এ কেমন খেলা ট্রাম্প-জামাতার?

পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি পুলিশের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের বিরোধ–বাদানুবাদ নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি পুলিশের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের বিরোধ–বাদানুবাদ নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে

৭০ বছর আগে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন কেটে দুই ভাগ করা হয়েছিল, এক ভাগে ইহুদিদের জন্য নতুন রাষ্ট্র ইসরায়েল, অন্যদিকে আরব বংশোদ্ভূত নাগরিকদের জন্য ফিলিস্তিন। স্বাধীন ইসরায়েল ঠিকই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাত যুগ পেরিয়ে গেছে, এখনো স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠিত হয়নি।

জ্যারেড কুশনার, ট্রাম্পের অপোগণ্ড জামাতা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নীলনকশা ফেঁদেছেন। তিনি সফল হলে আগামী এক শ বছরেও সে রাষ্ট্র গঠিত হবে না।

জাতিসংঘের পরিকল্পনা অনুযায়ী, যে জমিটুকু ফিলিস্তিনকে দেওয়া হয়েছিল, তার এক-তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যে ইসরায়েল হজম করে ফেলেছে। বাকি রয়েছে পশ্চিম তীর, সেখানেও অসংখ্য ইহুদি বসতি গড়ে উঠেছে। আর থাকল একরত্তি গাজা, ১৪০ বর্গমাইল এলাকা, সেখানে বাস করে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। এই দুই অঞ্চল নিয়ে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ, সে কেবল নামেই স্বশাসিত। এখানে প্রায় প্রতিটি গ্রাম বা শহরের পাশ দিয়ে ইসরায়েল নির্মাণ করেছে নিরাপত্তাবেড়ি, দুই কদম এগোলেই তাদের সামরিক চৌকি। কার্যত একটি বড়সড় জেলখানা, এই দুই অঞ্চল থেকে বেরোনোরও কোনো উপায় নেই, সীমান্তে বিশাল দেয়াল দেওয়া আছে। সে সীমান্তে চৌপ্রহর পাহারায় রয়েছে ইসরায়েলি পুলিশ।

কয়েক বছর আগে জেরুজালেম পেরিয়ে পশ্চিম তীরে আমাকে যেতে হয়েছিল। পুলিশি প্রহরা, সতর্ক কুকুর, খোলা বন্দুক—সব পেরিয়ে পশ্চিম তীরে পা রাখতে কয়েক ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। আসার পথে নজরে এল অসংখ্য ফিলিস্তিন নাগরিক সীমান্ত পেরোনোর জন্য অপেক্ষা করছে। এদের অধিকাংশই পশ্চিম তীর থেকে এসে ইসরায়েলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। পশ্চিম তীর বা গাজায় কর্মসুযোগ নেই, ফলে মুখ বুজে অপমানিত হয়ে ইসরায়েলেই আসতে হয় কাজের খোঁজে। অন্যরা অসুস্থ, নিজ গ্রামে চিকিৎসার সুযোগ নেই, তাই সীমান্তবেড়ি পেরিয়ে ইসরায়েলে আসছে চিকিৎসার জন্য।

কুশনার যে পরিকল্পনা করেছেন, তাঁর নজর এই সব দরিদ্র, অসহায় ও প্রায় নিরন্ন ফিলিস্তিনি। তাদের স্বাধীন দেশের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন কাজের, অর্থনৈতিক অগ্রগতির—এই যুক্তিতে তিনি শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে অধিকৃত ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক উন্নতির ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়েছেন। ২৫ ও ২৬ জুন তিনি বাহরাইনের রাজধানী মানামাতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডেকেছেন। প্রধানত আরব ও মুসলিম দেশের অর্থমন্ত্রীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থাকেও দাওয়াতপত্র পাঠানো হয়েছে। এই সম্মেলনে তাদের কাছে অনুরোধ রাখা হবে, শান্তির খাতিরে আপনারা ফিলিস্তিনের জন্য সাহায্য দিন। প্রধানত অনুদানই চাওয়া হবে। কুশনার অ্যান্ড কোম্পানি আশা করছে, অন্য কেউ না হোক ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আরব দেশগুলো, বিশেষত উপসাগরের আমিরাতগুলো হাতের মুঠো খুলে পয়সা দেবে। ৪০-৫০ মিলিয়ন তো উঠবেই। এত অর্থ নগদ নগদ পেলে ফিলিস্তিনিরা আবার স্বাধীনতার কথা কেন বলতে যাবে?

এক সাক্ষাৎকারে কুশনার বলেছেন, এত দিন সবাই ‘চূড়ান্ত সমাধানের’ কথা আগে ভেবেছে। কোথায় দুই দেশের সীমান্ত হবে, কে জেরুজালেমের কর্তৃত্ব নেবে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের কী হবে—এই সব অহেতুক বিষয় নিয়ে হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে কোনো কাজ এগোতে পারেনি। এখন সেসব বাদ দিয়ে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের নাকের ডগায় কাঁচা অর্থ ছুড়ে দেওয়া যাক। কুশনার যুক্তি দেখিয়েছেন, অন্যদের মতো এরাও তো সুখী-সমৃদ্ধ জীবন চায়, নিজের বাসগৃহের মালিক হতে চায়, ছেলেমেয়ের শিক্ষার সুযোগ চায়। স্বাধীনতা দিয়ে কী হবে, এই অর্থনৈতিক সুযোগই তো আসল কথা!

সোজা কথায়, অভাবী ফিলিস্তিনিদের ঘুষ দিয়ে কিনতে চাইছেন কুশনার।

তাহলে স্বাধীন ফিলিস্তিনের কী হবে?

কুশনারের জবাব, সে পরে ভাবা যাবে। স্বাধীন দেশ শাসন করার মতো যোগ্যতাই তো এদের নেই। ‘আমরা আশা করছি, কোনো না কোনো সময় তারা প্রশাসন পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করবে।’ শুধু তা-ই নয়, কুশনার আঁক কষে রেখেছেন ফিলিস্তিনের ওপর বর্তমানে যে ইসরায়েলি সামরিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তা-ও অব্যাহত থাকবে। তাহলে ফিলিস্তিনিরা কি কখনো ইসরায়েলি সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি পাবে না?

কুশনারের সাফ জবাব, সে সময় আসার অনেক দেরি। তাঁর কথায়, ‘ইটস এ হাই বার।’ তেমন স্বাধীনতা ভোগের জন্য অনেক কঠিন পরীক্ষায় পাস করতে হবে তাদের। তাঁর সে কথার ব্যাখ্যা হিসেবে ইসরায়েলি সাংবাদিক বারাক রাভিদ বলেছেন, সোজা কথায়, ফিলিস্তিন যদি কোনো দিন সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়, তাহলেও ইসরায়েলের সামরিক প্রহরা অব্যাহত থাকবে।

ফিলিস্তিনিদের শুধু স্বাধীনতা হরণ নয়, তাদের জন্য নির্ধারিত সীমানা দখলেরও ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে এই নীলনকশায়। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকেই ইসরায়েল একটু একটু করে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি জমির ওপর ইহুদি বসতি নির্মাণ করেছে। গত অর্ধশতকে প্রায় পাঁচ লাখ ইহুদি সেখানে বসতি গড়ে তুলেছে। ফিলিস্তিনের জন্য নির্ধারিত জমির কমপক্ষে ১০ শতাংশ ইতিমধ্যেই এই কাজে হাতছাড়া হয়ে গেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, এই সীমানার ওপর তিনি ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করবেন। এর ফলে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে হোক। অর্ধশতকের বেশি তো ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেই পশ্চিম তীর ও গাজার ওপর নিজের অধিগ্রহণ বজায় রেখেছে। আন্তর্জাতিক আইনের থোড়াই কেয়ার করেছে ইসরায়েল।

নেতানিয়াহুর এমন দাবির পেছনে বড় সমর্থন এসেছে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে। সম্প্রতি ইসরায়েলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রিডম্যান বলেছেন, ইসরায়েল যদি এই জমি অ্যানেক্স বা আত্তীকরণ করে, তাহলে সেটা বেআইনি কিছু হবে না। পুরো পশ্চিম তীর না হলেও ইহুদি বসতিগুলোর ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব সম্প্রসারণের অধিকার তার অবশ্যই রয়েছে। মুখে বলা না হলেও এটিও যে কুশনারের শান্তি পরিকল্পনার অংশ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কুশনার পরিবারেরও পশ্চিম তীরের এক বসতিতে সম্পত্তি রয়েছে। বলাই বাহুল্য, এই নীলনকশা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। কুশনার অবশ্য এই পরিকল্পনার ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কোনো কথাই বলেননি। বলবেন কী করে, যুক্তরাষ্ট্রের একপেশে নীতির প্রতিবাদে দীর্ঘদিন থেকেই মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সব যোগাযোগ বর্জন করে চলেছে।

কুশনার ও ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য মাহমুদ আব্বাসের প্রশাসনের থোড়াই তোয়াক্কা করে। তারা ফিলিস্তিনিদের বদলে ধনী আরব দেশগুলোর সঙ্গে আঁতাত করছে। সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এদের কাছে এই মুহূর্তে বড় মাথাব্যথা ইরান, তাকে ঠান্ডা করতে হলে একদিকে চাই আমেরিকা, অন্যদিকে ইসরায়েল। এই স্বার্থগত নৈকট্যের কারণে উপসাগরের আরব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দূতালিতে ইসরায়েলের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। কুশনার বাজি ধরেছেন, চারদিক থেকে চাপের মুখে পড়ে মাহমুদ আব্বাসের প্রশাসন এখন এতটাই দুর্বল যে সৌদি আরব বা কাতার হুকুম দিলে ‘না’ বলার কোনো ক্ষমতা তার থাকবে না।

আরব পত্রপত্রিকায় এই গোপন ষড়যন্ত্র নিয়ে তেমন কোনো রা নেই। তার চেয়ে অনেক বেশি হইচই ইরানের সামরিক তৎপরতা নিয়ে। ইরানকে না ঠেকানো গেলে তাদের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে—এই যুক্তিতে এই সব দেশের সরকার-নিয়ন্ত্রিত পত্রপত্রিকা ইসরায়েল ও আমেরিকার সঙ্গে সামরিক আঁতাতের বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।

এই ষড়যন্ত্র ঠেকানোর একটাই পথ—আরব দেশগুলোর সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ। আরব বিশ্বের মানুষ এখনো ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিশীল। পেট্রো ডলারের নেশায় তাদের দেশের মানুষের অনন্তকাল ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাবে, এ কথা হয়তো আরব রাজা-বাদশাহরা ভেবে থাকতে পারেন। কিন্তু ৮-৯ বছর আগের ‘আরব বসন্ত’ থেকে আমরা জানি, সেখানে আগুন জ্বলে ওঠার জন্য একটা দেশলাইয়ের কাঠিই যথেষ্ট। কুশনার সম্ভবত সেই কাঠিটিই এগিয়ে দিচ্ছেন।

হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি