বিএনপির অফিস খোলা আছে

জয়পুরহাট জেলা বিএনপির অফিস
জয়পুরহাট জেলা বিএনপির অফিস

ঈদুল ফিতরের পর জয়পুরহাট বেড়াতে গিয়ে দিন ছয়েক অনেক মানুষের সঙ্গে গল্পগুজব করা গেল। আমার সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে অনেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দেশ কেমন চলিচ্ছে?’ আমি হেসে তাঁদের বলি, ‘দেশ কেমন চলছে তা তো আপনারাই আমাদের বলবেন, আপনাদের কথাই তো আমরা লিখব।’ আমার কথা শুনে তাঁরাও হাসলেন; দুঃখের হাসি। অধিকাংশ মানুষ দুইটা দুঃখের কথা বললেন: এক. ‘ধানের দাম খুবই কম’, দুই. ‘ভোট দিবা পারিনি।’

ধানের বাম্পার ফলন হলে দাম খুব কমে যায়—ধানচাষির এই দুঃখ পুরোনো হয়ে গেছে। এবার তাঁরা এত বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছেন যে কেউ কেউ পাকা ধানের খেতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। দেশজুড়ে বেশ শোরগোল হয়েছে। কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার সরকারি উদ্যোগ কৃষকের ক্ষোভ–দুঃখ কমাতে পারছে না, কারণ এ উদ্যোগের মধ্যে বিরাট কারসাজি রয়ে গেছে বলে তাঁরা মনে করছেন। জেলা–উপজেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দুর্নীতির উদ্দেশ্যে হয়রানির অভিযোগ বিস্তর।

ভোট দিতে না পারার দুঃখ আগেও ছিল, কিন্তু এবারের সাধারণ নির্বাচনে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে—এই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন অনেক মানুষ। কেউ কেউ বললেন, এ রকম খারাপ নির্বাচন তাঁরা আগে কখনো দেখেননি। জয়পুরহাট–১ আসনে বিএনপির প্রথম মনোনীত প্রার্থী ফজলুর রহমানের মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশন অবৈধ ঘোষণা করেছিল একদম শেষ মুহূর্তে। তাদের বক্তব্য ছিল, ফজলুর রহমান উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করেননি বলে তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। নির্বাচন কমিশন যখন ফজলুর রহমানের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করে, তখন আর বিএনপির বিকল্প দুই প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ছিল না। ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়পুরহাট–১ আসনে বিএনপির কোনো প্রার্থীই ছিল না। যেসব মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই আমাকে বলেছেন, এটাকে তাঁরা নির্বাচন কমিশনের কারসাজি বলে মনে করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্দেশে এই কারসাজি করেছে। কারণ, তাদের জানা ছিল, জয়পুরহাট–১ আসনে বিএনপির কোনো প্রার্থী থাকলে, তা যদি একটা কলাগাছও হয়, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিজয় কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। একজন বললেন, জয়পুরহাট জেলার দুটি সংসদীয় আসনে যে কটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা অংশ নিয়েছেন, তার প্রতিটিতেই তাঁরা জয়ী হয়েছেন। শুধু এবারই ব্যতিক্রম ঘটেছে: জয়পুরহাট–১ আসনে বিএনপিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেই দেওয়া হয়নি; আর জয়পুরহাট–২ আসনে তাদের প্রার্থীকে পরাজিত করা হয়েছে ব্যাপক জালিয়াতি ও জবরদস্তির মাধ্যমে।

লোকজনের ভোট দিতে না পারার দুঃখের কথাটা গল্পচ্ছলে বললাম জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বসে, ১৩ জুন সন্ধ্যার একটু পরে। শুনে বয়স্ক একজন বললেন, ‘হাঁ, ভোট দিতে পারলে তো কামই সারা হয়ে গেছিল!’

তাঁর কথার সুরটা বেশ স্পষ্টই ছিল, তবু বললাম, ‘আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?’

তিনি অনেকক্ষণ ধরে যা বললেন, তার সারসংক্ষেপ হলো, লোকজন ঠিকমতো নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে বাংলাদেশের সর্বনাশ হয়ে যেত, দেশ আবার রাজাকার–আলবদর–খুনি–যুদ্ধাপরাধীদের খপ্পরে পড়ে যেত।

আমি বললাম, এ ধরনের বক্তব্য আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থক–শুভানুধ্যায়ীদের মুখে অনেক শোনা গেছে; কিন্তু জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে কি না? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। পাশ থেকে এক যুবক বললেন, ‘আমরা স্বীকার করি, জয়পুরহাটে বিএনপিই সবচেয়ে বড় দল। কিন্তু দলটা খুবই খারাপ।’ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ কথার ভিত্তি কী; কী বাস্তব কারণে তিনি বলছেন যে বিএনপি খুব খারাপ দল। উত্তরে তিনি বললেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী না থাকায় দলটি অনানুষ্ঠানিকভাবে আলেয়া বেগম নামের এক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করেছিল, যাঁর কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই, সামাজিক মানমর্যাদা নেই, যিনি অত্যন্ত ‘খারাপ’। এ প্রসঙ্গে কথাবার্তার একপর্যায়ে বলা হলো, ওই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে গোপনে সমর্থন দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী এবং দলটির লোকজন গোপনে সংগঠিতভাবে তাঁকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের পাশাপাশি বিএনপির সমর্থক ভোটারদের একটা বড় অংশও তাঁকে ভোট দিয়েছেন। অন্যত্র শুনেছি, ‘মাত্র এক ঘণ্টা ভোট দেওয়ার সুযোগ’ পেয়ে ৮৩ হাজার ভোটার তাঁকে ভোট দিয়েছেন।

আমি জানতে চাইলাম, জয়পুরহাটে কি এখন জামায়াতে ইসলামীর কোনো কর্মকাণ্ড আছে? উত্তরে সেই বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, জামায়াতে ইসলামী আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি হয়ে গেছে। গোপনে তারা খুব সংগঠিত। তিনি আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘এখনই ডাক দেক, আসো রে, জড়ো হও, আর কোনো অসুবিধা নাই, তাহলে দুই ঘণ্টার মধ্যে মাঠ ভরে যাবে।’

জামায়াতের কিছু লোক নাকি আওয়ামী লীগের মধ্যে ঢুকে গেছে?—আমার এই কৌতূহলের উত্তরে তিনি বললেন, ‘ঢুকে থাকতে পারে, কিছুই বলা যায় না।’ পাশ থেকে সেই যুবক বললেন, বিএনপি–জামায়াত সরকারের আমলে সন্ত্রাসী ছিল, এমন কিছু লোক এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের ঘনিষ্ঠ। ‘হাইব্রিড আওয়ামী লীগার’ কথাটাও সেখানে শুনতে পেলাম; জয়পুরহাটের আওয়ামী লীগে এখন এই হাইব্রিড আওয়ামী লীগারদের কদর ও দাপট খুব বেশি—এ কথা বললেন একাধিক জন। তঁারা মাদকদ্রব্যের কারবারসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত, পুলিশ তাঁদের ধরলে আওয়ামী লীগের নেতারা, এমনকি কেন্দ্রীয় পর্যায়েরও প্রভাব খাটিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করেন। জয়পুরহাটে মাদক সেবন ও মাদকের কারবার ব্যাপক; ১০ জুন জয়পুরহাট থানায় পরিদর্শক (তদন্ত) মমিনুল হকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ওই থানায় সর্বাধিকসংখ্যক মামলা হয় মাদকের কারবারের অভিযোগে।

সেদিন আওয়ামী লীগের অফিসে গল্পগুজবের শেষ প্রসঙ্গ ছিল তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ দল বিএনপি। সেখানে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, জয়পুরহাটে বিএনপির অবস্থা কী। উত্তরে শুনতে পেলাম, বিএনপির কিছু করার নেই। বলা হলো, দলটা বড়, এটা ঠিক, কিন্তু এখন তাদের বড়ত্ব অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ যত দিন পর্যন্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছে, বিএনপি তত দিন অপ্রাসঙ্গিকই থেকে যাবে। আর আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে হবে দেশ–জাতির প্রতি নৈতিক দায়িত্বের কারণে। দায়িত্বটা হলো দেশকে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়া।

জয়পুরহাট শহরের মধ্যখানে রেললাইনের পুব পাশে জেলা আওয়ামী লীগের অফিস থেকে জেলা বিএনপির অফিসে হেঁটে যেতে মিনিট তিনেক লাগল। রেললাইনের পশ্চিম পাশেই একটা উত্তর–দক্ষিণ চিকন গলির ধারে টিন–ছাওয়া একটা ঘরে বিএনপি ও ছাত্রদলের অফিস। সেখানে গিয়ে লোকজনের ভিড় দেখে একটু অবাক হলাম; কারণ কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে ছিটকে পড়লে নেতা–কর্মীদের কাছে তার আকর্ষণ কমে যায় বলে আমার ধারণা। নগদ প্রাপ্তির আশা এবার কত দিনের জন্য স্থগিত হয়ে গেছে কেউ জানে না, তবু কেন ও কিসের আশায় মধুশূন্য মৌচাক ঘিরে এত ভিড়!

কুশল বিনিময়ের সুরে বললাম, কেমন চলছে আপনাদের? উত্তর এল, ‘শুধু অফিসটাই খুলতে পারি, আর কিছুই করতে পারি না।’ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও অন্য নেতা–কর্মীরা বললেন, পুলিশ তাঁদের কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেয় না। জমায়েত করতে চাইলে অফিসের দরজার সামনেই করতে হয়, টুল বা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হয়; পুলিশ চারপাশে ঘিরে রাখে। তারা আগেই শাসিয়ে যায়, জমায়েত গলি ছাড়িয়ে গেলেই ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। নেতাদের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন, যাঁর বিরুদ্ধে মামলা নেই।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোনো ইস্যু, কর্মসূচি না থাকলে আপনারা দলের কর্মীদের ধরে রাখবেন কীভাবে? কত দিন এভাবে ধরে রাখতে পারবেন বলে মনে করছেন? উত্তরে সাধারণ সম্পাদক নাফিজুর রহমান বললেন, তাঁরা কয়েক মাস ধরে দলের বিভিন্ন কমিটি সংগঠিত করার কাজে ব্যস্ত আছেন; এই কাজ আরও কয়েক মাস চলবে। ঈদুল আজহার পরে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করার পরিকল্পনা আছে।

আমি বললাম, কর্মসূচি ঘোষণা করা এক কথা, আর তা বাস্তবায়ন করা আরেক কথা। যেসব তীব্র বাধাবিপত্তির কথা আপনারা বললেন, সেগুলো অতিক্রম করে কীভাবে কর্মসূচি পালন করবেন।

এ প্রশ্নের উত্তর অনির্দিষ্ট: ‘দেখা যাক’। লন্ডনে বসবাসরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে নিয়মিত স্কাইপে কথোপকথন হয়, তিনি নানা নির্দেশনা ও পরামর্শ দেন—এ কথা বললেন দুজন নেতা। নির্দেশনা ও পরামর্শগুলো কী ধরনের, তা অবশ্য তাঁরা বললেন না। তবে আলাপের শেষ পর্যায়ে বেশ জোর দিয়ে বললেন, জয়পুরহাটের বিএনপির নেতা–কর্মীরা মোটেই হতাশায় ভুগছেন না, কারণ জনগণ তাঁদের সঙ্গে আছে, সরকারের সঙ্গে নেই। তাঁদের ভাষায় ‘চরম স্বৈরতান্ত্রিক’ সরকারের সর্বাত্মক দমন–পীড়নের মুখেও পার্টির অফিস খোলা আছে, এখানে নেতা–কর্মীরা আসছেন—আপাতত এটাও কম কথা নয়।

মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক