আর কত রহস্যজনক 'নিখোঁজ'?

চট্টগ্রামের বাসিন্দা ও তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষার্থী সৈয়দ ইফতেখার আলমের অপহরণ নিয়ে তাঁর মা সৈয়দা ইয়াসমিন আরজুমান যে অভিযোগ করেছেন, তা খুবই গুরুতর। মানুষ অপরাধের শিকার হলে প্রতিকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হয়। কিন্তু এখানে এক মা তাঁর সন্তান নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন।

গত সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সন্তান অপহৃত হওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে আরজুমান যা বলেছেন, তার মর্মার্থ হলো ২০১৭ সালে ইফতেখার বেঙ্গলি বিউটি নামে একটি চলচ্চিত্রে কাজ করার সময় সওদা নামে এক তরুণীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও সম্পর্ক হয়। এরপর সওদার বাবা ব্যবসায়ী সালেহ আজাদ চৌধুরী সওদাকে অন্য পাত্রের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিলেও সেটি টেকেনি। ২০১৮ সালের এপ্রিলে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটলে সওদার বাবা এ জন্য ইফতেখারকে দায়ী করেন। ইফতেখারের মায়ের অভিযোগ, সালেহ আজাদ চৌধুরী তাঁদের পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে ইফতেখারকে হয়রানি ও মানসিক নির্যাতন করান। ৯ জুন সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের মিমি সুপার মার্কেটে যাওয়ার পথে ইফতেখার নিখোঁজ হন। ওই দিন দুপুরে র‌্যাবের লোকজন ইফতেখারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সন্ধ্যা সাতটায় মার্কেটের সামনে যেতে বলেছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি আর ফিরে আসেননি।

ওই সংবাদ সম্মেলনে আরজুমানের ফুফাতো ভাই ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ইফতেখারকে খুঁজে বের করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। একটি মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারপরও কীভাবে তারা এর সঙ্গে যুক্ত হলো, সেটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চট্টগ্রামের উল্লিখিত ব্যবসায়ীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। ইফতেখার নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সেই সম্পর্ক কাজ করেছে কি না, তারও সুলুকসন্ধান জরুরি।

নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশবাসী জেনেছে যে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কীভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে থাকেন। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়ায় অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছেন (যদিও মামলাটি আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে)। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। গত কয়েক বছরে শত শত মানুষ গুম ও রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ ফিরে এলেও অনেকের সন্ধান মেলেনি। যঁারা গুম বা নিখোঁজ অবস্থা থেকে ফিরে এসেছেন, তাঁরাও ভয়ে মুখ খোলেন না। কোনো সভ্য ও আধুনিক রাষ্ট্রে এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে পারে না।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা। সেই বাহিনীগুলোর কেউ যদি অপহরণ বা গুমের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে বা এ ধরনের অভিযোগ ক্রমাগত উঠতেই থাকে, তবে নাগরিকদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিয়ে ভীতি বাড়তেই থাকবে। এ ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়লে সরকার ও বাহিনীগুলোর উচিত প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি বজায় রাখার স্বার্থে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তাতে বাহিনীগুলোর ওপর জনগণের আস্থা বজায় থাকবে। ব্যক্তি বা ব্যক্তিবিশেষের অপরাধের দায় কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানের নেওয়া উচিত নয়।

আমরা আশা করব, ইফতেখার তাঁর মায়ের কাছে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসবেন। একই সঙ্গে আমাদের প্রত্যাশা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের যথাযথ তদন্ত ও ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাবমূর্তি উন্নত রাখতে সচেষ্ট থাকবে। দেশ থেকে গুম ও অপহরণ–সংস্কৃতির অবসান হোক।