মুরসির মৃত্যু ও মোবারকের বেঁচে থাকা

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

মিসরের একমাত্র নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির মৃত্যু মনে করিয়ে দেয় চিলির নির্বাচিত সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে হত্যাকে। তুলনাটা গুণে নয়, লক্ষণে। একজন ছিলেন সমাজতন্ত্রী, অন্যজন ইসলামপন্থী। কিন্তু দুজনই ছিলেন গণতন্ত্রী। দুজনেই ক্ষমতা হারিয়েছেন সেনা অভ্যুত্থানে, দুটি মৃত্যুই যাঁর যাঁর দেশে স্বৈরতন্ত্রের জয়ের প্রতীক। ১৯৭৩ সালে আয়েন্দে জেনারেল পিনোশের সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন।

নব্বইয়ের পরেও তৃতীয় দুনিয়ায় সেনা অভ্যুত্থান হয়, গণতন্ত্র বন্দী হয়, তবে আগের মতো রক্তপাত আর ঘটতে দেন না সেসব জেনারেলদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা। সে জন্যই মুরসি বন্দিত্বের পরে আরও ছয় বছর বাঁচতে পারলেন। এই ছয় বছর দৈনিক তাঁকে ২৩ ঘণ্টা নির্জন কক্ষে নিজের ধৈর্যের সঙ্গে এবং আদালতের সাউন্ডপ্রুফ খাঁচায় বিচারকের সঙ্গে বাহাস করে যেতে হয়। তিনি যদি ঘাতকের বিষে বা আঘাতেও মারা না যান, মারা গেছেন তাঁদের নির্দয়তার শিকার হয়ে। তাঁর মৃত্যু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী ফিল্ড মার্শাল সিসির জল্লাদের খরচ বাঁচিয়ে দিল। সিসিকে কেউ এখন সরাসরি খুনি বলতে পারবে না। কবি আল মাহমুদ লিখেছিলেন ইগল থাকবে, ইতিহাস থাকবে না। মুরসি বাঁচেননি, মোবারক বেঁচে আছেন।

মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ রবার্ট ফিস্কের ভাষায়, ‘স্বৈরশাসকের কারাগারে যদি আপনি মারা যান—এমনকি যদি আপনি মিসরের একমাত্র নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট না–ও হন, তাহলেও এক অর্থে আপনি খুন হয়েছেন।’ ছয় বছরে মাত্র তিনবার পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। মুরসির আইনজীবী হুঁশিয়ার করেছিলেন, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও লিভারের অসুখের ঠিকঠাক চিকিৎসা না হলে তাঁকে বাঁচানো যাবে না। মুরসির মৃত্যু হয় ৬৭ বছর বয়সে, আর ৯১ বছরের মোবারকের তবিয়ত এখনো ভালোই।

বিপ্লবের পরও পুরোনো শাসনব্যবস্থা সহজে মরে না। সেনাশাসকদের নিয়োজিত প্রধান বিচারপতি প্রথমে মিসরের নির্বাচিত সংসদকে ভেঙে দেন। পরে তাঁরা খেয়ে নেন প্রেসিডেন্টকে। ফিলিস্তিনি লেখক রামজি বারুদ লিখেছিলেন, ‘শৈশবে আমরা স্বপ্ন দেখতাম, একদিন মিসরীয় ট্যাংকগুলো এসে আমাদের দখলদারি থেকে মুক্ত করবে।’ এখন মিসরীয়রা খোদ তাদের সেনাবাহিনীর দখলদারির মধ্যে করুণ দিনাতিপাত করছে। পাশ থেকে ইসরায়েল হাসছে।

এ ঘটনা থেকে দুটি জিনিস শেখার আছে। ইসলামি বা সমাজতন্ত্রী যে আদর্শবাদীরাই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় বসুন, দলের নয়, আদর্শের নয়, জনতার ক্ষমতায়ন দিয়ে নিজেদের সুরক্ষা তৈরি করতে হবে। তা না করে মুরসি ক্ষমতায় বসেই মুসলিম ব্রাদারহুডের আধিপত্য নিশ্চিত করায় কাজ করেছেন। এটাই তাঁকে ব্রাদারহুডের বাইরের জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আবার গণতন্ত্রকামী জনতারও আত্মসমালোচনা থাকা উচিত। মুরসির পদত্যাগের আন্দোলন করে যে তাঁরা আগের চাইতে কঠোর সেনাশাসনের হাতে বন্দী হলেন, সেই দায় কার?

এখন প্রশ্ন হলো মুরসির মৃত্যুর প্রতিবাদ করা কি গণতান্ত্রিক, মানবিক, প্রগতিশীল মানুষের শোভা পায়? অনেকেই মুখে না বললেও নীরব থেকে বুঝিয়ে দেন ‘নেভার’ ‘নেভার’! তাহলে কি খুশি হওয়া যায়? সে রকম খুশিমন কি গণতন্ত্রের দাবিদার হতে পারে?

এহেন বিপক্ষীয় নীরবতা অথবা অস্বস্তিকর শান্তি কি আসলে নিরীহ? ভেবে দেখা যাক।

পদাসীন থাকার প্রায় এক বছরে মুরসি প্রগতিশীলদের হতাশ করেছেন। তাঁরা ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা এবং সেক্যুলারিজমের নিক্তিতে মুরসিকে খারাপ পেয়েছেন। তুমুল স্বৈরাচারী কিছু না করলেও সংবিধানকে নিজ দলীয় মতাদর্শে রচনা করতে গিয়েছেন। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি জনগণ এবং হামাসের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে মিসরের ডিপ স্টেট সেনাতন্ত্রের গায়ে আঁচড় কাটতে চেয়েছেন। ইসরায়েল-সৌদি আরব আর পশ্চিমা জোটের চোখের বালি থেকে গলার কাঁটা হতে চেয়েছেন।

সুতরাং প্রগতিশীল ও নারীবাদী চোখেও তিনি সমস্যা, ইসরায়েল-সৌদি-মার্কিন (ত্রিফলা শক্তি) শাসকদেরও তিনি শত্রু। তাঁর মৃত্যুতে খুশি হওয়া মুক্তচিন্তাবাদী আর তাঁর শত্রু সৌদি-ইসরায়েল আদর্শিকভাবে আলাদা হলেও মুরসিবিরোধিতায় তারা এক। তাতে যদি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ধ্বংস হয় হোক। মতবাদের একচক্ষু হরিণেরা তাই সহজেই বাঘের শিকার হয়, যেমন মুরসিও হয়েছেন, তেমনি তাঁর বিরোধী মিসরীয় গণতন্ত্রীরাও হচ্ছেন।

আয়েন্দের মৃত্যুর সময়ও অনেক সমাজতন্ত্রবিরোধী খুশি হয়েছিলেন। অপর আদর্শের লোকের প্রতি হিংসাও কি একধরনের সাম্প্রদায়িকতা না? এই হিংসা বা পাষাণ নীরবতা কি শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারকেই টিকে থাকতে সাহায্য করে না? ভুলে যাওয়া বোকামি হবে, মুরসিদের সঙ্গে লড়া সম্ভব, কিন্তু জায়নবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদের সঙ্গে লড়া ভয়াবহ রক্তপাতের ব্যাপার।

কারও আদর্শ ইসলাম, কারও কমিউনিজম, কারও জাতীয়তাবাদ হলেও কর্মসূচির দিক থেকে চিলির আয়েন্দে, ভেনেজুয়েলার শাভেজ এবং মিসরের মুরসিরা খুব দূরত্বে নেই। তাঁরা কিছুটা জাতীয়তাবাদী, বিপক্ষের প্রতি কড়া এবং নিম্নবিত্তের প্রতি কিছুটা দরদি। সাম্রাজ্যবাদের সাঁড়াশি আর অবাধ পুঁজিবাদী লুণ্ঠনের কামড় তঁারা কিছুটা আলগা করতে গিয়েছিলেন। অভ্যন্তরীণভাবে মাঝারি মাত্রার অসহিষ্ণুতা তাঁদের রাজনীতির অঙ্গ হলেও প্রতিপক্ষের তুলনায় তাঁরা একটা বিকল্প ছিলেন। নইলে কী হয় তা সিসির শাসনেই স্পষ্ট।

মুরসির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রচলিত ইসলামি রাজনীতির ব্যর্থতাও উন্মোচিত হয়। জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার চাইতে তাঁরা সমাজের নারী-পুরুষকে নিজেদের মতবাদের আলোকে চালাতে গিয়েছেন। এই সুযোগটাই তাঁদের স্বদেশি শত্রু এবং পশ্চিমারা নিয়েছে। ধর্ম-জাত-সম্প্রদায় না দেখে বৃহত্তর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শক্তিশালী হওয়া এবং মধ্যপন্থা নিয়ে টেকসই হওয়ার বদলে জনতাকে নিজেদের তৈরি করা মূল্যবোধের চাদরে-হিজাবে-শরিয়ায় ঢেকে দিতে গিয়ে আপন পায়েই কুড়াল মারেন। সমাজ দখল করতে গিয়ে এঁরা রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে পরাজিত হন। রাষ্ট্র কোনো মতবাদিক প্রতিষ্ঠান নয় যে তাকে আপন মতবাদ বাস্তবায়নে ব্যবহার করতে হবে।

মুরসি জীবিত অবস্থায় বিতর্কিত ছিলেন, মৃত্যুতেও বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু যে গণতন্ত্রের জন্যই, তা অস্বীকার করা যাবে না। গণতন্ত্র মানে কোনো মতবাদ নয়, শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ-জাত-লিঙ্গনির্বিশেষে নাগরিকের ক্ষমতায়ন। বিশ্বের আধুনিক ফারাওরা কখনোই সেই ক্ষমতাকে বাঁচতে দিতে চায় না।

ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক