সাংবাদিককে ফাঁসাতে গিয়ে ফাঁসল পুতিনের সরকার

ভ্লাদিমির পুতিন ও ইভান গোলুনোভ।
ভ্লাদিমির পুতিন ও ইভান গোলুনোভ।

ভ্লাদিমির পুতিন গত বছর নতুন মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার রাজনৈতিক আবহে ঝিমিয়ে পড়া দশা বিদ্যমান ছিল। দিন দশেক আগে সেই স্তিমিত অবস্থায় একটি ঝাঁকুনি এসেছে। একজন সাংবাদিককে পুলিশ মাদক কারবারি সাজিয়ে গ্রেপ্তার করার পর রুশ সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় সেই ঝাঁকুনি টের পাওয়া গেছে।

সাংবাদিককে পুলিশের হয়রানি এবং তার প্রতিক্রিয়ায় জনবিক্ষোভের এ ঘটনা আমাদের যে বার্তা দিয়ে গেল, তা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ঘটনার সূত্রপাত হয় ৬ জুন। ওই দিন মেদুসা পত্রিকার স্বল্পপরিচিত অনুসন্ধানী সাংবাদিক ইভান গোলুনোভকে মাদক উৎপাদন ও বিক্রির অভিযোগে আটক করা হয়। এরপর ছবি দেখে চেনা যায় না এমন কিছু পদার্থভর্তি কয়েকটি ব্যাগ এবং কেমিক্যাল ল্যাবে ব্যবহার্য কয়েকটি যন্ত্রপাতির ছবি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়া হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এগুলো মাদকদ্রব্য এবং মাদক বানানোর যন্ত্র। এগুলো গোলুনোভের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ আরও দাবি করে, ওই সাংবাদিকের ব্যাকপ্যাকে আরও অনেক মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে। এ অভিযোগে গোলুনোভ ১০ থেকে ২০ বছরের কারাভোগের মুখে ছিলেন।

গোলুনোভ ও মেদুসা পত্রিকার পক্ষ থেকে বলা হয়, এসব পুলিশের পাতানো কারসাজি। তাঁকে ফাঁসাতে পুলিশ ‘নাটক’ সাজিয়েছে। রক্ত পরীক্ষার পর গোলুনোভের রক্তে মাদকের অস্তিত্ব মেলেনি। যে ব্যাগগুলোকে পুলিশ প্রমাণ হিসেবে হাজির করেছে তাতে তাঁর আঙুলের ছাপ মেলেনি। এমনকি যন্ত্রপাতি রাখা যে ঘরের ছবি ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে, সেটি গোলুনোভের ফ্ল্যাটের ছবি নয়।

রাশিয়ায় বাক্‌স্বাধীনতার পরিধি খুব সীমিত। বিশেষ করে মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবুর্গের বাইরে নানান ধরনের বিপদের মুখে পড়তে হয়। সাংবাদিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, মারধর করা এমনকি হত্যা করার ঘটনাও সে দেশে ঘটে। কিন্তু গোলুনোভকে এই অভিযোগে আটক করার সঙ্গে সঙ্গে সবার মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া হয়েছে যে সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রধান শিরোনাম হয়ে ওঠেন তিনি। রাশিয়ায় সাংবাদিককে ফাঁসানোর এই কায়দা যেমন নজিরবিহীন, তেমনি রুশ সমাজে এর প্রতিক্রিয়াও হয়েছে নজিরবিহীন। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরপরই মস্কোর প্রধান পুলিশ কার্যালয়ের সামনে বহু লোক বিক্ষোভ করেছে। সারা রাত সেখানে তারা অবস্থান করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তিনটি পত্রিকা ভেদোমোস্তি, কোমারসান্ত এবং আরবিসি ১০ জুন অভিন্ন শিরোনাম ‘আমরা সবাই আইভান গোলুনোভ’ ব্যবহার করে খবর ছেপেছে। এ ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এত বেশি চাঞ্চল্য তৈরি হয় যে পুতিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেন্ট পিটার্সবুর্গ ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক ফোরামের খবর চাপা পড়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে। যাঁরা সাধারণত রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান না, তাঁদেরও এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া করতে দেখা গেছে। যে বুদ্ধিজীবী এ বিষয়ে নিজের কোনো অভিমত দেননি, তাঁকে আক্রমণ করে লোকজন স্ট্যাটাস দেওয়া শুরু করে। এরপর লোকজন ১২ জুন বড় ধরনের বিক্ষোভ করার ঘোষণা দেয়।

এরপর যেটি হয়েছে, তা আরও নজিরবিহীন। জনগণের এই প্রতিক্রিয়া দেখে ক্রেমলিন গোলুনোভকে ১১ জুন শুধু ছেড়েই দেয়নি, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে মিথ্যা বলে তারা স্বীকার করে নিয়েছে। যে পুলিশ কর্মকর্তারা গোলুনোভের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ এনেছেন, তঁাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।

রাশিয়ায় জনবিক্ষোভের কাছে সরকারের নতি স্বীকার করার ঘটনা খুবই বিরল। এর আগে অবশ্য ২০১৩ সালে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের মুখে বিরোধী রাজনীতিক আলেক্সি নাভালনিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ১১ জুন গোলুনোভকে ছেড়ে দেওয়ার পরও সরকারের অনুমতি না নিয়ে এ ইস্যুতে বিক্ষোভ হয়েছে এবং সেই বিক্ষোভে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে নাভালনিসহ ৪০০ জনকে আটক করা হয়েছে।

তবে গোলুনোভকে ছেড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে একধরনের বার্তা পাওয়া গেছে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা গেছে, রাশিয়ার মানুষ দীর্ঘদিন মুখ বুজে সরকারের নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ড সহ্য করে এলেও অনেক ইস্যুতে তারা এক হতে পারে। জনগণের এই এক হওয়াকে সরকার যে ভয় পায়, সেটিও এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার হয়েছে। এ ঘটনায় আরও পরিষ্কার হয়েছে, রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোর সাহস ও শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্র শেষ করে দিতে পারেনি, ন্যায়ের ইস্যুতে তারাও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে।

এখন মনে হচ্ছে গোলুনভকে ছেড়ে দিলেও এখানেই বিক্ষোভের সমাপ্তি হচ্ছে না। এখন নাভালনিসহ আটক হওয়া বিক্ষোভকারীদের মুক্তির জন্য নতুন বিক্ষোভের জন্ম হতে পারে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
রোমান দোবরোখাতভ: মস্কোভিত্তিক সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী