শরণার্থীদের সঙ্গে পায়ে-পায়ে এগিয়ে যাওয়া

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

বিশ্ব শরণার্থী দিবসটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই দিনটি আমাদের বেঁচে থাকার কিছু মূল দিক নিয়ে আমাদের ভাবায়। যেমন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য আশ্রয়, নিরাপত্তা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাত্রার স্বাধীনতা এবং মানবিক মর্যাদার অর্থ কী? ইতিহাসে আমাদের যাত্রার প্রথম দিকের বিষয়গুলোর অধিকাংশই ছিল আশ্রয়ের সন্ধান—ক্ষুধা থেকে আশ্রয়, অথবা কোনো বিপদ থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয়।

আধুনিক বিশ্বে মানুষের আশ্রয় খোঁজার সহজাত ইচ্ছাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন সহিংসতা থেকে আশ্রয়প্রার্থী মানুষকে রক্ষা করার বৈশ্বিক চুক্তি থেকে আলাদা কিছু নয়। বাংলাদেশ নিজেই এই মহান ঐতিহ্যের সাক্ষী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ লাখ লাখ মানুষের আশ্রয় প্রার্থনার সাক্ষী। এবং আজও বাংলাদেশ ১০ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়স্থল হয়ে তাদের বেদনার সাক্ষী।

দুর্ভাগ্যবশত আধুনিক সময়ে শরণার্থীরা ক্রমবর্ধমানভাবে অনেক বেশি নেতিবাচক প্রচারণার শিকার। তাদের অনেক সময় অপরাধ ও বেকারত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হিসেবে দেখা হয় এবং স্থানীয় সংস্কৃতির জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ জন্যই বিশ্ব শরণার্থী দিবসটি এত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই দিনটি শরণার্থীদের চ্যালেঞ্জগুলো বোঝার এবং মানবতার শ্রেষ্ঠ দিকটি উদ্যাপনের সুযোগ করে দেয়। এই দিনটি পালনের একটি অন্যতম লক্ষ্য শরণার্থীদের হুমকি কিংবা ‘অন্য কেউ’ হিসেবে দেখার মতো–প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া এবং শরণার্থীদের মানবিক চোখে দেখা। একজন শরণার্থী থেকে আমার ব্রিটিশ কূটনীতিক হয়ে ওঠার যাত্রার কথা যখন আমি ভাবি, তখন বিশ্ব শরণার্থী দিবসটি আমার কাছে অনেক আবেগ নিয়ে ফিরে আসে। তাই আজ আমি আমার জীবনের গল্প সবাইকে বলতে চাই।

আমার অভিভাবক সহিংসতার আশঙ্কা থেকে পালিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাজ্যে পৌঁছান। আমার বয়স তখন ৭ বছর। ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারি না—একমাত্র সম্বল বেলুচি ও ফার্সি ভাষা, তার সঙ্গে জাতিসংঘের নীল রঙের ট্রাভেল ডকুমেন্ট। যখন একজন ব্রিটিশ হয়ে ওঠার অর্থ কী তা অনুধাবন করছিলাম, তখনো অন্য জীবন, অন্য দেশ, অন্য ভাষা এবং অন্য খাবারের স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে অম্লান। বেশ কয়েক বছর পর আমি নিজেকে আবিষ্কার করি আমার নতুন দেশের একজন কূটনীতিক হিসেবে।

আমার জন্য যুক্তরাজ্যে আশ্রয় পাওয়া ছিল বিস্ময়কর! আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখন একটি শিক্ষাসফরে যাই যা আমার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে। ফ্রান্সের সীমান্তের কাছাকাছি এলে আমার শিক্ষক মি. উইলিস আমাকে নিয়ে একটি আলাদা ইমিগ্রেশন লাইন তৈরি করেন এবং বাকি সব শিক্ষার্থীকে বলেন যে ‘এটি বিশেষ মানুষদের জন্য একটি বিশেষ ইমিগ্রেশন লাইন।’ সেই দিন আমার শিক্ষক নেতিবাচক বিভেদের ধারণার কাছে নতি স্বীকার না করে পার্থক্যের ধারণাটি ইতিবাচকভাবে তুলে ধরেন, যা আমার মধ্যে নিজেকে ও আশপাশের মানুষকে আপন করে নেওয়ার আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার করে। সেদিনের ঘটনাটি আমাকে জীবনের সব ভয় থেকে মুক্ত করে। এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার ছিল, যা আমাকে আমার আশ্রয় প্রদানকারী দেশ দিয়েছে। অন্য ভাষায় কথা বলার ভয়, নির্দিষ্ট উপায়ে চিন্তা ও নিজের মতো থাকার সংকোচ থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি। বরং সুযোগ পেয়েছি নিজের মতো বেড়ে ওঠার, শেখার এবং পরিবর্তন হওয়ার।

যখন আমি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করলাম, তখন আমার নিজের পরিবারও বিস্মিত হলো! সবার একটাই ধারণা ছিল যে যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক কার্যালয় হয়তো আমার মতো শরণার্থীর অতীতসংবলিত কাউকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নয়। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক কার্যালয়কে ব্রিটিশ সত্তা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের দেবালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সবার একটাই শঙ্কা—তারা কি জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কাজে এমন কাউকে নিয়োগ দেবে যে কিনা যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেনি?

বলার অপেক্ষা রাখে না যে তাদের অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। আমাকে এবং আমার পরিবারকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রদর্শন করে যুক্তরাজ্য শুধু আমাদের প্রতি বিশ্বাসই স্থাপন করেনি, তার সঙ্গে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে নিরপেক্ষতা, সহনশীলতা এবং সমতা শুধু সাময়িক সংকট থেকে উত্তরণের জন্যই নয়। এই শক্তিশালী মূল্যবোধ চিরদিনের জন্য, যা আমার মতো সাবেক শরণার্থীসহ সবার সমষ্টিগত মানবসম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

শরণার্থীদের প্রতি অবিশ্বাস ও ভীতি দূর করার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা হলো শরণার্থীদের বোঝার চেষ্টা করা ও তাদের ‘গ্রহণ’ করার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা। তবে তার মানে এই নয় যে নতুন কাউকে গ্রহণ করার মাঝে কোনো ঝুঁকি নেই। এত স্বল্প সময়ে এত মানুষ একসঙ্গে উন্নত জীবন চাইছে। একই সঙ্গে সমাজের প্রচলিত সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্রমাগত সংগ্রাম সংগতভাবেই সামাজিক সংহতি, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়।

বিশ্ব শরণার্থী দিবসে এই বছর আমরা উৎসাহিত করছি শরণার্থীদের সঙ্গে পায়ে-পায়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি গর্বিত যে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তায় এগিয়ে আসা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য অন্যতম। ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা–সংকট সমাধানে যুক্তরাজ্য অতিরিক্ত ১২৯ মিলিয়ন পাউন্ড সহায়তা প্রদান করেছে। যুক্তরাজ্যের অনুদান কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণ ও রোহিঙ্গাদের দুর্যোগ মোকাবিলার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব ও বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব হ্রাস ও সার্বিক সহনশীলতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।

বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আমি গর্ববোধ করি যে আমি একজন শরণার্থী ছিলাম। আমি সবাইকে অনুপ্রাণিত করব যেন তাঁরা বিশ্বজুড়ে শরণার্থীদের মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে ভাবেন। শরণার্থীদের সঙ্গে পায়ে-পায়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের প্রতি সমব্যথী হওয়ার বিকল্প নেই।

কানবার হোসেইন-বর: বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার