কালোটাকার ওপর আলো ফেলা সহজ নয়

কালোটাকা সাদা করা নিয়ে বেশ জোরালো বিতর্ক হচ্ছে এখন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী ব্যবসা, শিল্প ও আবাসন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বেশ খানিকটা উদারভাবে কালোটাকা সাদা করার কিংবা অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণা করার সুযোগ দেওয়ায় এই বিতর্ক। এত দিন ফ্ল্যাট কিনে আয়তন ও স্থানভেদে নির্ধারিত হারে কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জমি। পাশাপাশি ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে আগামী পাঁচ বছর পর্যন্ত দেশে নির্মীয়মাণ বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে কালোটাকা বিনিয়োগ করলে তা বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করার আইনি সুযোগ দেওয়া হয়েছে নতুন বাজেটে।

সরকার মনে করছে, এভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিলে বিদেশে অর্থ পাচার রোধ হয়ে দেশের টাকাই অর্থনীতির মূল ধারায় প্রবেশ করে একধরনের নজরদারির মধ্যে আসবে। সমালোচকেরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে অবৈধ আয়-উপার্জন ও কর ফাঁকিকে উৎসাহিত করা হবে এবং নিয়মিত ও সৎ আয়করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন, হতাশ হবেন। তাতে আয়করদাতাদের মধ্যে বৈষম্য বাড়বে। সর্বোপরি সমাজে নৈতিকতার চর্চাও বাধাগ্রস্ত হবে।

মোটাদাগে কর ফাঁকি দেওয়া আয়কে কালোটাকা বলা হয়। তবে এই আয় দুই ধরনের—একটি বৈধ কর্মকাণ্ড থেকে উৎসারিত (যেমন: পেশাজীবীর আয় বা ব্যবসার আয়); আরেকটি অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে উৎসারিত (যেমন: চোরাচালান, ঘুষ ইত্যাদির আয়)।

প্রথম ক্ষেত্রে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কিংবা করসংক্রান্ত জটিলতায় অনেকেই তাঁদের বৈধ আয় পুরোটা আয়করের জন্য প্রদর্শন করেন না। ফলে, এটি হয়ে যায় বৈধ-অপ্রদর্শিত আয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আয়ের উৎসই যেহেতু বেআইনি, সেহেতু তা থেকে আয়কর দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে, তা হয় অবৈধ-অপ্রদর্শিত আয়।

তাই দুই ধরনের কালোটাকাকে একই পাল্লায় মাপা কতটা ঠিক, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তা ছাড়া, সরকার যখন ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের আলাদাভাবে বিবেচনা করতে আগ্রহী, তখন ইচ্ছেকৃত কর ফাঁকি ও অনিচ্ছাকৃত কর ফাঁকি আলাদাভাবে বিবেচনা কেন করা হবে না, সে প্রশ্নও এখন উঠছে।

প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে দেওয়া ‘অর্থ আইন, ২০১৯’ অনুসারে জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনে কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে বৈধ-অপ্রদর্শিত আয় গ্রহণীয়। নির্ধারিত হারে কর দেওয়া হলে কর কর্তৃপক্ষ সেটাকেই আয়ের ব্যাখ্যা হিসেবে বিবেচনা করে এই ধরনের বিনিয়োগকে গ্রহণ করা হবে বলে আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় বলা হয়েছে। তবে অপ্রদর্শিত আয়ের উৎসকে বৈধ হওয়ার শর্তারোপ করায় মনে হতে পারে যে সরকার আবাসন খাতে ঢালাওভাবে কালোটাকার বিনিয়োগ চায় না।

আবার একই আইনে নতুন সংযোজিত ‘১৯ ডিডি’ ধারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ও হাইটেক পার্কে ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে বিনিয়োগ করলে উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সুযোগ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এ ক্ষেত্রে বৈধ বা অবৈধ যেকোনো অপ্রদর্শিত আয়কে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। মানে এখানে ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করা যাবে।

কিন্তু সুযোগ দেওয়া হলেই সবাই কি তা গ্রহণ করেন? অতীতের অভিজ্ঞতা বলে যে বিভিন্ন সময় সুযোগ দেওয়া হলেও খুব সামান্য পরিমাণ কালোটাকাই সাদা হয়েছে। তা ছাড়া কালোটাকার মালিকেরা নিশ্চয়ই সিন্দুকে বা বালিশের ভেতরে তাড়া তাড়া নগদ টাকার নোট রেখে দেননি। গুটিকয়েক বাদে বাকিরা কমবেশি এই কালোটাকা জমি-বাড়িতে এবং সঞ্চয়পত্রে ও শেয়ারবাজারে তথা আর্থিক খাতে বিনিয়োগ করেছেন নামে-বেনামে।

কেউ কেউ খোলাবাজার থেকে বিদেশি মুদ্রা, বিশেষত ডলার কিনেছেন। তাঁরা তাঁদের এই অর্থ ভোগব্যয়েও ব্যবহার করছেন। এভাবে কালোটাকার অনেকটাই আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছে, এখনো করছে। আবার অনেকে তা বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন বা পাচার করেছেন। সেসব অর্থও সেখানে কোনো না কোনো খাতে বিনিয়োগ হয়ে গেছে। তাঁরা বিনিয়োগকৃত এই কালোটাকা তুলে এনে সরকারের দেওয়া সুযোগ কতটা গ্রহণ করবেন এবং কেন করবেন, তা আসলে দেখার ও পর্যালোচনার বিষয়।

তবে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে আভাস মেলে যে দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার কিছু অংশ আবার ফেরতও আসছে। তা বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবেই ফেরত আসছে মূলত উচ্চ মুনাফার প্রত্যাশায়।

একটি দেশের অর্থ পাচার হয়ে আরেকটি দেশ ঘুরে সে দেশের পুঁজি হিসেবে মূল উৎস দেশে বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবে ফিরে আসাকে বলা হয় রাউন্ড ট্রিপিং। বারমুডা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড বা মরিশাস থেকে যে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে, তার কিছু অংশ যে ‘রাউন্ড ট্রিপিং এফডিআই’ তা বলা যায়। যেহেতু বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কালোটাকা আর সাদাটাকার কোনো প্রভেদ করা হয় না বা টাকার উৎস জানতে চাওয়ার বিষয় নেই, সেহেতু ১০ শতাংশ কর দিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনা প্রশ্নে বিনিয়োগের বিষয়টি দেশীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, কালোটাকা সাদা করার এসব সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিলেন যে দেশে কালোটাকা বাড়ছে। অনিয়ম-ঘুষ-দুর্নীতির বিস্তার যে কালোটাকা বাড়ায়, তা বলা বাহুল্য। ছোট-বড় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অনুপার্জিত আয় (রেনট সিকিং) তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে আর অনুপার্জিত আয়কারীদের পকেট স্ফীত হচ্ছে। মাদক, বিশেষত ইয়াবার ব্যবসা যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে, তা–ও তো কালোটাকা সৃষ্টি করছে।

মূলত, রাজনৈতিকভাবে মদদপুষ্টরা এই কালোটাকার সুবিধাভোগী হচ্ছেন। তাঁদের একটি আইনি সুরক্ষা দেওয়ার কৌশল হিসেবেও কালোটাকার ওপর আলো ফেলার যে উদ্যোগ অর্থমন্ত্রী নিয়েছেন, তাতে করে বিতর্ক-সমালোচনাটা তো অস্বাভাবিক নয়।

আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক।