হুমায়ূন আহমেদের ক্রিকেট-বিলাস ও বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া মহারণ

বিশ্বকাপের এই সময়টায়, বিশেষ করে বাংলাদেশের খেলার দিনগুলোয় ‘দখিন হাওয়া’য় সাজ সাজ রব পড়ে যাওয়ার কথা। বাংলাদেশের খেলা কীভাবে উপভোগ করা হবে, তা নিয়ে বিস্তর সলাপরামর্শ হওয়ার কথা। খেলা উপলক্ষে বিশেষ কোনো খাবারের আয়োজন হওয়ার কথা। টেলিফোন বেজে ওঠার কথা বারবার এসব নিয়ে। ...কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। এক আশ্চর্য নীরবতা চারপাশে। যাঁকে ঘিরে সরব হয়ে উঠত আমাদের বন্ধুমহলের ক্রিকেট উৎসব, সেই ক্রিকেট–বিলাসী হ‌ুমায়ূন আহমেদ যে নেই!

আমরা সকলেই হ‌ুমায়ূন আহমেদের জোছনা-বিলাস কিংবা বৃষ্টি-বিলাসের কথা জানি। তাঁর লেখালেখি, নাটক বা চলচ্চিত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ এই জোছনা বা বৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তি লেখক যে ক্রিকেট-বিলাসীও ছিলেন, সেটা তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা ছাড়া অন্যেরা তা সামান্যই জানেন।

ভীষণ ক্রিকেটপাগল ছিলেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। বিশেষ করে বাংলাদেশের খেলা দেখতে খুবই পছন্দ করতেন। আমাদের জাতীয় দল যখন ক্রিকেট খেলত, ক্রিকেটের যে ভার্সনই হোক না কেন—একদিনের ম্যাচ, টেস্ট বা টি-টোয়েন্টি—সমস্ত কাজ বন্ধ করে দিয়ে তিনি খেলা দেখবেনই।

২০১১ সালে যখন ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর বসল, হ‌ুমায়ূন আহমেদ ঠিক করলেন, তিনি এবং বন্ধুদের সবাই বাংলাদেশ দলের জার্সি পরে খেলা উপভোগ করবেন। আমাকে বললেন, ‘মাজহার, জার্সি কেনার ব্যবস্থা করো। আমরা সবাই মিলে একেকদিন একেক জনার বাসায় খেলা দেখার উৎসব করব।’ এভাবে প্রথম উৎসব করা হলো প্রকাশক আলমগীর রহমানের বাসায়। এর পরে একদিন মাসুম রহমানের বাসায়। আরেক দিন আর্কিটেক্ট আবু করিমের বাসায়। এর মাঝে স্যারের শাশুড়ি সাংসদ তহুরা আলী তাঁকে দুটি ভিআইপি টিকিট গিফট করলেন। তিনি খেলা দেখতে মাঠেও গেলেন, কিন্তু পুরো খেলা না দেখে চলে এলেন। বাকি খেলাটা দেখতে চান তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। এভাবেই তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি ম্যাচ উপভোগ করেছেন।

সে বছরই বিশ্বকাপ শুরুর আগে একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয় হ‌ুমায়ূন আহমেদের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘ফাউন্টেনপেন’। বইটি তিনি উৎসর্গ করেন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে। উৎসর্গপত্রে তিনি লেখেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি এই তরুণকে চিনি না, কিন্তু মুগ্ধ হয়ে তার ক্রিকেট খেলা দেখি। সাকিবের কাছে কুইজ, ক্রিকেট এগারোজন খেলোয়াড় খেলেন। কেন বারোজন না বা কেন দশজন না? সংখ্যাটা এগারো কেন?’

ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০০৭-এর কথা। বাংলাদেশ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ। স্যার তখন নুহাশপল্লীতে। আমরা অনেকেই সেখানে আছি তাঁর সঙ্গে। খেলা দেখার জমজমাট আয়োজন। ম্যাচের একপর্যায়ে যখন বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, স্যার ভীষণ উত্তেজিত এবং আত্মবিশ্বাসী। আমাদের বললেন, ‘দেখো, আজ নিশ্চয়ই বাংলাদেশ জিতবে। ছেলেগুলো খেলছে একেবারে বাঘের মতো।’ আমাদের মধ্যে তখনো বেশ সংশয়, সত্যিই কি জিততে পারবে বাংলাদেশ? বিশেষ করে প্রতিপক্ষ যখন দক্ষিণ আফ্রিকার মতো চূড়ান্ত পেশাদার একটি দল। স্যার আমাদের মনের অবস্থা ঠিকই পড়ে ফেললেন। অসম্ভব তীক্ষ্ণ ছিল তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। দ্বিধাগ্রস্ততা কাটিয়ে আমাদের চাঙা করতে তিনি ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশ আজ জিতলে আস্ত খাসি জবাই ও রান্না হবে। রাতে আমরা তা খাব। ম্যাচ শেষ হতে তখনো অনেকটা সময় বাকি থাকলেও স্যার নুহাশপল্লীর ম্যানেজার বুলবুলকে বললেন, ভালো দেখে একটা খাসি কিনে আনো।

সত্যি সে ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছিল আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম জয়। খুব উৎসব হলো সে রাতে। খাসি জবাই হলো। স্যার আমাকে বললেন, ‘মাজহার, খাসির মাংসটা তুমি রান্না করবে। ঝাল বেশি দেবে।’ আমার রান্না স্যার অসম্ভব পছন্দ করতেন, বিশেষ করে খাসি আর চিংড়ির কয়েকটি রেসিপি। কাঠের লাকড়ি দিয়ে মাটির চুলায় বড় হাঁড়িতে সে রাতে রান্না হলো খাসির মাংস। বাংলাদেশের জয়টা এভাবেই উপভোগ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই ঔপন্যাসিক। আমাদের সৌভাগ্য, সেই উৎসবে আমরা সঙ্গী ছিলাম তাঁর।

একবার হ‌ুমায়ূন স্যার সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলেন শুটিং করতে। তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল অস্ট্রেলিয়া সফর করছিল। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের দিন তিনি শুটিং বন্ধ করে কীভাবে খেলা দেখেছিলেন, সে কথা নিজেই লিখেছেন ‘দেখা না-দেখা’ গ্রন্থে—

‘আমি ঘোষণা দিলাম, আগামীকাল অফ ডে। আমরা কোনো শুটিং করব না।
হাসানের মুখ শুকিয়ে গেল। শুটিং অফ মানে আরেকদিন বাড়তি থাকা। বাড়তি খরচ। বাড়তি টেনশন।
আমি হাসানকে আশ্বস্ত করার জন্যে বললাম, তুমি টেনশন কোরো না। আমরা Extra কাজ করে আগামীকালের ক্ষতি পুষিয়ে দেব।
আগামীকাল কাজ করবেন না কেন?
আগামীকাল অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা। আমি ক্রিকেট খেলা দেখব।
শাহীন বলল, ক্রিকেট খেলা দেখা যাবে না।
কেন দেখা যাবে না?
শাহীন বলল, এখানকার কোনো বাঙালির বাড়িতে ডিশের লাইন নেই। খরচের ভয়ে তারা ডিশ লাইন নেয় না।
আমি বললাম, রেস্টুরেন্টগুলোতে খেলা দেখার ব্যবস্থা নেই?
সুইসরা ক্রিকেটভক্ত না। তারা ফুটবল ছাড়া কোনো খেলা দেখে না।
আমি হাসানের দিকে ফিরে বললাম, তোমার দায়িত্ব কাল আমাকে খেলা দেখানো।
হাসান বলল, অবশ্যই।
পাঠকেরা ভুলেও ভাববেন না আমি ক্রিকেটের পোকা, কে কখন কয়টা ছক্কা মেরেছে, কে কতবার শূন্যতে আউট হয়েছে, এসব আমার মুখস্থ। মোটেও না। আমি শুধু বাংলাদেশের খেলা থাকলেই দেখি। অন্য খেলা না।
বাংলাদেশের কোনো খেলা আমি মিস করি না। ওই দিন আমার সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ। বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় যখন চার মারে, আমার কাছে মনে হয় চারটা সে মারেনি। আমি নিজে মেরেছি। এবং আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো বোলার যখন কঠিন বল করে, তখন আমার মনের ভাব হচ্ছে, ‘বলটা কেমন করলাম দেখলিরে ছাগলা? কলজে নড়ে গেছে কি না বল। আসল বলিং তো শুরুই করিনি। তোকে আজ পাতলা পায়খানা যদি না করাই আমার নাম হ‌ুমায়ূন আহমেদই না।

আনন্দে চোখে পানি আসার মতো ঘটনা আমার জীবনে অনেকবার ঘটেছে। যে কয়বার বাংলাদেশ ক্রিকেটে জিতেছে প্রতিবারই আমার চোখে পানি এসেছে। বাংলাদেশি ক্রিকেটের দুর্দান্ত সব খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ। তারা চোখভর্তি পানি নিয়ে আসার মতো আনন্দ একজন লেখককে বারবার দিচ্ছেন। পরম করুণাময় এই সব সাহসী তরুণের জীবন মঙ্গলময় করুক, এই আমার শুভকামনা।

আমরা যেখানে আছি (রুখতেনস্টাইন) সেখানে ক্রিকেট খেলা দেখার কোনো ব্যবস্থা হাসান করতে পারল না। তাকে পরাজিত ও বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল। সে বাসে করে আমাদের নিয়ে রওনা হলো সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জুরিখে। জুরিখে অনেক বাঙালি, তাদের কারও বাসায় Star Sports কিংবা ESPN তো থাকবেই।

কাউকে পাওয়া গেল না। আমরা পাবে পাবে ঘুরতে লাগলাম। সাধারণত, পাবগুলোতে খেলা দেখানো হয়। কোথাও পাওয়া গেল না। এই সময় খবর এল জুরিখের একপ্রান্তে অস্ট্রেলিয়ানদের একটা পাব আছে। অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের খেলা সেই পাবে নিশ্চয়ই দেখানো হবে। গেলাম সেখানে, সেই পাবে রাগবি দেখাচ্ছে। আমরা ক্রিকেট দেখতে চাই শুনে পাবের অস্ট্রেলিয়ান মালিক বিস্মিত হয়ে তাকাল।

স্বাধীন বলল, আমরা তোমাদেরকে একবার হারিয়েছি। আজও হারাব। আমাদের এই আনন্দ পেতে দাও। প্লিজ।

অস্ট্রেলিয়ান মালিক বলল, এসো। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’

বাংলাদেশ দলের খেলার প্রতি যে হ‌ুমায়ূন আহমেদের অকৃত্রিম ভালোবাসা, এর প্রমাণ তিনি রেখেছিলেন নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও। ২০১১ সালে নভেম্বর-ডিসেম্বরে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরের কথা শুনে আমাকে তিনি বললেন, ‘মাজহার, তুমি যেভাবেই হোক আমাকে খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করো। কমলকে ফোন করে খবর নাও কোন চ্যানেলে খেলা দেখা যাবে।’

ক্রিকেটের যেকোনো বিষয় হলে হ‌ুমায়ূন আহমেদ বলতেন, ‘কমলকে ফোন করো।’ তো কমলকে ফোন করে আমি যে দুটি চ্যানেলের নাম শুনলাম, নিউইয়র্কের বাসায় যে ডিশের লাইন ছিল, সেই লাইনে চ্যানেল দুটো দেখা যায় না। স্যারকে বলতেই তিনি খুব আপসেট হয়ে গেলেন। কী করা যায়? আমি ইন্টারনেটে কোনো চ্যানেলে খেলাটা দেখা যায় কি না খুঁজতে লাগলাম। কোনোভাবেই কোনো ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। হঠাৎ বিকেলবেলা বাসায় এলেন বেলাল বেগ, স্যারের পুরোনো বন্ধু। স্যারের গ্রামের বাড়িতে শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ স্কুলটা যার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। তিনি এখন নিউইয়র্কে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। একটি বিশেষ কায়দায় তিনি ইন্টারনেটে খেলা দেখেন। সেটা কীভাবে দেখেন একটা কাগজে স্যারকে লিখে দিয়ে গেলেন। আমি বাইরে থেকে ফেরার পর দেখলাম, স্যার খুবই আনন্দিত। তাঁর চোখ-মুখে আনন্দের সেই দ্যুতি খেলা করছে। তিনি বললেন, ‘মাজহার, খেলা দেখার ব্যবস্থা হয়ে গেল!’

আমি জানতে চাইলাম, কীভাবে, কোথায় দেখবেন?

হ‌ুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘বেলাল বেগ এসেছিল। সে আমাকে ওয়েবসাইটের ঠিকানা দিয়ে গেছে। তুমি এখনই তোমার ল্যাপটপ নিয়ে বসে এটা বের করো এবং আমাকে দেখাও। তুমি সব রেডি করে রাখো যেন আমি খেলাটা ভোররাতে দেখতে পারি।’

খেলাটা শুরু হতো ভোররাতে, নিউইয়র্ক সময় ভোররাত চারটায়। আমি রাতে ওই অ্যাড্রেস ধরে দেখলাম খেলা দেখা যাবে।

আমি সব রেডি করে বললাম, স্যার কম্পিউটার ওপেন করা থাকবে, আপনি শুধু এখানে ক্লিক করলে চ্যানেলে খেলা দেখা যাবে। তিনি বললেন, ‘দেখো, আমি এসব কম্পিউটার-টম্পিউটার বুঝি না। ওই সব ঘটর ঘটর আমি করতে পারব না। তুমি ভোরে উঠে আমাকে খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করে দেবে।’

ভোরে দরজায় স্যারের কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙল। চোখ ডলতে ডলতে ঘুম থেকে উঠে এসে আমি কম্পিউটারে চ্যানেলটা ধরলাম। কালো রঙের একটা সোফায় তিনি বসলেন। সোফার সামনে রাখা হলো ল্যাপটপ। তিনি ল্যাপটপে খেলা দেখতে লাগলেন। আমাকে বললেন, ‘তুমি আমাকে কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দাও।’ আমি চা বানিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, ‘এখন ঘুমাতে যেতে পারো।’ আমি বললাম, কেন ঘুমাতে যাব? আমিও আপনার সঙ্গে খেলা দেখব। বাংলাদেশ যখন একেকটা চার-ছয় মারে, তিনি চিৎকার দিয়ে ওঠেন। যখন একেকটি উইকেটের পতন ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মন খারাপ হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকল খেলা দেখা।

একইভাবে নিউইয়র্কে বসে মার্চ ২০১২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের খেলাগুলো দেখেছেন তিনি।

আজ আবার বাংলাদেশ খেলছে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। আগের ম্যাচটায় জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশাল রানের পাহাড়কে তাড়া করে। বিশ্বকাপ শুরুর ম্যাচটায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছে দারুণভাবে। বাংলাদেশ দলের আর কোনো সাফল্যে উল্লাসে ফেটে পড়বেন না হ‌ুমায়ূন আহমেদ, ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়বেন না। তবে আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা ও শুভকামনা ছিল, অন্য ভুবনে পাড়ি জমালেও তাঁর শুভাশীষ আছে টাইগারদের সঙ্গে।

মাজহারুল ইসলাম: প্রকাশক