্ত্রী আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর শ্রেণিকক্ষ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু এখনো গ্রামাঞ্চলের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা ‘মাথার ওপর বাড়ি পড় পড়।’ কোনোটির চাল আছে তো বেড়া নেই, বেড়া আছে তো দরজা নেই। এ ধরনের অবকাঠামোয় যে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শ্রেণিকক্ষ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, তা নিশ্চয়ই নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়।

এবারে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের একাংশ যাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তিতে। ১০ বছর বন্ধ থাকার পর সরকার নতুন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে অনেক শিক্ষকের দুর্দশা ও দুরবস্থার লাঘব হবে। কিন্তু এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান ও যোগ্যতা অগ্রাধিকার পায়, সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে।

বর্তমানে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দুই-তৃতীয়াংশই ব্যয় হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানে, আর এক-তৃতীয়াংশ হয় শিক্ষার উন্নয়নে। আমরা যদি সত্যি সত্যি শিক্ষার উন্নয়ন চাই, তাহলে বেতন-ভাতার চেয়ে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বেশি রাখতে হবে।